প্রকাশিত : ২৬ আগস্ট, ২০১৯ ০৪:৩৪

দিনাজপুরের মোতাহার ওস্তাদ খেলোয়াড় তৈরির কারিগর

মোঃ আফজাল হোসেন দিনাজপুর প্রতিনিধিঃ
দিনাজপুরের মোতাহার ওস্তাদ খেলোয়াড় তৈরির কারিগর

কিছু কিছু মানুষ অন্যকে সুখি দেখে নিজে সুখিয় হয়। অন্যকে বড় হতে যোগান দেয় নিজের সবকিছু। পৌছে দেয় গন্তব্যে অনেক মানুষকে। অথচ নিজে এগোতে পারেনা বেশি দুর। এমনি হাস্যজ্জল সদালাপী একজন মানুষ অতি পরিচিত আমাদের মোতাহার ভাই। যাকে অনেকে মোতাহার ওস্তাদ বলে জানতো। দিনাজপুর বিরল উপজেলার বিজোড়া ইউনিয়নের সাত ভাইয়া গ্রামে ১৯৫২ সালের ১৫ নভেম্বর মোতাহার ওস্তাদের জন্ম। বাবা মরহুম হবিবুল্লাহ সরকার ও মাতা সেরাজুন নেসার ৫ ছেলে ও ৩ মেয়ের মধ্যে সে ৫ম। ছোট বেলায় বোনের সংসারে চাউলিয়াপট্টিতে জায়গা করে নেয় মোতাহার ওস্তাদ। একাডেমী স্কুলে পড়াশোনার পাশাপাশি শুরু হয় খেলাধুলা। পাকিস্তান আমলে এমএটি ক্লাব, উদয়ন ক্লাব ও ডিসি টিমের খেলায়াড়দের সাথে নিজেকে যোগ্য করে তোলেন। দেশ স্বাধীনতার পর বড় মাঠের সেই কাঠের গড়া টাউন ক্লাবে নিজের জায়গা করে নেন। নিজের প্রতিভা মেলে ধরতে দেশের অনেক জেলায় খেলতে শুরু করেন। ডাক আসে বিভিন্ন ক্লাবের। 

পরে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তি সংগ্রাম শুরু হলে ঘরে থাকতে পারেননি ওস্তাদ মোতাহার ভাই। পাক হানাদারের বিরুদ্ধে প্রাণপন লড়ে যান তিনি। বীর মুক্তিযোদ্ধা ওস্তাদ মোতাহার ১৯৭৩ সালে ডিগ্রি পাশ করার পর ১৯৭৫ সালে সংসার জীবন শুরু করেন। পাশে বন্ধুর মত হাত বাড়িয়ে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেন সহধর্মিনী রওশন আরা বেগম। খেলতে আর খেলোয়াড় তৈরি করতে সংসার গোছানোর কাজটাও খুব একটা হয়ে ওঠেনি। কিন্তু দিনাজপুরে বাঘা বাঘা খেলোয়াড় তৈরি করে ফেলেন ওস্তাদ মোতাহার ভাই মাবুদ ভাই, মাহফুজ ভাই, মানিক ভাইয়ের মত খেলোয়াড় যারা মোতাহার ভাইয়ের নেতৃত্বে দিনাজপুরকে মেলে ধরে দেশবাপী। মোতাহার ওস্তাদের ক্রীড়া নৈপুন্যে ঢাকা ওয়ান্ডারস ক্লাব খেলেছে ফুটবল খেলোয়ড় কল্যাণের ওয়াসী, আর রানা ইকবাল বাংলাদেশ পুলিশে। ওয়ান্ডার, ইসা ভাই ওয়াবদায়।

মোতাহার ভাইয়ের বড় অবদান ছিল উত্তরবঙ্গের একজন নাম করা খেলোয়াড় তৈরিতে যিনি এক সময় আজাদ স্পোটিং, ব্রাদার্স ইউনিয়ন ও আবাহনীর মত দলেও খেলেছেন। শুধু তাই নয় ব্রাদার্স ও আবাহনীর মধ্যকার খেলায় ব্রাদার্স ইউনিয়নকে আবাহনীর বিপক্ষে ১-০ গোলে জয় পাইয়ে দেয় পুলিশ সদস্য মরহুম মনজের ভাই। ওমর বাবুল ভাই, মকবুল ভাই এদের বড় খেলোয়াড় হতে সহায়তা করে মোতাহার ভাই। লিটু অনুর্ধ ১৮ দলে জায়গা করে নেয়। এছাড়াও আবু, পলাশ (পিএমএন), আলাল, হাবু তরু, শুভ, ভূট্টা, ডাম্বেল, পাপ্পু ও এক সময়ের মেডিকেল কলেজের শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড় বরিশাল মেডিকেল কলেজের ছাত্র জুনসহ অনেককে খ্যাতি পাইয়ে দেয় মোতাহার ওস্তাদ। 
সদালাপী এই মানুষটি ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠেই বাড়ী বাড়ী গিয়ে খেলোয়াড়দের ঘুম থেকে ডেকে ডেকে বড় মাঠে প্রশিক্ষণের কাজ করতেন। খেলোয়াড় তৈরি করতে করতে নিজে সংসারি হতে পারেননি আমাদের মোতাহার ভাই। সারাজীবন ভূমি অফিসে চাকুরী করেও নিজের মাথা গোজার জন্য এক চিলতে জায়গা জোগাড় করতে পারেননি। অবশ্য তার স্ত্রী পরে নিজের সামান্য আয় ও জমি বিক্রি করে শহরের পাহাড়পুর এলাকায় মাথা গোজার একটি ঠাই গড়ে তুলেছেন।

অথচ সেই বাড়ীর চলাচলের রাস্তাও বন্ধ করে রেখেছে প্রতিবেশী নুরুল ইসলাম। এ ব্যাপারে সবার সাথে ধরনা দিয়েও রাস্তার সুরাহা করতে পারেননি মুক্তিযোদ্ধা মোতাহারের স্ত্রী। মোতাহার ভাইয়ের জীবদ্দশায় তার স্ত্রী রওশন আরা বাড়ীর কথা বললে তিনি বলতেন বাড়ী দিয়ে কি হবে, তুমি তো থাকলে, তিন মেয়েকে দেখে রাখিও। শুধু কি তাই, তিনি তার আয়ের পয়সা দিয়ে একটি টেলিভিশন পর্যন্ত কিনতে পারেননি। পুরোনো একটি বাইসাইকেল ছিল তার একমাত্র বাহন। এভাবেই তিনি নিজেকে বিলিয়ে খেলার জগত এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে গড়ে তোলেন। অবশেষে ২০০৯ সালের ২৩ আগষ্ট ওই উজ্জ্বল নক্ষত্রের প্রস্থান হয়।

আমাদের মাঝে থেকে চির বিদায় নেন সকলের প্রিয় মোতাহার ওস্তাদ। তিনি আমাদের মাঝ থেকে বিদায় নিলেও তার হাজারো স্মৃতি আজও আমাদের তাড়া করে ফেরে। আজ তাই আমরা তার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। গত শুক্রবার ২৩ আগষ্ট তার মৃত্যুর ১০ বছর পূর্তিতে ঘরোয়াভাবে দোয়া ও মিলাদ মাহফিলে আয়োজন করে তার পরিবারের সদস্যরা। পরিবারের সদস্যরা মরহুম মোতাহার ওস্তাদের জন্য সকলের কাছে দোয়া কামনা করেন। 

 

উপরে