করোনা ভাইরাস নিয়ে বিভ্রান্তিকর ওয়াজ এবং ইসলামের সঠিক নির্দেশনা | Daily Chandni Bazar করোনা ভাইরাস নিয়ে বিভ্রান্তিকর ওয়াজ এবং ইসলামের সঠিক নির্দেশনা | Daily Chandni Bazar
logo
প্রকাশিত : ১৯ মার্চ, ২০২০ ২৩:১৩
করোনা ভাইরাস নিয়ে বিভ্রান্তিকর ওয়াজ এবং ইসলামের সঠিক নির্দেশনা
অনলাইন ডেস্ক

করোনা ভাইরাস নিয়ে বিভ্রান্তিকর ওয়াজ এবং ইসলামের সঠিক নির্দেশনা

করোনা ভাইরাস থেকে বাঁচার উপায় ও করণীয় সম্পর্কে অনেক ভুল পরামর্শ অনলাইনে ছড়িয়ে পড়ছে। এরমধ্যে কতগুলি ধর্মীয় ও কতগুলি চিকিৎসা বিজ্ঞান সম্পর্কিত। যেমন, কেউ বলছেন ২৩ ডিগ্রির বেশি তাপমাত্রায় এ ভাইরাস ছড়াতে পারে না। সুতরাং বাংলাদেশের ভয় নেই। কেউ বলছেন এ ভাইরাস নিয়ে এত ভয়েরই কিছু নেই। এসব ভুল তথ্যের মাধ্যমে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে।

তবে সবচেয়ে ভয়ঙ্করভাবে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে ধর্মীয় অপব্যাখ্যাগুলো। ধর্মীয় অপব্যাখ্যা দিয়ে কেউ কেউ বলছেন, করোনা ভাইরাস আতঙ্কে মাস্ক-এর পেছনে না ঘুরে, মুসলমানরা পাচঁ ওয়াক্ত নামাজ পড়ুন, মহান আল্লাহ অবশ্যই আপনাকে বিপদমুক্ত রাখবেন। কেউ কেউ বলছেন, স্বপ্নে করোনা ভাইরাসের প্রতিষেধক পেয়েছেন এবং শুধু মুসলমানদেরকে তারা এটি দিবেন। আর ওেই ঔষধ দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে সেবন করলে রোগমুক্তি হয়ে যাবে।

কেউ কেউ বলছেন, তাকদীরে বা ভাগ্যে থাকলে একশ হাত মাটির নীচে গেলেও আক্রান্ত হতে হবে। ভাগ্যে না থাকলে কিছুই হবে না। এমনকি যারা বলছেন, ‘এই নিন করোনা ভাইরাসের দোয়া’- তারাও কৌশলগত মিথ্যাচার করছেন।

কারণ, করোনা ভাইরাসের জন্য আলাদা কোন দোয়া নেই। আছে কেবল যে কোন ধরনের মহামারি থেকে আল্লাহর কাছে মুক্তি চাওয়ার দোয়া; কিন্তু ওই দোয়া পড়লেই মহামারি থেকে বেঁচে যাওয়া যাবে, আর দোয়া পড়তে পড়তে মহামারি আক্রান্ত এলাকায় ঢুকে গেলে বা আক্রান্ত ব্যাক্তির কাছে গেলেও কিছু হবে না এমনটি কোথাও বলা হয়নি।

এ ধরনের মেডিক্যাল ও ধর্মীয় বক্তব্যসমূহ মানুষকে ভুলভাবে আত্মবিশ্বাসী করে তুলছে। যার ফলে সমূদ্র সৈকত ও অন্যান্য বিনোদন কেন্দ্রসহ বাজারে, মসজিদে, দোকানে কোথাও জনসেচেতনতার আশানুরূপ লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

অনেকে দোয়া পড়ে বাইরে বেড়িয়ে পড়ছেন। যে কারণে, সারা বিশ্ব যখন সতর্কতামূলকভাবে সমস্ত পাবলিক ফাংশন বন্ধ করে দিচ্ছে, এমনকি সৌদি সরকার মক্কা ও মদিনার দুটি মসজিদ ব্যতীত সকল মসজিদে নামাজ বন্ধ ঘোষণা করেছে, তখনও বেশিরভাগ মানুষ এটাকে কোন সিরিয়াস বিষয় হিসেবে দেখছে না।

এমনকি, সরকার যখন ভাইরাস ঠেকাতে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছে, মানুষ তখনও ঘরে না থেকে বাইরে গিয়ে ছুটি উপভোগ করতে শুরু করেছে। গ্রামাঞ্চলে অবস্থা আরও খারাপ, অনেকে এসব ভুল ওয়াজ ও ব্যাখ্যা শুনে এতটাই আত্মবিশ্বাসী যে, তারা মনে করে এ ভাইরাস মুসলমানদের কোনো ক্ষতি করবে না। এটা অমুসলিমদের শায়েস্তা করার জন্য আল্লাহর দেয়া গজব।

দুর্যোগের সময় ডাক্তারদের পরামর্শকে উপেক্ষা করা এবং ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে মানুষকে মহামারির বিষয়ে উদাসীন করা দুটোই ইসলামিক ধারা বা নির্দেশনার পরিপন্থী। এটা বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর দেখানো পথ বা ইসলামিক ধারা নয়। জীবন চলার পথে আমাদের আদর্শ বা মডেল হচ্ছেন বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব, শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)। তাঁর জীবনধারাই হচ্ছে আমাদের জন্য প্রকৃত মুক্তির পথ।

অনেক সময় ভুল পথগুলো এত আকর্ষণীয় করে উপস্থাপন করা হয় যে, সেগুলোকেই সঠিক মনে হয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের জানা জরুরি মহামারি বিষয়ে ইসলামিক ধারা বা রাসুল (সাঃ) এর আদর্শ কী?

সহীহ মুসলিমে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘মহামারি হচ্ছে আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে শাস্তি অথবা ধমকস্বরূপ। আল্লাহ তা’আলা বনী ইসরাইলের একটি দলের উপর অথবা তোমাদের পূর্ববর্তী কিছু লোকের উপর এমন শাস্তি নিপতিত করেছিলেন। তাই যখন কোনো স্থানে মহামারির কথা শুনতে পাবে, সেখানে যাবে না। আর যদি তা তোমাদের কাছে চলে আসে তবে তা থেকে পালিয়ে যাবে না।’

এই হাদীস থেকে স্পষ্ট হয় যে, যারা মহামারি আক্রান্ত এলাকা থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আসছেন এবং যারা মহামারি ছড়িয়ে পড়ার আশংকা আছে জেনেও সতর্ক হচ্ছেন না, বরং অরক্ষিত অবস্থায় বাইরে বেড়িয়ে পড়ছেন, তারা উভয়ে ইসলামের এই নির্দেশনাকে অমান্য করছেন।

এসব ক্ষেত্রে অনেকে তাকদীরকে (ভাগ্য) ঢাল হিসেবেও ব্যবহার করতে আগ্রহী। অথচ তাকদীরের জ্ঞান আমাদেরকে রাসুলই (সাঃ) দিয়েছেন এবং তিনি মহামারির ক্ষেত্রে তাকদীরকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেননি। বরং তিনি মহামারি এলাকা থেকে আগমন এবং মহামারি এলাকায় গমন দুটোকেই নিষেধ করে দিয়েছেন।

বর্তমান সময়ে চিকিৎসকরাও করোনা মহামারি ছড়ানো বন্ধ করতে মানুষের চলাচলকে সীমিত বা বন্ধ রাখতে বলছেন। যেহেতু এটা চিকিৎসকদের কথা, তাই এটাকে অনেক ধর্মপ্রাণ মানুষ অবহেলার চোখে দেখছেন। অথচ রাসুলও (সাঃ) একই ধরনের কথা বলে গিয়েছিলেন। তিনি মহামারির এলাকা থেকে চলে আসা এবং মহামারির দিকে যাওয়া- উভয়কেই কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন।

ডাক্তারদের থেকে চিকিৎসা ও পরামর্শ নেয়াও রাসুল (সঃ) এর সুন্নাত। রাসুল (সাঃ) সে সময়কার ডাক্তারদের থেকে চিকিৎসা নিতেন, তিনি সিঙ্গা লাগাতেন। সুরা ফাতিহার অপর নাম সুরাতুশ শেফা বা রোগমুক্তির সুরা। কেউ কেউ এটাকে অযুহাত হিসেবে কাজে লাগিয়ে ডাক্তারি চিকিৎসা না নিতে জনগনকে আগ্রহী করে তুলছেন।

অথচ এটাও রাসুলের (সঃ) নির্দেশনা নয়। রোগ-ব্যাধির ক্ষেত্রে রাসুলের (সঃ) আদর্শ হচ্ছে- ডাক্তারের পরামর্শ ও চিকিৎসা নিতে হবে এবং সাথে সাথে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। এ জন্য সুরা ফাতিহা ও এই দোয়াটির কথাও রাসুল (সাঃ) বলেছেন। দোয়াটি হচ্ছে (اَللَّهُمَّ اِنِّىْ اَعُوْذُ بِكَ مِنَ الْبَرَصِ وَ الْجُنُوْنِ وَ الْجُذَامِ وَمِنْ سَىِّءِ الْاَسْقَامِ)। অর্থ্যাৎঃ হে আল্লাহ, আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাই শ্বেত রোগ, পাগলামি, কুষ্ঠ রোগ এবং জানা-অজানা সকল প্রকার দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে।

করোনা ভাইরাস থেকে বাঁচতে হলে আমাদের এখন থেকেই রাসুলের (সঃ) ঐতিহ্য মেনে চলতে শুরু করা উচিৎ। আর এ ক্ষেত্রে রাসুলের ঐতিহ্য হচ্ছে তিনটি।

এক, যখন কোনো স্থানে মহামারির কথা শুনতে পাবে তখন সেখানে যাবে না। রাসুলের এ বাণীর বাস্তবায়ন করা খুবই জরুরি। বর্তমান পরিস্থিতিতে যেহেতু জনসমাগম মহামারি ছড়াতে সাহায্য করে তাই যতদূর সম্ভব ঘরে অবস্থান করা। পরিবারের বাইরে কারো সাথেই যথাযথ সাবধানতা ছাড়া মেশা যাবে না।

দুই, যদি মহামারি তোমাদের কাছে চলে আসে তবে তা থেকে পালিয়ে যাবে না। রাসুলের (সঃ) এই নির্দেশ-এর বাস্তবায়ন। অর্থাৎ আক্রান্ত এলাকার মানুষ ভাল এলাকায় চলে যাবে না এবং যে বা যাদের ভাইরাস আছে তারা সুস্থ মানুষের কাছে যাবে না। আক্রান্ত নিজে সুস্থ মানুষদের রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বন করবেন।

তিন, রাসুলের নিজে করে দেখানো আমল। তা হচ্ছে, অসুস্থ হলে পেশাদার চিকিসকের চিকিৎসা গ্রহণ করা এবং সুরা ফাতেহা ও অন্য দোয়ার মাধ্যমে আল্লাহর ক্ষমা ও সাহায্য চাওয়া। অর্থাৎ কেউ আক্রান্ত হলে কোন অযুহাতেই তা গোপন না করা যাবে না, আল্লাহর অভিশাপ ভেবে হতাশ না হয়ে চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে।

আশা করা যায়, আমরা যদি রাসুলের (সঃ) এ তিনটি নির্দেশনাকে মেনে চলি, তাহলে যে কোনো মহামারির হাত থেকে বেঁচে যেতে পারবো।

এই তিনটি নির্দেশনাকে সহজ ও সংক্ষেপ করলে যা দাঁড়ায় তা হচ্ছে, সুস্থ থাকার জন্য সবসময়ই চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলতে হবে। সে সাথে রোগ-বালাই থেকে বেঁচে থাকার জন্য আল্লাহর রাসুলেল (সঃ) এর শেখানো দোয়াটিও পড়তে হবে। তবে শুধুমাত্র দোয়ার ওপর নির্ভর না করে, আক্রান্ত হয়ে গেলে চিকিৎসাও গ্রহণ করতে হবে এবং তার সাথে সুরা ফাতিহাকে সংযুক্ত রাখতে হবে।

দৈনন্দিন জীবনে রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর আদর্শ কতটা জরুরি, তা যেন করোনা ভাইরাস আমাদেরকে আরেকবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। যেমন, সর্বদা পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা, হাঁচি-কাশি, হাই দেয়ার সময় মুখের সামনে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা, খাওয়ার আগে ভাল করে হাত-মুখ ধুয়ে নেয়া, কোনো খাবারপাত্রে নিঃশ্বাস না ফেলা এবং তাতে ফুঁক না দেয়া, যেখানে সেখানে থুথু, কম ও মল-মূত্র ত্যাগ না করা, অলসতা না করা, পরিশ্রমী হওয়া, কাউকে ধোঁকা না দেয়া, কারো সাথে প্রতারণা না করা, কাউকে উপহাস না করা, মিথ্যা না বলা, ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চাওয়া, সবার সাথে সুন্দর আচরণ করা এ সবই রাসুলের (সঃ) আদর্শ। পৃথিবীবাসী রাসুলের (সঃ) এ সকল আদর্শ ও পরামর্শ থেকে যত বেশি দুরে যাবে তারা তত বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে পড়বে।

সবশেষে বলতে হয়, কেবল রাসুলের (সঃ) দেখানো পথ অনুসরণ করেই আমরা করোনা ভাইরাসসহ সকল মহামারি থেকে মুক্তি পেতে পারি। সবাই ভাল থাকুন, নিরাপদে থাকুন এবং অন্যকে নিরাপদে থাকতে দিন। যারা মেনে চলে এবং যারা চলে না কেউ কাউকে উপহাস-তিরস্কার না করে শান্তিপূর্ণভাবে বোঝানোর চেষ্টা করুন। এটাই হচ্ছে রাসুল (সঃ) এর দেখানো সঠিক পথ।

লেখক : কামরুজ্জামান
সহকারী অধ্যাপক (ইসলামিক স্টাডিজ)
বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।