প্রকাশিত : ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ২২:৩৯

জলঢাকায় বিভিন্ন প্রকল্পের সোয়া দুই কোটি টাকা লুটপাট দেখার কেউ নেই ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন

আল ইকরাম বিপ্লব, জলঢাকা (নীলফামারী) প্রতিনিধিঃ
জলঢাকায় বিভিন্ন প্রকল্পের সোয়া দুই কোটি টাকা লুটপাট
দেখার কেউ নেই ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন

গ্রামকে শহরে রুপান্তরিত করতে বর্তমান সরকারের প্রাণপণ চেষ্টাকে ধংশের মুখে নিয়ে যাচ্ছে তৃণমুল পর্যায়ের সরকার দলীয় নেতাকর্মীসহ সরকারের কিছু কর্মকর্তারা। এসব চিত্র দেখা যায় নীলফামারী জেলার তৃণমুল পর্যায়। নীলফামারী জেলার জলঢাকা উপজেলার গ্রামীন অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য এম’পির দেয়া বিশেষ বরাদ্দ কাবিখা ও টিআর প্রকল্পের নামে মাত্র কাজ দেখিয়ে অর্থ  আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে প্রকল্প সভাপতিদের বিরুদ্ধে। ২০১৯-২০২০ অর্থ বছরের বিশেষ বরাদ্দ কাবীখা ও টি-আর প্রকল্পে প্রায় সোয়া দুই কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছে স্থানীয় সুশিল সমাজ। অথচ এই লুটপাটের বিষয়ে খবরাখবর জানলেও কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না সংশ্লিষ্ট উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা। এতে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন।

নীলফামারী-০৩ আসনের সংসদ সদস্য মেজর(অবঃ) রানা মোহাম্মাদ সোহেল এমপি’র দেয়া বিশেষ বরাদ্দ থেকে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে জলঢাকা উপজেলায় কাবিখা ও টি-আরের মোট ১৪০টি প্রকল্পের অধীনে ০২ কোটি ১২ লাখ ৩১ হাজার টাকা গ্রামীন অবকাঠামো উন্নয়নে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের কাবিখা বরাদ্দকৃত ৩৫টি প্রকল্পের ৩২১ মেঃ টন গম। যার আনুমানিক মুল্য প্রায় ০১ কোটি ১৫ লক্ষ ৫৬ হাজার টাকা। গোপন সূত্রে জানা যায়, একই অর্থ বছরের দুই দফায় ২১৫টি টিআর প্রকল্পের প্রতিটি প্রকল্পে ৪৫ হাজার টাকা করে বরাদ্দ দিয়েছে মোট ৯৬ লক্ষ ৭৫ হাজার টাকা। কাবীখা ও টি-আর প্রকল্প গুলো বেশির ভাগেই কাঁচা রাস্তা সংস্কারের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়।

কিন্তু ০৭দিন যাবত এই উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন সরেজমিনে গেলে বাস্তবে দেখা যায়, এসব প্রকল্পের কোন কাজ হয়নি। প্রকল্পগুলোর পার্শবর্তী লোকজন বলতে পারে না রাস্তা সংস্কারের কথা। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে কৈমারী ইউনিয়নের ০৮নং ওয়ার্ডের ঈদগাহ মাঠ হতে হাজী মোবারকের বাড়ি রাস্তা সংস্কারের জন্য ০৮ মেঃটন গম বরাদ্দ দিলেও একই রাস্তায় ভিন্ন নামে “কৈমারী ০৮নং ওয়ার্ডের মলবীর ডাঙ্গা হতে তেলিপাড়া পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার করার জন্য দ্বিতীয় পর্যায় টি-আরের ৪৫ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ডাবল বরাদ্দ থাকলেও কোন প্রকার কাজ হয়নি বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর।

এছাড়াও প্রথম পর্যায়ে কাবীখার বরাদ্দ দেয়া হয়েছে  কৈমারী আতিয়ারের বাড়ি থেকে সরিন বাবুর বাড়ির পাকা রাস্তা সংস্কারের ০৮মেঃটন গম, যা মোঠেও কোন কাজ হয়নি, প্রকল্প চেয়াম্যানেরও দেখা মেলেনি। ওই ইউনিয়নের বাসিন্দা উপজেলা যুবলীগের যুগ্ন আহবায়ক মকছুদার রহমান লেলিন উপজেলা প্রশাসনকে দায়ী করে বলেন, সরকারের কোটি কোটি টাকার বরাদ্দ চোখের সামনে লুটপাট হচ্ছে জেনেও, দেখছে না কেউ। তিনি বলেন, কৈমারী বাজার পুরাতন বাসষ্টান হইতে শামিম বসুনিয়া পাড়া পর্যন্ত রাস্তায় ০৮ টলি মাটি ফেলেছে, যার মুল্য ০৪ হাজার টাকা বাকী টাকা কে খাইলো। এম,পির বিশেষ বরাদ্দ কাবীখা ও টিআর প্রকল্পের অধীনে বেশি বরাদ্দ পেয়েছে উপজেলার ডাউয়াবাড়ী ইউনিয়নে। সেখানে টি-আর ছাড়াও কাবীখার প্রকল্প দেয়া হয়েছে ০৬টি, এতে গম বরাদ্দ হয়েছে প্রথম পর্যায়ের তিনটি প্রকল্পের বরাদ্দ ২৪ মেঃ টন এবং দ্বিতীয় পর্যায়ের তিনটি প্রকল্পে দেয়া হয়েছে ৩০ মেঃ টন। এখানে কোন কাজের চিত্র দেখা যায়নি।

তবে ০১নং ওয়ার্ডের মৃত. জালাদু মামুদের ছেলে সাইদার রহমান জানান, মৃত. রহমত খাঁর ছেলে মমিদুল খাঁ আমাক, সাইদুল মাস্টারের বাড়ি হইতে আবুর দোকান পর্যন্ত রাস্তা মেরামতের জন্য কাজ দিয়েছে। আমি ২০/২৫ জন লেবার নিয়ে রাস্তার গড় বাধার কাজ করেছি তিনদিন, টাকা দাড়িয়েছে মাত্র ২৮ হাজার টাকা। তাওং আবার কোটে মামলা করে সেই টাকা তুলতে হয়েছে আমাক। অথচ ওই রাস্তায় বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ১০ মেঃটন গম, যার মুল্য ০৩ লক্ষ ৬০ হাজার টাকা। এদিকে বুড়িতিস্তা বাঁধ হতে ০১নং ওয়ার্ডের যাতায়াতের রাস্তায় ত্রানের  ব্রীজের দুই পারে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ খাল ও রাস্তা সংস্কারের ০৮মেঃটন গমের কাজ হয়নি বলে অভিযোগ ইউপি সদস্য সফিকুল ইসলামসহ পথচারীদের। ইউপি সদস্য সফিকুল ইসলাম জানান, আমি প্রতিনিয়ত এই ত্রানের ব্রীজের উপর দিয়ে যাতায়াত করে আসি। কোনদিন চোখে পড়েনি এখানে কোন কাজ হয়েছে। তিনি বলেন, এই জায়গার বরাদ্দের জন্য আমি কতবার এমপির কাছে গিয়েছি, আর আজ আপনাদের (সাংবাদিক) এর কাছে শুনলাম এখানে বরাদ্দ হয়েছে ০৮ মেঃটন গম। একই কথা বলছে পথচারীরা, তারা জানান প্রতিদিনের ভোগান্তির কথা।

নেকবক্ত ময়দানের পাড় হতে রেল লাইনের রাস্তা সংস্কারের ১০টন ও ক্লাবের দিঘি থেকে সিদ্বেশ্বরী মাঝাপাড়া আইয়ুবের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তায় ১০টন গম। এই ইউনিয়নের অন্যান্য প্রকল্প গুলোও একই অবস্থা, কোথাও কোন কাজ হয়নি বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। খুটামারা আলীম মাদ্রাসার গেট থেকে আউয়ালের বাড়ি পর্যস্ত রাস্তা সংস্কারর ০৮ মেঃটন গমের এক কোদাল মাটিও পড়েনি বলে ভুড়িভুড়ি অভিযোগ এলাকাবাসীর। কাঁঠালী ইউনিয়নে ডারকি বেচা পাড়া রশিদের বাড়ি থেকে মিজানুরের বাড়ি পর্যস্ত রাস্তায় ১০টন, ০৩নং ওয়ার্ড মনোয়ারের বাড়ি থেকে পরেশ মেম্বরের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তায় ১০টন ও আজিজার চেয়ারম্যানের বাড়ি থেকে হামিদুলের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তায় ০৮টন গমের নামে মাত্র কাজ দেখিয়ে বরাদ্দের সব টাকায় উত্তোলন করেছে প্রকল্পের সভাপতিরা।

অন্যদিকে সবচেয়ে বিগ বরাদ্দ উপজেলার গোলমুন্ডা ইউনিয়নে, এখানে কাবীখার ০৭টি প্রকল্প। এই ইউনিয়নে প্রথম পর্যায়ে ০৪টি প্রকল্পের সাড়ে ৩২মেঃটন এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে ০৩টি প্রকল্পে সাড়ে ৩২মেঃটন গম বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। অন্যান্য প্রকল্পের মত একই অবস্থা, এখানে ৬৫মেঃটন গমের কোন প্রকার কাজ হয়নি গ্রামবাসির অভিযোগ। প্রথম পর্যায়ের কাবীখার ০৮ মেঃটন বরাদ্দ চৈতনের ঘাট থেকে কদমতলী সঃপ্রাঃবি হয়ে সাইদারের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার করেনি বলে আব্দুস সালাম নামে এক ব্যক্তি জানিয়ে বলেন, সরকারি টাকা লুটপাট করেছে। তিনি পুনরায় রাস্তা সংস্কারেরও দাবী জানান। এদিকে সাইদার রহমান বলেন, আমি জানিনা আমার নামে বরাদ্দ হয়েছে। তবে তিনি বলেন, আমার পারিবারিক কবরস্থানের জন্য ৪৫ হাজার টাকার বরাদ্দ পেয়েছি।

তিনিও সেই কবরস্থানের কোন প্রকার কাজেই করেননি। এলাকাবাসীর অভিযোগ, এই প্রকল্প গুলোর ২০% কাজেই সঠিকভাবে করা হয়নি। অথচ বরাদ্দের পুরো টাকাই পকেটে পুরেছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। প্রধানমন্ত্রীর হস্থক্ষেপ কামনা করেছেন এলাকাবাসী, তদন্ত সাপেক্ষে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ারো দাবী জানান তারা। উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন ঘুরে দেখা যায়, এসব প্রকল্পে এক কোদাল মাটিও কাটা হয়নি। টিআর ও কাবিখা প্রকল্পের কাজে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্র চোখে দেখলেও জুন ক্লোজিংয়ের মধ্যেই পুরো টাকা উত্তোলনের সহযোগিতা করেছে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা। যা সঠিক তদন্ত হলে কেচো খুড়তে সাপ বেরিয়ে আসবে বলে দাবী অনেকের। এই প্রকল্প গুলোর কাজের চরম ফাঁকিবাজি করা হয়েছে। লোক-দেখানো সড়ক সংস্কার করেই লুটপাট করা হয়েছে এসব বরাদ্দের প্রায় সোয়া দুই কোটি টাকা। জানতে চাইলে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ময়নুল হক, নিজেকে দ্বায়মুক্ত করে কথা বলতে বলেন উপজেলা নির্বাহী অফিসারের সাথে।

এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহবুব হাসান বলেন, আওয়ামীলীগের নেতাকর্মী সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ এই প্রকল্প গুলোর কাজের দেখাশুনা করেছে। তিনি বলেন, আমি পিআইও সহ কিছু কিছু এলাকায় কাজও দেখেছি কাজ করেছে, কোন কোন জায়গায় কাজের সমস্যা হয়েছিলো তৎক্ষনাত ব্যবস্থা নিয়েছি। তিনি বলেন, যেসব প্রকল্পের কাজ হয়নি অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নিবো। বিশেষ বরাদ্দের উপর কোন হস্থক্ষেপ নেই এবং প্রকল্পের কাজ হযেছে কি, হয় নাই, এসব দেখার অধিকার নেই বলে দাবী করে, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল ওয়াহেদ বাহাদুর বলেন, যেখানে ‘টিআর ও কাবিখা প্রকল্পের তালিকার জন্য উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কাছে আমাকে আবেদন করে তালিকা নিতে হয়। এজন্য বিশেষ বরাদ্দের বিষয়টি আমার জানা নেই। তিনি বলেন, উপজেলার মাঠ পর্যায় ঘুরে আপনারা দেখেন কাজ হইছে, কি হয় নাই, না লুটপাট হয়েছে আপনারা তদন্ত করেন, এছাড়া এর বাইরে বেশি কিছু বলতে পারবো না আমি।

দৈনিক চাঁদনী বাজার/সাজ্জাদ হোসাইন

উপরে