প্রকাশিত : ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ০১:৩৮
পড়াশোনার পাশাপাশি বিচিত্র পেশা কুঁচিয়া শিকারেই তাদের জীবিকা
উপজেলা সংবাদদাতা, রায়গঞ্জ, সিরাজগঞ্জঃ
সাগর কুমার উরাও ( ১৭)। পড়াশোনার পাশাপাশি নেমে পড়েছেন বিচিত্র পেশা কুঁচিয়া শিকারে। সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার শালিয়াগাড়ি এলাকায় গেলে দেখা হয় তার সঙ্গে। মাছ ধরার চাঁইয়ের মতো অনেকগুলো খাঁচা নিয়ে কাজ তিনি। কাছে যেতেই দেখা যায়, সেগুলো বাঁশ ও বেতের তৈরি এক ধরনের বিশেষ মাছ ধরার ফাঁদ। যা কোনো কোনো অঞ্চলে রুহুঙ্গা নামে পরিচিত। মাছ ধরার বিশেষ এ ফাঁদ দিয়ে শিকার করা হয় কুঁচিয়া। অঞ্চল ভেদে কুঁচিয়া শিকারের এ ফাঁদটি অনেকে ‘ওকা’ নামেও চিনে। রুহুঙ্গা বা ওকা দিয়ে কুঁচিয়া শিকার খুবই সহজ। আর কুঁচিয়া শিকার করেই সংসার চালাচ্ছেন সাগর কুমার উরাও এর মতো অনেকেই।
পরিবারে সহযোগিতা করতে নেমে পড়েন বিচিত্র পেশা কুঁচিয়া শিকারে। তাই জেলার তাড়াশ উপজেলার দেওঘর গ্রাম ছেড়ে কুঁচিয়া শিকারের জন্য চলে আসেন সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জে। এখানে এসে শুরু করেন কুঁচিয়া শিকার। সাতসকালেই উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় রুহুঙ্গা নিয়ে ছুটে চলেন। পুকুর কিংবা ডোবা নালায় কেঁচো গেঁথে রেখে দেন রুহুঙ্গা। পরের দিন সকালে তোলেন। দিনে ৫০ থেকে ৬০টি রুহুঙ্গা থেকে পাঁচ থেকে ছয় কেজি কুঁচিয়া শিকার করেন। এরপর সিরাজগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলার পাইকারদের কাছে ৩০০ টাকা দরে কুঁচিয়া বিক্রি করেন। এভাবেই এখন সংসার চালাচ্ছেন তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নভেম্বর থেকে জুন পর্যন্ত কুঁচিয়া শিকারের উপযুক্ত সময়। ফলইয়ের ভেতরে সরু বাঁশের কাঠিতে কেঁচোর টোপ লাগিয়ে ডোবা, পুকুর কিংবা খালে রাখলেই ধরা পড়ে কুঁচিয়া। একজন শিকারি দিনে পাঁচ থেকে ছয় কেজি কুঁচিয়া ধরে থাকেন।
একই এলাকার অজয় কুমার উরাও বলেন, ‘তিনিও বিভিন্ন স্থানে কুঁচিয়া ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। পড়াশোনার পাশাপাশি পরিবারের খরচ জোগাড় করতেই কুঁচিয়া শিকার শুরু করেন। বর্তমানে দিনে গড়ে পাঁচ কেজি কুঁচিয়া ধরেন। অন্য পেশার চেয়ে এ পেশায় ভালো আয় হচ্ছে বলে জানান তিনি।’ তিনি আরও বলেন, ‘একসময় গ্রামের কেউ কুঁচিয়া শিকার করতেন না। কুঁচিয়ার বিদেশে অনেক চাহিদা তাই এর দামও অনেক বেশি। এখন আমাদের গ্রামের অনেকেই কুঁচিয়া শিকার করে সংসার চালায়।’
কুঁচিয়া ধরার কৌশল সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রসেনজিৎ উরাও বলেন, হাট থেকে ৮০ টাকা দরে রুহুঙ্গা কিনেন। এরপর সেগুলোতে কেঁচোর টোপ দিয়ে পুকুর ডোবা, ধানের ক্ষেত কিংবা খালে রেখে দেন। পরের দিন সকাল বেলা সেগুলো তুলেন। এতেই আটকা পড়ে কুঁচিয়া। নরম মাটিতে কুঁচিয়া শিকার করা খুবই সহজ। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ৪০ থেকে ৫০টা রুহুঙ্গায় কেঁচোর টোপ দিয়ে রাখেন। সবগুলোয় না পড়লেও বেশির ভাগ রুহুঙ্গায় ধরা পড়ে কুঁচিয়া। কুঁচিয়া সংগ্রহের পর এগুলো একটা ড্রামের মধ্যে পানিতে রাখেন। এরপর কুঁচিয়া প্রতি সপ্তাহে সিরাজগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলায় পাঠিয়ে দেন। প্রতি কেজি ৩০০ টাকা ধরে বিক্রি করে থাকেন। তবে এক শ্রেণির মধ্যস্বত্বভোগী ফড়িয়ারা বাড়িতে এসে কম দামেও কিনে নেন এসব কুঁচিয়া। এতে ন্যায্যমূল্য বঞ্চিত হচ্ছেন কুঁচিয়া শিকারিরা।
জেলার উল্লাপাড়া উপজেলার হাটিকুমরুলে অবস্থিত আড়ত মালিকরা বলেন, ‘একসময় কুঁচিয়া শিকার করতেন না কেউ। অল্প খরচে পুকুর কিংবা খাল থেকে কুঁচিয়া শিকার করা সম্ভব। তাই এখন প্রত্যন্ত এলাকা থেকে কুঁচিয়া শিকার করে আমাদের কাছে বিক্রির জন্য নিয়ে আসেন। বিদেশে এর চাহিদা থাকায় দামও বেশ ভালো। অনেকেই কুঁচিয়া শিকার করে সংসার চালাচ্ছেন।’
রায়গঞ্জ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা ড. মো. হাফিজুর রহমান বলেন, ‘প্রাকৃতিকভাবে জলাশয়, ডোবা বা পুকুরে প্রচুর কুঁচিয়া জন্মায়। বিদেশে এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। আর এসব কুঁচিয়া শিকার অনেকেই জীবিকা নির্বাহ করছেন। এতে বেকারত্ব দূর করাও সম্ভব।’