প্রকাশিত : ৩১ জুলাই, ২০১৯ ২১:৪৯

গরীবের পেটে লাথি না দিতে বগুড়ায় হঠাৎ মার্কেটের ব্যসায়ীদের আকুতি

৬’শ পরিবারের ঈদ আনন্দে ভাটার আশংকা
প্রবীর মোহন্তঃ
গরীবের পেটে লাথি না দিতে বগুড়ায় হঠাৎ মার্কেটের ব্যসায়ীদের আকুতি
ফুটপাতের হকারদের ব্যবসা বড়ই কষ্টের। কনকনে শীত, আগুনের মতো রোদ, প্রবল বর্ষণ কোনো কিছুই তাঁদের জন্য বাধা নয়। কিন্তু যখন উচ্ছেদ অভিযান চলে তখন ছিন্নভিন্ন হয় তাদের স্বপ্ন। 

কারণ একটি দোকানের উপর নির্ভর করে কয়েকটি পরিবার। বগুড়ায় হঠাৎ মার্কেটে এরকম ৪’শর মতো ব্যবসায়ী রয়েছে যাদের আয়ের উপর নির্ভর করে পরিবার তথা হাজার হাজার প্রাণ। কিন্তু তাদের মধ্যে দুলছে “ উচ্ছেদ” আতংক। উচ্ছেদ অভিযানের সময় তাদের মনোকষ্ট চোখে তাকালেই বোঝা যায়। ফুটপাতে ব্যবসার পক্ষপাতিত্ব করে না কেহই। তবে মানুষের রুটি-রুজি কেড়ে নেয়া উচিত না বলে মনে করেন অনেকে। তাঁদের জীবনের বেদনা রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকেরা সংবেদনশীলতার সঙ্গে উপলব্ধি করবেন বলে মনে করেন অনেকে।

লাখ লাখ মানুষ অর্ধাহার– অনাহার থেকে বাঁচবে অন্তত এই ঈদের আগে তারা পরিবার নিয়ে পেটপুরে না হলেও তাদের বেঁচে থাকতে এই মানবিক আকুতি ব্যবসায়ীদের। শরীরে কোমল ঠান্ডা বাতাসের পরশ নিয়ে যখন বড় বড় বিপণি বিতানগুলোতে উচ্চবিত্তরা বাজার করছে, তখন হঠাৎ মার্কেটের দোকানগুলোতে সাধ্যের মধ্যে গরীবের পোশাকের চাহিদা মেটাচ্ছে। মার্কেটের একাধিক ব্যবসায়ীদের সাথে আলাপকালে তাদের মুখে উল্লেখিত কথাগুলো উচ্চারিত হয় বারবার। ব্যবসায়ী জাকিউল হাসান ফারুক, আব্দুর রউফ, আব্দুস সালাম,মাইদুল ইসলাম,মোঃ শফিকুল ইসলাম শফিকসহ একাধিকরা জানান, প্রায় ৪শ দোকানী ২৫ বছর ধরে এখানে টানা ব্যবসা করে আসছি।

আজ পর্যন্ত ট্রেনে কোন দূঘটনা ঘটেনি। রেলের অনেক জায়গা রয়েছে সেখানে দোকানও রয়েছে। আমাদের কি দোষ? গরীব বলেই কি আমাদের এতো সমস্যা। আমরাতো ধনী হতে আসিনি, ক্ষুধার জ্বালায় বাঁচতে এসেছি। যখন তখন আমাদের উচ্ছেদ চলে। আমরা কি করব কোথায় যাব? আমাদের দয়া করুন। যদি চলে যেতে হয় তাহলে আমাদের ও সাথে যারা রয়েছে তাদের পুরো পরিবারে নেমে আসবে অন্ধকার। অর্ধাহার নয়, অনাহারে বাঁচতে হবে। যদি ঈদের আগে আমাদের চলেযেতে হয় তাহলে, এখানকার ৬শ পরিবারের প্রায় ১৫ হাজার মানুষের ভাটা পড়বে ঈদের আনন্দ। পরিবার নিয়ে কোথায় গিয়ে দাঁড়াব।

তারা আরও বলেন, আসছে ঈদ। ঈদকে সামনে রেখে বগুড়া,গাইবান্দা,রংপুর,নওগাঁ,সিরাজগঞ্জ জেলা থেকে নিম্নআয়ের মানুষগুলো সাধ্যানুযায়ী সন্তান ও পরিবারের সবার জন্য নতুন পোশাক কিনতে আসে। আর দাম কম হওয়ার কারণে তাদের প্রথম পছন্দ আমাদের বগুড়ায় ফুটপাতের হটাৎ মার্কেট। বগুড়ার রাস্তায় শত শত দরিদ্র কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতী নিরক্ষর দরিদ্র হকার উচ্চতর অর্থনীতির তত্ত্ব বোঝে না, প্রতিদিন রাস্তায় কোটি কোটি টাকার পতনশীল পণ্য ধ্বংসের হাত থেকে বেঁচে যাচ্ছে আমাদের হকারদের কল্যাণে। প্রতিদিন বিভিন্ন জেলা থেকে প্রায় ৫/৭ হাজার নারী-পুরুষ এখানে আসে কেনাকাটা করতে। বগুড়ার অর্থনৈতিক উন্নয়নে গরীর হলেও আমাদের অবদান কম নয়। বগুড়ার সচেতন অনেকে জানান, পৃথিবীতে সম্ভবত এমন কোনো মহানগরী নেই, যেখানে ফুটপাতে হকার নেই।

তবে সেখানে খেয়ালখুশিমতো নয়, নগর কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষেই তাঁরা বিক্রিবাট্টা করেন। ফুটপাতের পাশে দোকানদারিও হয়, অন্যদিকে মানুষ হাঁটতেও পারে, কেনাকাটাও করে। কেউ কারও বিঘœ ঘটায় না। ফুটপাতের হকার ছাড়া জেলার জীবন অচল। কারা করেন ফুটপাতের হকারের ব্যবসা? যাঁরা প্রধানত শহরের এবং গ্রামের নিম্ন আয়ের মানুষ। যাঁদের সেলামি দিয়ে দোকান ভাড়া নিয়ে ব্যবসা করার সামর্থ্য নেই। অত পুঁজি তাঁদের নেই। এই হকারদের মধ্যে অনেকে রয়েছেন গ্রামের ভূমিহীন কৃষক, নদীভাঙনে নিঃস্ব মানুষ, অল্পশিক্ষিত বেকার চাকরি-বাকরি না পেয়ে ধারদেনা করে কিছু মূলধন জোগাড় করে ছোট ব্যবসায় নেমেছেন। বসে পড়েছেন ফুটপাতের এক প্রান্তে। দিনে দিনে বিক্রি করে যা রোজগার হয়, তাতে কোনোমতে চলে সংসার। আবার ফুটপাতের পণ্যের ক্রেতা কারা? তাঁদের ক্রেতার ৯০ শতাংশই নিম্ন আয়ের মানুষ, সাধারণ পথচারী ও গৃহবধূ।

ব্যবসায়িদের দাবি, আমরা হাত পেতে নয়, পরিশ্রম করে উপার্জন করে বাঁচতে চাই। সরকার দয়াকরে আমাদের কর্মসংস্থান যেন সৃষ্টি করে দেন। একপাশে কোন উচ্ছেদ নেই, আমাদের পাশে কেন এই তান্ডব। যদি উচ্ছেদ হই তাহলে আমাদের কর্মসংস্থান কোথায় হবে। কারা দেবে আমাদের ঠিকানা। আমরাও হতে চাই দেশ উন্নয়নের অশিংদার। ফুটপাত দখল করে রাস্তার উপর থাকে গাড়ি, রিক্সা,সিএনজি। আমরাতো তা করিনি।

আমরা জীবিকার তাগিদে সৎ ভাবে বাঁচার জন্য পরিশ্রম করছি। সকল ব্যবসায়ীরা উর্দ্ধত্তন কর্তৃপক্ষের কাছে দৃষ্টি আকর্ষন করছি তারা যেন আমাদের সমস্যাগুলো একটু বিবেচনা করেন। কারণ আমরাও মানুষ,আমরাও ভাগ করে নেই সকলের সুখ-দুঃখ। গাইবান্দা থেকে আসা রিক্সাচালক শহিদুল আলম এসেছেন তার ছেলেমেয়ের জন্য ঈদের জামা-জুতা কিনতে।

তিনি জানান, মার্কেটগুলোতে জিনিসপত্রের দাম খুব বেশী। তিনি যা রোজগার করেন তা দিয়ে ওসব দোকান থেকে জিনিসপত্র কেনার সামর্থ তার নেই। তাই এ সস্তার বাজারেই তার স্বস্তি। এ জেলার নিম্নবিত্তরা বড়বড় বিপণী বিতানের আলোকসজ্জা দেখতে পারলেও সেখানে ঢোকার কিংবা কেনা-কাটার সামর্থ তাদের নেই। শহরের হটাৎ মার্কেটই তাদের ভরসা। সেখানেই তারা সেরে নিচ্ছেন তাদের সাধ্যের পণ্য।

বিষয়টি নিয়ে শাপলা সুপার মার্কেটের ব্যবসায়ী সমিতির সাধারন সম্পাদক আজিজুর রহমান লিটন জানান, আমরা গরীব, হাজার হাজার মানুষ এই ফুটপাতে জীবিকা নির্বাহ করে। আমরা থাকি মানসিক আশান্তি নিয়ে। কখন যে শুরু হয় উচ্ছেদ। ফুটপাতে যারা পরিশ্রম করে জীবন চালায় তারাই বোঝে অভাব নামের দানবটা কত নিষ্ঠুর। ধোলাই খাল মার্কেট কমিটির সভাপতি সৌরভ জানান, আমরা দীর্ঘদিন ধরে এখানে ব্যবসা করে আসছি। কিন্তু আমাদের মধ্যে একটাই আতংক “উচ্ছেদ”। আমরা খাজনা,ট্যাক্স সবই দিই,কিন্তু টেনশন শেষ হয় না।

কষ্টের সংগ্রামী জীবন ধনীদের কানে পৌঁছায় না। বড় হতে নয়, বাঁচার জন্য পরিবারের মুখে একমুঠো ভাত তুলে দিতেই আমাদের চেষ্টা। এখানে যত মার্কেট রয়েছে সকলের একটাই টেনশন উচ্ছেদ।

কড়িতলা মার্কেট কমিটির সাধারণ সম্পাদক মাসুদুর রহমান বিপ্লব জানান,মাঝে মধ্যেই আমাদের উচ্ছেদ আতঙ্কে ভুগতে হয়। কখন কি অবস্থার সৃষ্টি হয় আমরা নিজেরাই জানিনা। অথচ আমরা ভ্যাট আয়কর সবই দিয়ে থাকি।  তীব্র প্রত্যাশা নিয়ে দিনের আশায় রাতের ঘুমাতে যান বগুড়ার এই সংগ্রামী মানুষগুলো। হয়তো প্রিয় ব্যবসা ছেড়ে আর সরে যেতে হবে না। হয়তো আর আতংকিত করবে না ভাঙনের নিষ্ঠুর শব্দ।

বাঁশির হুইসিল আর ভাঙ্গনের শব্দে সকলের মাথায় হাত ওঠে! কথা বলার সময় চেহারা না দেখতে পেলেও অনুভব করা যায়, ওদের চোখের পাতা দু’টোও হয়তো এখন ভিজে উঠেছে! তবে সবকিছুর মূলে কথা ওই একটাই- রোজগার। হতাশার-কষ্টের এক কাল্পনিক চিত্র ভেসে ওঠে হৃদয়ের ক্যানভাসে।

উপরে