প্রকাশিত : ৬ মে, ২০১৯ ১৬:৩২

নন্দীগ্রামে শত বাধা ডিঙ্গিয়ে ওরা পাঁচ জয়িতা

নন্দীগ্রাম (বগুড়া) থেকে মো: ফজলুর রহমান
নন্দীগ্রামে শত বাধা ডিঙ্গিয়ে ওরা পাঁচ জয়িতা
বাম হতে জাকিয়া নাজনীন, মোমেনা বেগম, রোজিনা বেগম, খালেদা বেগম ও হাসিনা বেগম। ছবি: চাঁদনী বাজার

বগুড়ার নন্দীগ্রাম উপজেলা মহিলা বিষয়ক অফিসের আয়োজনে জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ শীর্ষক কার্যক্রমের আওতায় ৫ ক্যাটাগরীতে পাঁচ সংগ্রামী সফল নারী নির্বাচিত হয়েছেন। তারা এখন সমাজের নিপীড়িত নির্যাতিত ও অধিকার বঞ্চিত মানুষের কল্যাণে কাজ করছেন। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে নন্দীগ্রাম মহিলা বিষয়ক অফিসের আয়োজনে ও উপজেলা প্রশাসনের সহযোগীতায় আন্তজার্তিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ এবং বেগম রোকেয়া দিবস-২০১৮ উদযাপনে জয়িতা অন্মেষণে বাংলাদেশ কার্যক্রমের যাচাই-বাছাই শেষে পাঁচজন নারীকে উপজেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ জয়িতা নির্বাচিত করা হয়। এরা হলেন- সফল জননী নারী উপজেলার বৃকষ্ণি গ্রামের আইয়ুব আলী শেখের স্ত্রী মোছা: মোমেনা বেগম। তার স্বামী একজন মৎস্য শ্রমিক, পুকুরে মাছ তোলার কাজ করতো। কিন্তু সব সময় কাজ করতো না। একটি মাত্র সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ করার জন্য মোমেনা বেগম রাতে কাঁথা সেলাই ও দিনে কঠোর পরিশ্রম করতো। তাঁর ছেলে মোখলেছুর রহমান ছোট বেলা থেকেই পড়ালেখায় মনোযোগী ছিলেন। সে পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণীতে বৃত্তি পেয়েছে এবং এসএসসি ও এইচএসসিতে গোল্ডেন প্লাস পায়। এরপরে সে বুয়েট ভর্তি হয়। বিভিন্ন ব্যাংক থেকেও তাঁর ছেলে বৃত্তি পেয়েছেন। বুয়েট থেকে পাস করার পর এমএস করার জন্য অষ্ট্রোলিয়ায় যান। সেখান থেকে এসে খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। বর্তমানে তিনি পিএইচডি করার জন্য আমেরিকায় আছেন। অনেক কষ্টের ফলে আজ মোমেনা বেগম একজন সফল জননী। শিক্ষা ও চাকুরী ক্ষেত্রে সফল হয়েছেন পৌরসভার দামগাড়া গ্রামের আব্দুল মোমিন উজ্জেলের স্ত্রী মোছা: জাকিয়া নাজনীন একজন আত্মপ্রত্যয়ী নারী। জাকিয়া মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। তাঁর মা কখনো চাইতেন না সে লেখাপড়া করুক। তবুও নিজের ইচ্ছায় সে পড়াশুনা করেন। এসএসসি পাশ করার পরপরই তাঁর বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের পর শ্বশুর বাড়ির লোকজনসহ স্বামী পড়াশুনা বন্ধ করতে বলে। কিন্তু জাকিয়া থেমে থাকে না। পড়াশুনা চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি কেজি স্কুলের শিক্ষিকার চাকুরী শুরু করে। এরমাঝে সে সরকারি আজিজুল হক কলেজ থেকে এমএ পাশ করে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে। হাজারো বাধা বিঘ্ন কাটিয়ে জাকিয়া নাজনীন এখন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করছেন। আর তাঁর এই অদম্যতার জন্য তাকে শিক্ষা ও চাকুরী ক্ষেত্রে সফল হয়েছেন। সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখেছেন: উপজেলার নিনগ্রামের আফসার আলীর স্ত্রী হাসিনা বেগম গরিব কৃষকের কন্যা। তাঁর গরীব বাবা বয়স্ক কৃষকের সাথে তাঁকে বিয়ে দেয়। হাসিনা বেগমের স্বামীর আগেও আরেকটি স্ত্রী ও দুইটা সন্তান রয়েছে। সে প্রথমে ব্র্যাক স্কুলের শিক্ষিকা হিসেবে যোগদেন। নিজে বাড়ি বাড়ি গিয়ে স্কুলের জন্য বাচ্চাদেরকে নিয়ে আসে। এরপর সে ৩০ জন মহিলা নিয়ে একটি সমিতি করে এবং তাদেরকে নিয়ে উঠান বৈঠকের আয়োজন করে। তার সমাজ সেবামূলক কাজে এলাকার লোকজন খুশি হয়ে সংরক্ষিত আসনে সদস্য নির্বাচিত করেন। সমাজ উন্নয়নে গরীবদের সম্পৃক্ত করে সমাজে নারীর গ্রহনযোগ্যতা বৃদ্ধি ও নারী ক্শমতায়নের পথকে সুগম করে তুলেছেন। যার প্রভাবে সমাজ ব্যবস্থায় উন্নয়নের নতুন ধারা সৃষ্টি হয়েছে। তার এইসব কর্মকান্ড বিবেচনায় তাকে সমাজ উন্নয়নে অসামাস্য অবদান রেখেছে যে নারী ক্যাটাগরিতে নির্বাচিত হয়েছে। উপজেলার দাঁতমানিকা গ্রামের মৃত খোরশেদ আলীর স্ত্রী খালেদা বেগম বিবাহিত জীবনের পর থেকেই শারিরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। স্বামী ছিল মাদকাসক্ত যা খালেদা বেগম কোন ভাবেই মেনে নিতে পারেননি। দারিদ্র বিধবা মায়ের কন্যা হওয়ায় স্বামীর যৌতুকের দাবী মেটানো সম্ভব হয় নাই। যার ফলশ্রুতি বিয়ে বিচ্ছেদ হেয় প্রতিপন্নের শিকার হন। কিন্তু খালেদা সমস্ত বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে দু:খ কষ্ট নির্যাতনের কথা ভুলে গিয়ে নতুন উদ্যেমে জবীন শুরু করেছেন। তাই নই বিধবা মাতার আহার সংগ্রহ সহযোগীতা করেছেন, সমাজের সকল নারী এখন খালেদার পরামর্শ গ্রহণ করেন। আর এ সকল কারণে খালেদাকে নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করেছেন। সে জন্য তাঁকে নারী ক্যাটাগরিতে মনোনীত করা হয়েছে। অল্প বয়সে রোজিনার বিয়ে হয় উপজেলার কহুলী গ্রামের বাচ্চু আকন্দের সাথে। বিয়ের কিছুদিন পর থেকেই স্বামী অসুস্থ হয়ে থাকে, ঠিক মতো কাজ করতে পারে না। সংসারে অভাব অনটন লেগেই থাকে। রোজিনার স্বামী সবসময় খারাপ আচারন করে আর বাবার কাছ থেকে টাকা আনতে বলে। রোজিনার বাবার মৃত্যুর পর সে আরও অসহায় হয়ে পরে। তখন সে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে খোঁজখবর নিয়ে গ্রামীন ব্যাংক থেকে লোন নেন। সে লোনের টাকা দিয়ে বাড়িতেই চোট পরিসরে দোকান শুরু করে। বর্তমানে তাঁর দোকান থেকে মাসে প্রায় ২০ হাজার টাকা আয় হয়। তাঁর দুই ছেলে এক মেয়ে। বড় ছেলেকে ফার্ণিচারের দোকান করে দেবে, ছোট ছেলেকে বিদেশ পাঠিয়েছে ও মেয়েকে ভালো ঘরে বিয়ে দিয়েছেন। রোজিনার সংসার এখন স্বচ্ছল। অর্থনৈতিক ভাবে সাফল্য অর্জনকারী হিসেবে সমাজে অন্যান্য নারীদের মাঝে উৎসাহ উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছে। এই পাঁচজন সফল নারী সমাজে অন্যদের অনুকরণীয় হয়ে উঠেছেন। নন্দীগ্রাম উপজেলা জয়ীতা অন্বেষণে কমিটির সদস্য সচিব ও উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা খালেদা ইয়াসমিন জানান, অনেক আবেদনকারীর মধ্যে যাচাই-বাছাই শেষে উপজেলা পর্যায়ে ৫ জন জয়ীতাকে নির্বাচন করা হয়। তিনি আশা করেন উপজেলার পর্যায়ে নির্বাচিত পাঁচজন জয়ীতা আগামী দিনে সমাজ উন্নয়নে আরো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবেন।

উপরে