রাজশাহীতে কৃষকের সার নিয়ে বাণিজ্য
রাজশাহীতে প্রতি মাসে সরকারিভাবে বরাদ্দ পাওয়া কৃষকের সার নিয়ে ব্যাপক বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। জিম্মি ডিলাররা বাধ্য হচ্ছেন নেতাদের কাছে গুদামেই সার বিক্রি করে দিতে। সেই সার চলে যাচ্ছে অন্য জেলায়। বিক্রি হচ্ছে বেশি দামে। বিশেষ করে কাফকো ইউরিয়া সার নিয়ে চলছে এ বাণিজ্য। রাজশাহী বাফার গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শামীম আক্তার, বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের রাজশাহী জেলা সাধারণ সম্পাদক ও বিসিআইসির সার ডিলার রবিউল ইসলাম এ বাণিজ্যে জড়িত বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সরকারিভাবে বরাদ্দ পাওয়া কৃষকের ইউরিয়া সার নিয়ে বাণিজ্য করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন তাঁরা। এই বাণিজ্যের কারণে কৃষকপর্যায়ে এক বস্তা কাফকো সার বিক্রি হচ্ছে ৮৩০ থেকে ৮৫০ টাকায়, যেটি সর্বোচ্চ ৮০০ টাকায় বিক্রি করার কথা। আবার ডিলাররা ইউরিয়া সার ঠিকমতো উত্তোলন না করায় বাজারে সৃষ্টি হচ্ছে কৃত্রিম সংকট। এ অবস্থায় রাজশাহীর বাজারে বিসিআইসির সাধারণ ইউরিয়া সার বিক্রি হচ্ছে ৮১০ থেকে ৮৩০ টাকা করে, যা বিক্রি হওয়ার কথা ৭৯০ টাকা করে। ফলে বাড়তি টাকা গুনতে হচ্ছে কৃষকদের।
গোডাউন কর্মকর্তা ও ডিলার নেতার এসব অনিয়ম নিয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান (বিসিআইসি), দুদক, রাজশাহী জেলা প্রশাসকসহ বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ করেছেন ডিলাররা। তদন্তের পর রাজশাহী বাফার গোডাউনের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শামীম আক্তারকে সম্প্রতি ঢাকায় বদলি করা হলেও এখনো তিনি বহাল তবিয়তে আছেন রাজশাহীতে। এ নিয়ে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের সার ডিলারদের মধ্যে।
রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে ১৭৫ জন ডিলারের আওতায় উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ দপ্তর থেকে ইউরিয়া সার বরাদ্দ দেওয়া হয় কৃষকদের। বরাদ্দের পর সরকারি কোষাগারে নির্ধারিত মূল্য জমা দেন ডিলাররা। পরে এই সার রাজশাহী বাফার গুদাম থেকে সংগ্রহ করেন ডিলাররা। এই সার নিজ নিজ এলাকায় নিয়ে ডিলাররা কৃষকদের কাছে ন্যায্য মূল্যে বিক্রি করেন।
অভিযোগ উঠেছে, ডিলাররা যখন রাজশাহী বাফার গুদাম থেকে ইউরিয়া সার সংগ্রহ করতে যান, তখন সেখানকার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শামীম আক্তার ক্ষমতার অপব্যবহার করে ইচ্ছামতো পছন্দের ডিলারদের কাফকো ইউরিয়া সার সরবরাহ করেন। যেসব ডিলার তাঁকে আর্থিক সুবিধা দেন না, তাঁদের দেওয়া হয় নরমাল ইউরিয়া।
ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার এই অনিয়মের সুযোগ নিয়েছেন রাজশাহীর বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক রবিউল ইসলাম। তিনি শামীম আক্তারের সঙ্গে যোগসাজশে ৬০ থেকে ৬৫ জন ডিলারের বরাদ্দ করা ইউরিয়া সারের বরাদ্দপত্র কিনে ওই বরাদ্দপত্রের বিপরীতে বেশির ভাগ কাফকো সার উত্তোলন করছেন। এরপর তিনি সেই সার রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাইরের জেলা বা উপজেলা পর্যায়ের ডিলারদের কাছে অতিরিক্ত মূল্যে বিক্রি করছেন। আর ওই ডিলাররা উচ্চমূল্যে বিক্রি করছেন কৃষকদের কাছে।
অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, গত জানুয়ারি-মার্চ মাস পর্যন্ত রাজশাহীর ডিলারদের কাছে ১৬ মেট্রিক টন করে কাফকো সার সরবরাহ করা হয় গুদাম থেকে। সেই হিসাবে ১৭৫ জন ডিলারের কাছে সরবরাহ করার কথা দুই হাজার ৮০০ মেট্রিক টন কাফকো সার। কিন্তু গুদাম কর্মকর্তার যোগসাজশে ওই তিন মাসে সরবরাহ করা হয় ১১ হাজার মেট্রিক টন কাফকো সার।
কালের কণ্ঠের হাতে আসা রাজশাহী বাফার গুদাম থেকে সরবরাহ করা সারের চালানপত্রের মধ্যে একই দিনে একাধিক চালানে ডিলার রবিউল ইসলামের প্রতিনিধি (ম্যানেজার) রিপনের স্বাক্ষর পাওয়া গেছে। আবার একই মাসে শত শত টন ইউরিয়া সারও উত্তোলন করেছেন এই রিপন। রাজশাহীর বানেশ্বর ও দুর্গাপুরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ দুটি বাজারে কাফকো ইউরিয়া বিক্রি হচ্ছে ৮৩০-৮৫০ টাকা দরে। আর বিসিআইসির সাধারণ ইউরিয়া বিক্রি হচ্ছে ৮১০-৮৩০ টাকা দরে।
দুর্গাপুরের মাড়িয়া গ্রামের সোহাগ আলী জানান, তিনি দুই বস্তা কাফকো সার কিনেছেন ৮৩০ টাকা দরে। অথচ ৮০০ টাকার ওপরে ডিলাররা বিক্রি করতে পারেন না।
সার নিয়ে বাণিজ্য প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের রাজশাহী জেলা সাধারণ সম্পাদক ও বিসিআইসির সার ডিলার রবিউল ইসলাম বলেন, ‘আমার বরাদ্দপত্রের বাইরে আমি সার উত্তোলন করি না। যারা এসব অভিযোগ করেছে, তারা মিথ্যা কথা বলেছে। আমার প্রতিনিধি হিসেবে রিপন গুদাম থেকে সার উত্তোলন করেন।’
রাজশাহী বাফার গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শামীম আক্তার বলেন, ‘এসব অভিযোগ ঠিক নয়। আমি কোনো অনিয়মের সঙ্গে জড়িত নই। কোনো ডিলারের প্রতিনিধি হিসেবে যে কেউ সার উত্তোলন করতে পারে। একজন ডিলারের একজনই প্রতিনিধি থাকেন।’
সুত্রঃ কালের কণ্ঠ।