প্রকাশিত : ১৫ অক্টোবর, ২০১৯ ১৯:৩১

চোখের আলো নেই মনের আলোতে মিলছে তাদের মানুষ হওয়ার আলো

এইচ আলিম
চোখের আলো নেই মনের আলোতে মিলছে তাদের মানুষ হওয়ার আলো

চোখের আলো না থাকলেও, মনের আলোতে মিলছে তাদের মানুষ হওয়ার আলো। আর এই আলোয় আলোকিত করতে চায় তারা দেশকে। প্রবল ইচ্ছে শক্তি নিয়ে স্কুলে পড়ছে। চোখে দেখার শক্তি না থাকায় শ্রুতি লেখকের সহযোগিতায় এবং ব্রেইল পদ্ধতিতে লেখাপড়া করে মানবতার আলো জ¦ালিয়ে যাওয়ার আপ্রাণ প্রচেষ্টায় রয়েছে বগুড়া সমন্বিত দৃষ্টি প্রতিবন্ধি শিক্ষা কার্যক্রমের নিবাসিরা। 

বগুড়া জেলা সমাজ সেবা কর্মকর্তার কার্যালয় সুত্রে জানা যায়, সরকারি আর্থিক সহযোগিতায় সমন্বিত দৃষ্টি প্রতিবন্ধি শিক্ষা কার্যক্রমের শুরু হয়েছে। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিশুরা শিক্ষার সুযোগ পায় সেদিকে খেয়াল রেখে এই কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়। স্থানীয় বিদ্যালয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় তাদের শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নিতে ১৯৭৪ সালে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য সমন্বিত দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা হয়। প্রতিটি কার্যক্রমে একজন করে বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ‘রিসোর্স শিক্ষক’ এর তত্ত্বাবধানে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিশুদেরকে ব্রেইল পদ্ধতিতে শিক্ষা দেয়া হয়। প্রতিটি কেন্দ্রে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ১০ জন ছাত্রের শিক্ষার জন্য একজন রিসোর্স টিচার, একজন হাউজ প্যারেন্ট কাম শিক্ষক, একজন বাবুর্চি ও একজন নৈশপ্রহরী রয়েছে। বগুড়া সমন্বিত দৃষ্টি প্রতিবন্ধি শিক্ষা কার্যক্রমের স্থানটি ছিল বগুড়া জিলা স্কুলের একটি রুমে।

দৃষ্টি প্রতিবন্ধিরা সেখানে তাদেরমত থাকা, খাওয়া, পরিবেশ না থকায় দিনদিন শিক্ষার্থীদের অনীহার কারণে সেটি ভাল সফলতা পায়নি। এরপর ২০১৬ সালের দিকে প্রায় ২ কোটি টাকা ব্যায়ে বগুড়ার সুলতানগঞ্জ হাই স্কুল মাঠের কোণায় সমন্বিত দৃষ্টি প্রতিবন্ধি শিক্ষা কার্যক্রমের কার্যালয় ও ১০ ছাত্রের আবাসনের জন্য একটি দ্বিতীয় তলার ভবন নির্মাণ করা হয়। এই নিবাসে ছাত্ররা থাকবে এবং পাশের সুলতানগঞ্জ হাই স্কুলে নিয়মিত ক্লাশ করবেন। ২০১৭ সালের জুলাই মাসে এই ভবনটি হস্তান্তর হওয়ার পর ২০১৮ সাল থেকে এটির কার্যক্রম শুরু হয়।

এই আবাসনে থেকে দৃষ্টি প্রতিবন্ধিরা তাদের লেখাপড়া, ব্রেইল পদ্ধতি রপ্ত করা, তাদের বাড়তি যত্ন নেয়া, স্কুলের কাছে হওয়ায় যাতায়াতের সুবিধা পাচ্ছে। প্রতিটি ছাত্রের জন্য সরকারিভাবে প্রায় ৩ হাজার ৫০০ টাকা বরাদ্ধ থাকে। এই বরাদ্ধ থেকে ১০ শিক্ষার্থীর সার্বিক খরচ বহন করা হয়।বগুড়ায় বর্তমানে রয়েছে ৯জন শিক্ষার্থী। এরমধ্যে ২য় শ্রেণীতে পড়ছে অন্তর মিয়া, ডালিম মিয়া, হালিম মন্ডল, ৫ম শ্রেণীতে পড়ছে মশিউর রহমান, ৯ম শ্রেণীতে পড়ছেন মো: জিসান হোসেন, রবিন খান, কাওছার ইসলাম ও হুসাইন মাহমুদ নুমান। তারা সকলেই বগুড়ার সুলতানগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র। এই নিবাসের একমাত্র শিক্ষার্থী কাবিল হোসাইন পড়ছেন একাদশ শ্রেণীতে। এসএসসিতে জিপিএ ৫ নিয়ে ভর্তি হয়েছেন বগুড়া সরকারি শাহ সুলতান কলেজে। মেধাবী ছাত্র হওয়ার সুবাদে তাকে সরকারিভাবে শিক্ষার জন্য বাড়তি সুযোগ দেয়া হয়েছে। 

৯ম শ্রেণীর শিক্ষার্থী মো: জিসান হোসেন জানান, এর আগে তিনি জয়পুরহাটের স্কুলে পড়েছেন। বগুড়ার সান্তাহারের উতরাইল এলাকায় তার বাড়ি। সে কারণে বগুড়ার এই স্কুলে তিনি ভর্তি হন। পিএসসিতে সে জিপিএ-৪ পায়। সমান জিপিএ পায় জেএসসিতে। এবার সে জিপিএ-৫ পাওয়ার প্রত্যায়ে লেখাপড়া করে যাচ্ছেন। জিসান বলেন, তিনি বড় হলে মানুষের সেবা করতে চান। ভাল একটি চাকুরী করার পাশিপাশি বাকি সময় মানব সেবা করবেন। তার বাবা মা ও ভাই বোন রয়েছে। ৯ম শ্রেণীর শিক্ষার্থী কাওছার ইসলাম জানান, তিনি অনেক কাঠ খড় পুড়িয়ে শিক্ষায় এগিয়ে যাচ্ছেন। সরকারিভাবে তাকে সহযোগিতা করা হচ্ছে। তার সেখানে খাওয়া, পোষাক, জুতা, স্কুলের বেতনসহ সব দেয়া হয়। 

বগুড়া সমন্বিত দৃষ্টি প্রতিবন্ধি শিক্ষা কার্যক্রমের হাউজ প্যারেন্ট কাম শিক্ষক মো: রাশেদুল হাসান জানান, তিনি বগুড়া সদর উপজেলা সমাজসেবা অফিসের কারিগরি প্রশিক্ষক হিসেবে আছেন। তাকে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, এই নিবাসে থেকে ছাত্ররা যেন ভাল শিক্ষা অর্জন করতে পারে সে বিষয়ে সার্বিক সহযোগিতা করা হয়। তাদের খাবার, গোসল, পড়া, ঘুমানোর ব্যবস্থাসহ সার্বিক ব্যবস্থা করা হয়। সাধারণ শিক্ষার্থীদের যেমন ছাপার অক্ষরে বই আছে ঠিক সেই বইটি এই ছাত্রদের জন্য ব্রেইল পদ্ধতির বই আছে। ব্র্ইেল পদ্ধতি টি হলো ডট শিক্ষা। সাদা কাগজের উপর ৬টি ডট বা ছিদ্র করে একেকটি বিশেষ নকশার মত করা হয়। দৃষ্টি প্রতিবন্ধিরা এই ফুটো বা নকশা বা ডটের উপর আঙ্গুল বুলিয়ে সঠিকটা পড়ে যেতে পারে। এই ব্রেইল শিক্ষা দেয়া হয়।

বগুড়া সমন্বিত দৃষ্টি প্রতিবন্ধি শিক্ষা কার্যক্রমের ‘রিসোর্স শিক্ষক’ আজিজুল ইসলাম খান জানান, আগের থেকে এখানকার নিবাসিরা ভাল ফলাফর করছে। এখানে থেকে ছাত্ররা জিপিএ ৫ পাচ্ছে। জেলা সমাজসেবা উপ পরিচালকসহ সুলতানগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সহযোগিতায় ভাল করতে পারছে ছাত্ররা। খাবার থেকে শুরু করে শিক্ষা সহ সকল কাজে তাদের সহযোগিতা করা হয়। সরকারিভাবে তারা সকল সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে। নিবাসের ছাত্রদের মা বাবা মাঝে মধ্যে আসেন তাদেরও খোঁজ খবর নিয়ে যায়। 

বগুড়া সুলতানগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ফজলুল করিম জানান, সমন্বিত দৃষ্টি প্রতিবন্ধি শিক্ষা কার্যক্রমের সাথে যে ছাত্র রয়েছে তাদের মধ্যে কেউ কেউ খুব ভাল মেধাবী। চোখে না দেখলেও তারা মনের জোড়ে লেখাপড়া করে যাচ্ছেন স্কুলের অন্যান্য শিক্ষকবৃন্দ তাদের সহযোগিতা করে থাকে। যারা তাদের সহপাঠি তারাও সহযোগিতা করছে। পরীক্ষার সময় দৃষ্টি প্রতিবন্ধিরা শ্রুতি লেখক হিসেবে পরীক্ষায় বসে থাকে। বিশেষ ব্যবস্থাপনায় তাদের শিক্ষার ব্যবস্থা আরো ভাল করা হয়েছে। সরকারিভাবে ওই ছাত্রদের বেতন অন্যান্য ফি প্রদান করা হয়ে থাকে। 

উপরে