প্রকাশিত : ১৮ এপ্রিল, ২০২০ ২২:৫৭

“থ্যাংক ইউ পুলিশ”

সঞ্জু রায়:
“থ্যাংক ইউ পুলিশ”

করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে সারাদেশে চলছে সাধারণ ছুটি বা অঘোষিত লকডাউন যার দরুণ চিরচেনা বগুড়া শহর যেন অনেকটাই থমকে গেছে। সারাদিন কিছুটা কোলাহল থাকলেও সন্ধ্যার পরেই পুরো শহর যেন হয়ে যায় ভুতুরে, থাকেনা রিক্সার ক্রিং ক্রিং শব্দ, চলেনা ছোট-বড় কোন যানবাহন, বন্ধ থাকে সকল ছোট বড় দোকান, জীবনের তাগিদে কিছু সময়ের জন্য দিনের বেলায় বাহিরে মানুষ থাকলেও সন্ধ্যার পর তারা নিজ নিজ জীবনের মায়ায় নিজেদের করে ফেলে গৃহবন্দী।

প্রতিটি সড়ক এবং পাড়া মহল্লায় যখন থাকে শুনশান নিরবতা তখন হঠাৎ শহরের বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে দেখা যায় নিজেদের জীবন, পরিবার এবং সন্তানের মায়া ত্যাগ করা করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে মাঠে থাকা এই সময়ের সুপারহিরো পুলিশ সদস্যদের। তখন মনের অজান্তেই অন্তর থেকে একটি প্রতিধ্বনি উঠে আছে তা হলো ‘থ্যাংক ইউ পুলিশ’। 

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবং র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) সদস্যদের সাথে নিয়ে দিনরাত এক করে জেলার প্রতিটি উপজেলা, পৌরসভা এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে অতন্দ্র প্রহরীর মতো নিরলস কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যরা যার ব্যতিক্রম নয় বগুড়াতেও। সন্ধ্যার পর থেকেই গোটা শহর যখন জনশূণ্য হয়ে পড়ে তখন এই ভুতুড়ে শহরে একমাত্র ভরসা পুলিশের টহলযান। ওরা শুধু টহলই দেয় না মোড়ে মোড়ে অবস্থান নিয়ে আতঙ্কিত শহরবাসীকে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিয়ে যাচ্ছে।

আবারো একারণেই বলছি ‘থ্যাংক ইউ পুলিশ’। করোনা প্রার্দুভাবের মধ্যে সারাদেশের ন্যায় বগুড়ায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অতীতের যেকোন সময়ের থেকে অনেকটা স্বাভাবিক থাকলেও স্বস্তিতে নেই পুলিশ সদস্যরা বরং বিরামহীনভাবে চলছে তাদের কর্মযজ্ঞ। ‘ঘরে থাকুন, সচেতন থাকুন, পরিবারের জন্য হলেও প্লিজ কোয়ারেন্টাইন মেনে চলুন’ এমন সব সচেতনতার বাণী মাইক হাতে প্রচার করে যাচ্ছে বগুড়া জেলা পুলিশ। সচেতনতার পর্ব যখন শেষ তখন সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, কোয়ারেন্টাইন মেনে চলা, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা থেকে আগত মানুষদের খোঁজ রাখা,

শহরের বিভিন্ন সড়ক ও যানবাহনে জীবানুনাশক স্প্রে করা, হতদরিদ্র এবং কর্মহীন পরিবারের মাঝে বিভিন্ন মাধ্যমে খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দেওয়া, রাত-বিরাতে অসহায়দের ফোনে বাড়ির দরজায় গিয়ে ঔষধ দিয়ে আসা, চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের কর্মস্থলে যাতায়াত এবং সার্বিক দিক মনিটরিং করাসহ এক কথায় প্রবাদ বাক্যের মতো বলতে হয় দেশের এই দুর্যোগে জুতো সেলাই থেকে চন্ডি পাঠ সব কিছুই যেন করছে জেলা পুলিশ সুপার আলী আশরাফ ভূঞা’র বগুড়া জেলা পুলিশ পরিবারের মানবিক সদস্যরা।

বগুড়া শিবগঞ্জে যখন করোনা উপসর্গ নিয়ে একজন ব্যক্তি মারা যায় কিছুদিন আগে ভয়ে কেউ কাছে আসেনি এমনকি তার দাফনেও বাধা দিয়েছিল সেখানকার সুশীল সমাজ। পরিচয় থেকেও বেওয়ারিশ লাশের মতো পড়ে থাকা সেই ব্যক্তির জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জানাযা এবং দাফনকাজ সম্পন্ন করেছিন স্থানীয় ইউএনও কে সাথে বগুড়া শিবগঞ্জের পুলিশ সদস্যরাই। ইতিমধ্যেই সঠিক সুরক্ষার অভাবে দেশব্যাপী প্রায় ৫৮ জন পুলিশ সদস্য করোনায় আক্রান্ত মর্মে জানা গেছে বিভিন্ন নির্ভরযোগ্যসূত্রে। সেই সাথে ৬৩৩ জন পুলিশ সদস্যরা রয়েছেন কোয়ারেন্টাইনে এবং প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে আছে ১৪৩ জন। আর কোয়ারেন্টাইন থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন ১৪৩ জন।

তবে এদের মাঝে বগুড়া জেলার আদমদীঘি নিবাসী ঢাকা ফেরত এক পুলিশ কন্সটেবলও করোনায় আক্রান্ত হয়েছে যিনি বর্তমানে চিকিৎসাধীন আছেন বগুড়া মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে। জেলার সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এবং জেলা পুলিশের মিডিয়া মুখপাত্র সনাতন চক্রবর্তী জানান, বগুড়ায় বর্তমানে ১২ টি থানাসহ বিভিন্ন সড়কে এবং গ্রামগঞ্জের নিশুতি এলাকাগুলোতেও প্রতিদিন ৩ শিফটে নিরলসভাবে নিজেদের মায়া ত্যাগ করে কাজ করে যাচ্ছেন জেলা পুলিশের ২ হাজার সদস্য। হোটেল, রেস্টুরেন্ট বন্ধ খাওয়ার নেই কোন সঠিক সময়, বাসায় গেলেও থাকার সমস্যা নানামুখী প্রতিবন্ধকতাকে উপেক্ষা করেই সদস্যরা কোন সুরক্ষা ছাড়াই লড়াই করে যাচ্ছেন এই অদৃশ্য শক্তির বিরুদ্ধে।

সরকারী আজিজুল হক কলেজের ইংরেজী বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সুব্রত কুমার সাহার সাথে কথা বললে তিনি বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশেষ করে এই করোনা যুদ্ধে পুলিশের জনবান্ধব, জনঘনিষ্ঠ ও মানবিক কর্মকান্ড এক নতুন পুলিশ বাহিনীকে উন্মোচিত করেছে দেশবাসীর সামনে যেখানে বগুড়া জেলা পুলিশের ভূমিকা প্রশংসনীয়। দেশের এই ক্রান্তিকালে যখন অনেক ধর্নাঢ্য ব্যক্তিবর্গ, সমাজকর্মী,  প্রথম শ্রেণীর নাগরিকরাও নিজেদেরকে করেছে গৃহবন্দী তখন কোন প্রকার পিপিই বা সুরক্ষা সামগ্রী ছাড়াই মাঠে কাজ করে যাচ্ছেন পুলিশ সদস্যরা আবার পুলিশের কর্ণধার আইজিপি মহোদয়ের মাধ্যমে করোনা তহবিলে এই সদস্যরাই দিয়েছে নিজেদের একদিনের বেতন এবং বিভিন্ন তহবিলের অর্থ প্রায় ২০ কোটি টাকা।

সকল কর্মকান্ড অনুধাবন করে অন্তর থেকে না চাইতেই তাদের প্রতি চলে আসে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতার বাণী। বগুড়া জেলা পুলিশ সুপার আলী আশরাফ ভূঞা বিপিএম (বার) এর সাথে কথা বললে অত্যন্ত আত্মবিশ^াস এবং সাহসিকতার সাথে তিনি বলেন, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম যে বুলেটটি ছোড়া হয়েছিল রাইফেলের মাজল থেকে তা ছিল একজন পুলিশ সদস্যের। দেশের যেকোন দুর্যোগে পুলিশ সদস্যরা কখনোই পিছনে ছিল না সর্বদা জয়ের লক্ষ্যে সামনে থেকে কাজ করে গেছে।

বাংলাদেশ পুলিশের কর্ণধার আইজিপি বেনজীর আহমেদ এর নেতৃত্বে শরীরের একবিন্দু রক্ত থাকা পর্যন্ত পুলিশ সদস্যরা মাঠে থাকবে বগুড়াতেও এর ব্যতিক্রম হবেনা। যেকোন পরিস্থিতিতে নিজেদের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে জনসাধারণের সুরক্ষায় কাজ করতে তারা সর্বদা প্রস্তুত রয়েছে বলে জানান পুলিশ সুপার আলী আশরাফ ভূঞা।

দৈনিক চাঁদনী বাজার/সাজ্জাদ হোসাইন

 

উপরে