বগুড়ায় ১০৩ টাকা খরচে পূরণ হলো ২৩৯ জনের পুলিশে চাকরির স্বপ্ন
১০০ টাকার ব্যাংক ড্রাফট আর ৩ টাকার ফরম এই মোট ১০৩ টাকায় পুলিশে চাকরি যা অতীতের ইতিহাসের প্রেক্ষিতে অসম্ভব মনে হলেও গত বছরের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ পুলিশের কন্সটেবল নিয়োগ পরীক্ষায় প্রমাণ করেছে বগুড়া জেলা পুলিশ। কারো মুখে দেশসেবার স্বপ্ন জড়ানো কান্না আবার কারো মুখে পরিবারের সম্বল হিসেবে চাকরি পেয়ে উচ্ছস্বতার হাসি নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে জেলা পুলিশ সুপার আলী আশরাফ ভূঞা বিপিএম (বার) কে ঘিরে একরাশ কৃতজ্ঞতা আর ভালবাসা প্রদানের নানা ভঙ্গিমায় মুখর হয়ে উঠেছিল পুলিশ লাইন্স অডিটোরিয়াম।
টাকা ছাড়া যে অসহায় শতাধিক পরিবারের জীবনযুদ্ধে সংগ্রাম করা ছেলে মেয়েরা সোনার হরিণের মতো এই চাকরি পাবে তা শেষ মূহুর্তেও তারা আন্দাজ করতে পারেনি। বুধবার রাতে বগুড়া পুলিশ লাইন্স অডিটোরিয়ামে পুলিশ ট্রেইনি রিক্রুট কনস্টেবল (টিআরসি) পদে নিয়োগ পরীক্ষা ২০১৯ এর চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণার সময় এই আনন্দঘন এবং স্বপ্নপূরণের একধাপ পূরণের এই ঘটনা আলোড়ন ফেলেছে পুরো বগুড়া জেলায়। জেলা পুলিশ সূত্রে জানা যায়, এবছর বগুড়ার ইতিহাসে স্মরণীয় সংখ্যক মোট ৬ হাজার ৩’শ ২১ জন মাঠে দাঁড়িয়েছিল কন্সটেবল পদে চাকরির জন্য যা সারাদেশের মধ্যে বিশাল একটি সংখ্যা।
প্রাথমিক বাছাই শেষে এর মধ্যে মোট ১ হাজার ৬’শ ৬৫ জন লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিল যার মধ্যে পুলিশ হেডকোয়ার্টারস্ এর সার্বক্ষণিক নজরদারিতে এবং জেলা পুলিশ সুপারের নিয়োগে স্বচ্ছতা নিয়ে জিরো টলারেন্স মাধ্যমে চুলছেড়া যাচাই বাছাই এর মাধ্যমে ৬২৭ জন পরীক্ষার্থীকে ভাইবার জন্য নির্বাচিত করা হয়। সর্বশেষে জেলা পুলিশ সুপার আলী আশরাফ ভূঞা বিপিএম (বার) এর নেতৃত্বে নওঁগার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার লিমন রায় এবং নাটোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মীর আসাদুজ্জামান এর বোর্ডে মৌখিক পরীক্ষায় চূড়ান্তভাবে এই নিয়োগে নির্বাচিত হয় মোট ২৩৯ জন পরীক্ষার্থী।
যার মধ্যে সাধারণ পুরুষ কোঠায় ১২৫ জন, সাধারণ নারী কোঠায় ৭০ জন, মুক্তিযোদ্ধা পুরুষ কোঠায় ৩৬ জন ও নারী কোঠায় ১ জন, পুলিশ পোষ্য কোঠায় পুরুষ ৫ জন ও নারী ১ জন এবং এতিম কোঠায় ১ জন সর্বমোট বগুড়া জেলা পুলিশের এই নিয়োগে পূর্বঘোষিত ২৩৯ জনের নাম চূড়ান্তভাবে ঘোষণা করা হয়। সাথে সাথে রাখাও হয়েছে পরবর্তী যোগ্য প্রার্থীদের অপেক্ষমান তালিকাও। সোনার হরিণের মতো ১০৩ টাকায় এই চাকরি পাওয়া ২৩৯ জনের মাঝে কথা হয়েছিল এতিমখানায় মানুষ হওয়া কোঠায় চাকরি পাওয়া এতিম শিশু ইসমাইল আকন্দের সাথে।
সুখী পরিবারে জন্ম নিয়েও বাবা মারা যাওয়ার পর মাকেও কাছে পায়নি ছোট্ট শিশু ইসমাইল। ছোটতেই তার ঠিকানা হয় জয়পুরহাট সরকারি শিশু পরিবারে পরে পড়াশোনার তাগিদে চলে যেতে হয় সিরাজগঞ্জ শিশু পরিবারে। ইসমাইলরা ২ ভাই যার অপর আরেক ভাইও বর্তমানে এতিমখানাতেই বড় হচ্ছে। তার মতো এই প্রতিবন্ধকতার জীবনে শুধুমাত্র মেধার ভিত্তিতে এই চাকরি এতিম ইসমাইলের কাছে আকাশকুসুম ভাবনার সমান। মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে পেরে জেলা পুলিশের প্রতি তার কৃতজ্ঞতার যেন কোন শেষ নেই। ইসমাইল, গোলাবাড়ির হাসান আলী, শাখারিয়ার মেফতাহুল জান্নাত, তানিয়া খাতুন, বিথী খাতুনসহ অডিটোরিয়ামে থাকা উর্ত্তীণ প্রতিটি প্রার্থীর জীবনের গল্প কিছুটা এমনই যা শুনলে সাধারণ মানুষের জীবনের স্বাভাবিক প্রতিবন্ধকতাকেও হার মানাবে।
গত বছর বগুড়া জেলার পুলিশ সুপার হিসেবে যোগদান করেই বিনা টাকায় ঘোষণা দিয়ে চাকরি প্রদান যার ধারাবাহিকতায় এই বছরও কন্সটেবল পদে শতভাগ স্বচ্ছতার মাধ্যমে নিয়োগের চ্যালেঞ্জ ছিল স্বপ্নবাজ এবং নীতির জায়গায় কঠোর আলী আশরাফ ভূঞা বিপিএম (বার) এর। দালালমুক্ত এবং বিনা টাকায় চাকরির নিশ্চয়তা দিয়ে পুরো জেলাতে সচেতনতার বলয় তৈরি করা হয়েছিল জেলা পুলিশের পক্ষে। সাথে সাথে কয়েক স্তরের নিরাপত্তা নিশ্চিতের মাধ্যমে ধরা হয়েছিল ৪ টি দালাল চক্রকেও। শতভাগ মেধার ভিত্তিতে ও স্বচ্ছতার মধ্য দিয়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্নকরণ শেষে ফলাফল ঘোষণা ও উত্তীর্ণ সকল প্রার্থীদেরকে ফুল দিয়ে বরণ পরবর্তী ১০৩ টাকায় এই চাকরি প্রদানের নিয়োগ পরীক্ষার সার্বিক নেতৃত্বে থাকা জেলা পুলিশ সুপার আলী আশরাফ ভূঞা বিপিএম (বার) বলেন, টাকা ছাড়া পুলিশে চাকরি হবে এটিই অত্যন্ত স্বাভাবিক বিষয়।
অনেক প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে এই নিয়োগে উর্ত্তীণরা সদা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হবে এই প্রত্যাশা ব্যক্ত করে সকলকে ভবিষ্যতের জন্য শুভ কামনা জানান তিনি। সেই সাথে জেলা পুলিশের পক্ষে সকল দালাল চক্রকে রুখে দেওয়ার পরও যারা দালালদের মিথ্যা আশ^াসে টাকা প্রদান করেছে চাকরি পাওয়া বা না পাওয়া প্রার্থীদেরকে দালালদের কাছ থেকে সকল টাকাও তুলে দেওয়ারও নিশ্চয়তা দেন জেলা পুলিশের এই কর্ণধার।
চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণার এই অনুষ্ঠানে জেলা পুলিশের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন পদোন্নতিপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার সফিজুল ইসলাম, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) সনাতন চক্রবর্তী, সহকারী পুলিশ সুপার হেলেনা আক্তার, বগুড়া সদর থানার অফিসার ইনচার্জ এস.এম বদিউজ্জামান সহ অনেকে। উল্লেখ্য আগামী ১৩ জুলাই শনিবার মেডিকেল পরীক্ষার পর উর্ত্তীণ প্রার্থীরা পুলিশের প্রশিক্ষণ গ্রহণ পরবর্তী বাংলাদেশ পুলিশের কন্সটেবল হিসেবে দেশের সেবায় নিয়োজিত হবেন।