প্রকাশিত : ২ মার্চ, ২০১৯ ১৯:৪১

প্রতারক চক্রের সাংগঠনিক কাঠামো যেমন

অনলাইন ডেস্ক
প্রতারক চক্রের সাংগঠনিক কাঠামো যেমন

অবসরপ্রাপ্ত সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবী ও বড় ব্যবসায়ীদের টার্গেট বানিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে গত ১৫ বছরে আনুমানিক ১০০ কোটির বেশি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে একটি প্রতারক চক্র। মূলত টার্গেট ব্যক্তিদের অধিক মুনাফার লোভ দেখিয়ে মাল্টি-ন্যাশনাল কোম্পানির শেয়ার হোল্ডার বানানোর নামে বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাৎ করেন তারা।

এই প্রতারক চক্রের প্রতিটি সদস্য প্রতারণাকেই তাদের মূল পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছে। আর প্রতারণা করতে তারা নিজেদের একটি সংগঠন বানিয়েছে। তাদের এ সংগঠনের একটি সুনির্দিষ্ট সাংগঠনিক কাঠামোও রয়েছে। যে সংগঠনটি শুধুমাত্র প্রতারক চক্র গ্রুপের সদস্যদের মধ্যে RCD (Royal Cheater Development) নামে পরিচিত।

আজ শনিবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান।

মুফতি মাহমুদ খান বলেন, গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে আজ শনিবার সকাল ৭টা পর্যন্ত র‌্যাব-৪ এর একটি দল রাজধানীর মিরপুর, দারুস সালাম, উত্তরা ও রামপুরা এলাকায় অভিযান চালায়। এ সময় বিপুল পরিমাণ ভুয়া নথিপত্র ও সরঞ্জাম জব্দসহ চক্রের ২২ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়।

প্রতারক চক্রের সাংগঠনিক কাঠামো যেমন-  

র‌্যাবের এক কর্মকর্তা জানান, গ্রেপ্তারকৃত প্রতারক চক্রের নিজস্ব একটি সাংগঠনিক কাঠামো রয়েছে। কাঠামো অনুযায়ী চক্রের সদস্যরা নিজেদেরকে বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত করে। তাদের এক একটি গ্রুপে সাধারণত ৫টি স্তরের সদস্য থাকে।

সাব-ব্রোকার

সাব-ব্রোকার প্রতারক চক্রটির মাঠ পর্যায়ের কর্মচারী। সে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে টার্গেট, ভিকটিম বা গ্রাহক চিহ্নিত করে। এক্ষেত্রে সদ্য অবসরপ্রাপ্ত সরকারি-বেসরকারি কর্মচারী, কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী, আর্থিকভাবে স্বচ্ছল ব্যক্তিবর্গ, প্রচুর জমিজমার মালিকদেরকে লক্ষ্য করে কার্যক্রম শুরু করেন ওই সাব-ব্রোকার। সাব-ব্রোকার টার্গেট করা ব্যক্তির সকল তথ্যগুলো ব্রোকারকে জানায়।

ব্রোকার

সাব-ব্রোকারের নিকট থেকে প্রাপ্ত তথ্য যাচাই-বাছাই করার জন্য ব্রোকার নিজেই টার্গেট ব্যক্তির কাছে গিয়ে প্রথমে পরিচিত হয়। এরপর তাদেরকে ব্যবসা সম্পর্কে লোভনীয় অফার দিয়ে প্রলুব্ধ করেন। তাদের এমন সাজানো লোভনীয় অফারে যদি কেউ রাজি হয়, তখন ওই ব্রোকার সেই টার্গেট ব্যক্তিকে প্রধান কার্যালয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য মোবাইল নম্বর দিয়ে চলে আসেন। অনেক ক্ষেত্রে তাদেরকে অফিসে নিয়ে আসার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও তিনিই করেন।

ম্যানেজার

টার্গেট ব্যক্তিকে অফিসে নিয়ে আসার পর ম্যানেজার নামে যে প্রতারক অফিসে থাকেন, তিনি ওই টার্গেট ব্যক্তিকে আপ্যায়ন ও সৌহার্দপূর্ণ আচার-আচরণের মাধ্যমে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেন এবং বিভিন্ন প্রকার লোভনীয় অফার প্রদান করেন।

চেয়ারম্যান (অফিস প্রধান)

টার্গেট ব্যক্তি যদি তাদের সব কিছু শুনে লোভের বসে রাজি হয়ে যায়, তখন তাকে  তাদের ভুয়া চেয়ারম্যানের সাথে দেখা করায় ম্যানেজার। এরপর ম্যানেজার ও চেয়ারম্যান মিলে বিভিন্ন ভুয়া চুক্তিপত্র তৈরি এবং তাতে উভয়পক্ষ সাক্ষর করে। ভুয়া চুক্তিপত্র শেষে প্রতারক চক্রের সদস্যরা প্রতিষ্ঠানের বস সংক্রান্তে বিভিন্ন আলাপ-আলোচনা করে টার্গেট ব্যক্তির মনে বস সংক্রান্ত ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টি করে।

বস

বস প্রতারণা চক্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। বস সাধারণত বিদেশি নাগরিক হিসেবে নিজেকে পরিচয় দেয়। তিনি বিভিন্ন দেশের নামীদামী কোন কোম্পানি বা গ্রুপের কান্ট্রি ম্যানেজার হিসেবে নিজেকে পরিচিত করেন। বসের মাসিক বেতন  ৫ হাজার ডলারের উপরে বলে জানানো হয় টার্গেট। সেই ভুয়া বিদেশি বসের সাথে টার্গেট ব্যক্তির পরিচয়ের পরে প্রতারক চক্রের অন্যান্য সদস্যরা মিলে বসের সাথে রয়েল কিং প্লে (তাস) খেলার প্রস্তাব দেয় টার্গেট ব্যক্তিকে। এই রয়েল কিং প্লে (তাস) খেলতে বস রাজি এবং টার্গেট ব্যক্তি রাজি হয়। খেলার একপর্যায়ে টার্গেট ব্যক্তির কাছে থেকে তাস খেলার মাধ্যমে নানা কৌশলে প্রতারণাপূর্বক অর্থ আত্মসাৎ করে।

যেসব কৌশলে সর্বস্ব হারায় টার্গেট ব্যক্তিরা

RCD নামে এই প্রতারক চক্রের সদস্যদরা  মূলত পাঁচটি কৌশলে কাজ করে। কৌশলগুলো সম্পর্কে র‌্যাব জানায়, 

কৌশল নং-০১ প্রতারণার কৌশল হিসেবে প্রতারক চক্র সদ্য অবসরপ্রাপ্ত সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তাদের অবসরের আগে থেকেই টার্গেট করে ফেলেন। প্রতারক চক্র তাদের কোম্পানিতে উক্ত কর্মকর্তাদের উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগের প্রলোভন দেখিয়ে তাদের অফিসে নিয়ে আসে। অবসরের টাকা পাওয়ার পরপরই প্রতারক চক্রের একটি বিশেষায়িত দল তাদের সাথে যোগাযোগ করে উচ্চ বেতনের চাকুরিতে নিয়োগ প্রদান করে। দামি ব্র্যান্ডের গাড়িতে অফিসে আনা-নেয়ার একপর্যায়ে ওই প্রতিষ্ঠান বা সহযোগী কোনো প্রতিষ্ঠানের শেয়ার হোল্ডার হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করে। অফিস কর্মকর্তাদের চালচলন, ব্যবহার ইত্যাদিতে অভিভূত হয়ে ওই কর্মকর্তাগণ তাদের অবসরকালীন প্রাপ্ত সমুদয় টাকা সরল বিশ্বাসে বিনিয়োগ করে এবং বিনিয়োগের কয়েক দিনের মধ্যেই উক্ত অফিস এবং অফিস কর্মকর্তারা উধাও হয়ে যায়।

কৌশল নং-২  দেশের বিভিন্ন এলাকার তাঁত ব্যবাসার সাথে জড়িত ব্যবসায়ীদেরকে কয়েক কোটি টাকার অর্ডারের ফাঁদে ফেলা হয়। প্রথমে একজন ব্রোকার তাঁত ব্যবসায়ীকে জানান যে, তার পক্ষে কয়েক কোটি টাকার মাল সরবরাহ করা সম্ভব কিনা? সম্ভব হলে বিভিন্ন কাপড়ের নমুনা দেখাতে বলেন। তাঁতের সামগ্রী বিদেশে পাঠানো হবে এবং একই সাথে বড় অংকের অর্ডারের জন্য তাঁত ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ৪০-৫০ হাজার টাকার স্যাম্পল নেয়া হয়। এরপর তাদের বস এসে কথা বলেন এবং একপর্যায়ে প্রতারক চক্রটি জানায়, কয়েক কোটি টাকার মালামাল তৈরিতে যে পরিমাণ কাঁচামাল প্রয়োজন (সুতা, রং ইত্যাদি) তা বসের মাধ্যমে ফ্যাক্টরি থেকে কম দামে তারা সরবরাহ করতে পারবে। এই বিষয়গুলো লিখিত চুক্তিপত্র তৈরি করে তারা টার্গেট ব্যক্তির বিশ্বস্ততা অর্জন করে। সেক্ষেত্রে প্রতারক চক্র টার্গেট ব্যক্তিকে মোট টাকার একটি অংশ অগ্রিম প্রদান করার জন্য বলে। অগ্রিম টাকা দেওয়ার পরপরই ওই চক্রটি উধাও হয়ে যায়। তাদের মোবাইল ফোনগুলি বন্ধ হয়ে যায় এবং তাদের সাথে কোনভাবেই যোগাযোগ করা সম্ভব হয় না।

কৌশল নং-৩  ঢাকার বাইরে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় আর্থিকভাবে স্বচ্ছল ব্যক্তিদের জমি বা নির্মাণাধীন ভবনের উপর ইন্টারনেট টাওয়ার স্থাপনের প্রলোভন দিয়ে প্রতারক চক্রটি টার্গেট ব্যক্তিদেরকে একটি অফিসিয়াল চিঠি প্রদান করে। এরপর তাদেরকে বস এর সাথে কথা বলার জন্য মোবাইল নম্বর দিয়ে আসেন। এক্ষেত্রে জেবি ইন্টারনেট টাওয়ার (জাপান-বাংলাদেশ), জেবি শিপ ব্রেকার্স, নাহার এন্টারপ্রাইজ, অন্যদা গ্রুপ, এএইচ ইলেকট্রনিক্স, আল-বারাকা ইন্টারন্টে স্পিড (অইওঝ), ব্রাদার্স ইন্টারনেট ইত্যাদি ভূয়া কোম্পানির নাম ব্যবহার করা হয়। ভবন বর্ধিতকরণ এবং টাওয়ার নির্মাণ বাবদ খরচের জন্য ৪০-৫০ লাখ টাকা এবং মাসিক ভাড়া হিসেবে প্রতি মাসে আরো ৪০-৫০ হাজার টাকার চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য তাদেরকে ঢাকায় হেড অফিসে আসার জন্য বলা হয়। জাকজমকপূর্ণ হেড অফিসের বস এর সাথে কথা বলার সময় হঠাৎ বিদেশি একজন ব্যবসায়ীর আগমন ঘটে সেখানে। তিনি মূলত বস নামেই পরিচিত। তখন বসের সাথে আবারও সেই রয়েল কিং প্লে (তাস) খেলার একপর্যায়ে টার্গেট ব্যক্তির কাছে থেকে নানা কৌশলে প্রতারণাপূর্বক অর্থ আত্মসাৎ করে।

কৌশল নং-৪  ঢাকার বাইরে বিভিন্ন এলাকায় আর্থিকভাবে স্বচ্ছল ব্যক্তিদের বাসায় এবং তার এলাকার মাদ্রাসা, মসজিদে এনজিও এর পক্ষ থেকে বিনা খরচে সৌর প্যানেল বসানোর কথা বলে আগ্রহী করে তোলেন টার্গেট ব্যক্তিদের। এরপর প্রতারক চক্রটি টার্গেট বক্তিকে তাদেরকে বস এর সাথে কথা বলার জন্য মোবাইল নম্বর দিয়ে আসে। আবারও অনেক সময় সাথে করে ভিকটিমদের হেড অফিসে নিয়ে আসে। অফিসে নিয়ে আসার পর পূর্বেই ন্যায় তাস খেলার মাধ্যমে ভিকটিমকে প্রলুব্ধ করে সর্বস্বান্ত করা হয়।

কৌশল নং-৫  ইট, পাথর, রড,সিমেন্ট, গার্মেন্টস, চাল, থাই,এ্যালুমিনিয়াম, সোলার প্যানেল ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন পেশার লোকদের টার্গেট বানিয়ে তাদেরকে বিপুল পরিমাণ অর্থের অর্ডারের ফাঁদে ফেলা হয়। অর্ডারের চুক্তিপত্র সম্পন্ন করার জন্য ভিকটিম বা ওই টার্গেট ব্যবসায়ীকে প্রতারক চক্রের অফিসে নিয়ে আসা হয়। আর অফিসে নিয়ে আসার পরে তাস খেলার ফাঁদে ফেলে তার কাছে থেকে বড় অংকের টাকা প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নেয়া হয়।

টাকা হাতিয়ে নেওয়া রয়েল কিং প্লে টি (তাস খেলা) যেমন-

র‌্যাব সূত্রে জানা যায়, বিদেশি সেই ভুয়া বস বা ভুয়া বড় ব্যবসায়ীর সাথে সকল টার্গেট ব্যক্তিদের রয়েল কিং প্লে তাস খেলতে প্রলুব্ধ করেন প্রতারক চক্রের অন্য সদস্যরা।

টার্গেট ব্যক্তিকে বলা হয় যে, তাস খেলে ওই বিদেশিকে বসকে বা ব্যক্তিকে হারিয়ে দিতে পারলে অনেক টাকা পাওয়া যাবে। প্রতারক চক্রের সদস্যরা নিজেরাও টার্গেট ওই ব্যক্তির সামনেই তাস খেলা শুরু করেন। আর খেলায় ইচ্ছাকৃতভাবে ভুয়া বিদেশি ব্যবসায়ী বা বস বার বার হারতে থাকেন। বসের হারের টাকার অংকটি কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। তখন প্রতারক চক্রের সদস্যরা আবারও টার্গেট ওই ব্যক্তিকে বিদেশির সাথে তাস খেলতে প্রলুব্ধ করেন।

খেলার এক পর্যায়ে সুকৌশলে প্রতারক চক্রের সদস্যরা লাল গিলাপে প্যাঁচানো পবিত্র কোরআন শরীফ (যা প্রকৃতপক্ষে একটি ডায়েরি/বই) এর উপরে হাতে হাত রেখে টার্গেট ব্যক্তিসহ সবাইকে প্রতিজ্ঞা করায় যে, ‘আমরা সবাই ভাই ভাই। আমরা আমাদের এ খেলার কথা কাউকে বলবো না এবং কাউকে সাথে করে আনব না।’

এসবের পরেও যদি টার্গেট ব্যক্তি খেলতে না রাজি হয় বা খেলতে না পারে, তবুও সমস্যা নেই। টার্গেট ওই ব্যক্তিকে টাকা দিয়ে খেলায় অংশগ্রহণ করার জন্য বলে প্রতারক চক্রের সদস্যরা। তাস খেলে কোটি কোটি টাকা হারার পর ওই ভুয়া বিদেশি ব্যবসায়ী বা বস বলেন যে, আপনাদেরকে আমি টাকা দিয়ে দেব কিন্তু আপনাদেরকেও একই পরিমাণ টাকা দেখাতে হবে। সে সময় চার জনের দল টাকার অংক নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেন এবং টার্গেট ব্যক্তিকে নানা কৌশলে আরো বেশি টাকা আনার জন্য উদ্বুদ্ধ করেন। টার্গেট ব্যক্তিকে এটা বোঝানো হয় যে, ১৫ থেকে ২০ লাখ ক্যাশ টাকা আনলেই তাকে বিদেশি ব্যবসায়ীর কাছ থেকে তাস খেলে জেতা ৫০ থেকে ৬০ লাখ টাকা দেয়া হবে। এমন পরিস্থিতিতে মূল টাওয়ারের চুক্তির কথা ভুলে গিয়ে লোভে পড়ে অনেক টার্গেট ব্যক্তিরা ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা বিভিন্নভাবে জোগাড় করে নিয়ে আসেন। কিন্তু তাদের হাতে টাকা তুলে দেওয়ার পরের দিনই বাসা পরিবর্তন করে পালিয়ে যায় প্রতারক চক্রের সদস্যরা।

উপরে