প্রকাশিত : ২৪ জুন, ২০২০ ২১:১৯

কোভিড-১৯ ও শিশু সুরক্ষা: সামাজিক চ্যালেঞ্জসমূহ ও করণীয়

কোভিড-১৯ ও শিশু সুরক্ষা: সামাজিক চ্যালেঞ্জসমূহ ও করণীয়

অন্যের উপর নির্ভরশীল বলেই যে কোন ধরণের দূর্যোগ ও মহামারীতে শিশুরা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ দলের মাঝে থাকে। ইউনিসেফ বাংলাদেশ এর তথ্য মতে বাংলাদেশে ১৬০ মিলিয়ন জনসংখার মাঝে প্রায় ৬৪ মিলিয়ন হলো শিশু যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ ভাগ। সুতরাং যে কোন ধরণের দূর্যোগ এবং মহামারীতে শিশুদের প্রতি আলাদা নজর দেওয়া ছাড়া কোন বিকল্প নেই। কোভিড-১৯ এর বৈশ্বিক মহামারীরর শুরুর দিকে পরিবারের বয়স্ক সদস্যদের দিকে বিশেষ নজর দেওয়ার উপরে জোর দেওয়া হয়েছিলো। পরবর্তীতে ভাইরাসটির বিভিন্নমুখী আচরণ সনাক্ত হবার পরে এখন আর এটিকে শুধুমাত্র বয়স্কদের জন্যই ঝুঁকিপূর্ণ বলা যাচ্ছেনা। যেহেতু শিশুরা তাদের নিজেদের সুরক্ষা নিজেরা নিশ্চিত করতে পারেনা এবং তারা তাদের সমস্যার কথা সাবলীল ভাষায় প্রকাশ করতে পারেনা তাই তারাও ঝুঁকির বাইরে নয়। 

বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতা এবং পারিবারিক কাঠামোয় শিশুরা সাধারণত বাবা-মা অথবা অভিভাবকের উপরে অনেকাংশেই নির্ভরশীল। প্রাথমিক পরিচর্যা যেমন- শিশুর গোসল, খাওয়া, স্বাস্থ্যসেবা, নিরাপত্তা সহ সার্বিক সুরক্ষার বিষয়াদীগুলো মা-বাবা এর উপরেই নির্ভর করে। আর এই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে প্রায়শই সচেতন মা-বাবাকে সামাজিক ও মানসিক চ্যালেঞ্জ এর মোকাবিলা করতে হয়। যেহেতু সচেতন মা-বাবা জানেন যে, একটি শিশু তার পরিবার, নিকট আত্মীয় এবং কাছের মানুষদের কাছেই অনেকাংশে অনিরাপদ সেহেতেু তারা একটু বেশি সজাগ থাকেন।

সুতরাং শিশুর সুরক্ষা নিশ্চিত করেতে গিয়ে মা-বাবা অনেক সময় পরিবারের এবং নিকট আত্মীয়ের কাছ থেকে নানা অভিযোগ ও ভৎর্সনার শিকার হয়ে থাকেন। আমাদের পারিবারিক কাঠমো, সাংস্কৃতিক চর্চা, সামাজিক প্রেক্ষাপট এবং অর্থনৈতিক কাঠামো এই চ্যালেঞ্জগুলোকে আরো নতুন উচ্চতায় নিয়ে যায়। 
“আরে...ওমুকে আমাকে তো পছন্দ করেনা তাই ওদের ছেলে/মেয়েকে আমার সাথে মিশতে দেয়না।” খুব সম্ভবত এমন একজনও সচেতন মা-বাবা খুঁজে পাওয়া যাবেনা যারা তাদের নিকট আত্মীয়দের কাছ থেকে এ অভিযোগটি শোনেননি।

এমন অভিযোগ যখন নিকট মানুষদের কাছ থেকে আসে তখন ব্যাপারটা ভীষণ বিব্রতকর হয়ে পড়ে। বিদ্যমান সামাজিক ও পারিবারিক কাঠামোর বাস্তবতায় মা-বাবা’দের জন্য এই ধরণের অভিযোগ এর দায় মেটানো ভীষণ কঠিন হয়ে পড়ে। এমনকি এটি মাঝে মাঝে পারিবারিক সহিংসতার মতো ঘটনারও জন্ম দেয়। সুতরাং এখন প্রশ্ন হলো আসলেই কি উল্লিখিত অভিযোগটি শতভাগ সত্য নাকি এর পেছনে অন্য কোন কারণও রয়েছে? আলোচনার সুবিধার্থে আমরা কল্পিত কয়েকটি কারণ অনুসন্ধান করতে পারি। (১) ধরুন, একজন মা জানেন যে তার পরিবারের খুব কাছের একজন মানুষ যৌন নিপীড়নকারী।

সেই মা হয়তো ছোট বেলায় ঐ ব্যক্তির দ্বারাই শারীরিক ও মানসিক নীপিড়ন এর শিকার হয়েছেন। যেহেতু সে মানুষটি পরিবারের খুব কাছের মানুষ তাই নিপীড়নের ঘটনাটি মা তার ছোটবেলায় কাউকে বলতে পারেনি এবং পরবর্তীতে বড় হয়ে সামাজিকতার দায়ে তা আর কাউকে কখনও বলতেই পারেনি। এই মা তার ছোট্ট মেয়েটাকে ঐ নিকট আত্মীয়ের কাছে একা কখনও মিশতে দিতে চাননা। তাই সবসময় শিশু মেয়েটিকে ঐ মানুষটির থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করেন। এর কারণে মা’কে উল্লিখিত অভিযোগটি শুনতে হয় কিন্তু তিনি মুখফুটে কাউকে কিছু বলতেও পারেননা। কারণ এতোগুলো বছরে সেই লোকটি একজন মুরব্বী ও সম্মানী ব্যক্তি হিসেবে সমাজে ও পরিবারে প্রতিষ্ঠিত। (২) কাছের মানুষগুলোর মাঝে এমন কিছু মানুষ থাকেন যারা হয়তো ছোট শিশুর হাতে দোকানে বানানো কোন খাবার কিংবা টাকা তুলে দিতে পছন্দ করেন। কিন্তু শিশুটির মা শিশুটিকে হয়তো বাইরের চিপস এবং বাইরের খোলা খাবার খাওয়ানো থেকে সবসময় রক্ষা করে চলেন।

শত কাজের মাঝেও হয়তো মা তার শিশুটির জন্য বাড়ীতে বানানো খাবার সঙ্গে করে শিশুটিকে বেড়াতে নিয়ে যান। এমন সময় সেই আত্মীয়কে যদি মা বাইরের খাবারটি শিশুকে দিতে বারণ করেন তাহলেও উল্লিখিত অভিযোগটি শুনতে হয়। (৩) আমাদের চারপাশে অনেক মানুষ থাকেন যারা বেশিরভাগ সময় নানা নেতিবাচক আলোচনা এবং পরচর্চায় মসগুল থাকেন। এমন আলোচনা চলাকলীন মা-বাবা তাদের শিশুটিকে সেখানে বেশিক্ষণ রাখতে চাননা। কারণ শিশুরা প্রবলভাবে অনুকরণপ্রিয় হয় এবং চারপাশ থেকে অতি দ্রুত সব শিখে ফেলে। সুতরাং মা-বাবা হয়তো তাদের শিশুদের এমন পরিস্থিতি থেকে একটু দূরে রাখার চেষ্টা করেন। এ কারণেও উল্লিখিত অভিযোগটি শুনতে হয়। (৪) শিশু বান্ধব ঘর বা বাড়ি বলতে আমরা এমন একটি স্থান বোঝায় যেখানে একটি ছোট শিশু স্বভাবসুলভ চঞ্চলতার কারণে মারাত্মক দূর্ঘটনার শিকার হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কম। অথবা শিশুটির দ্বারা ঘরের মূল্যবান কোন কিছুর ক্ষতি সাধন হবার সম্ভাবনাও খুব কম।

এটি এমন একটি বাড়ী/ঘর যেখানে শিশুর জন্য অনিরাপদ বস্তু যেমন কাঁচি, ব্লেড, আলপিন, ঔষুধ, বিদুৎ এর মাল্টি প্ল্যাগ সহ ইত্যাদি জিনিসপত্র শিশুর নাগালের বাইরে থাকবে। যে বাড়ীতে বা ঘরে কোন শিশু বাস করেনা সেই ঘরটি শিশু বান্ধব হবেনা; এটি খুবই স্বাভাবিক। এমন অনিরাপদ বাড়ীতে/ঘরে শিশুটির মা-বাবা তাদের শিশুকে একা ছাড়তে চাননা। আর এই কারণেও তাদের উল্লিখিত অভিযোগটি শুনতে হয়। (৫) পরিবারের ছোট সদস্যদের কাছে শিশুকে কিছু সময়ের জন্য দেখভালের জন্য সচেতন মা-বাবা’রা নানা ধরণের উপদেশ দিয়ে থাকেন। যার একমাত্র উদেশ্য হলো শিশুর সুরক্ষা নিশ্চিত করা। এক্ষেত্রেও মাঝ মাঝে মা-বাবাকে উল্লিখিত অভিযোগ শুনতে হয়। (৬) আধুনিক যুগে ছোট পরিবারে মা-বাবারা শিশুকে বড় করার জন্য অনেক চ্যালেঞ্জ এর মাঝ দিয়ে যান।

কর্মজীবী বাবা-মা’দের জন্য চ্যালেঞ্জটা প্রায় দ্বিগুন হয়ে যায়। দিনের বেলায় শিশুটিকে হয়তো অন্য কারো হাতে সমর্পণ করতে হয়। শিশুর বেড়ে ওঠা, সামাজিকীকরণ সহ সমস্ত বিষয়গুলোতে অন্যের উপর নির্ভর করতে হয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে হয়তো পরিবারের শ্বশুড়/শাশুড়ীর উপরেই শিশুটির দেখাশোনার দায়িত্ব তুলে দিতে হয়। এমন পরিস্থিতিতে, কর্মজীবী মা-বাবা যদি তাদের শিশুটির ভালোর জন্য কোন পরামর্শ দেন তাহলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সহজভাবে গৃহীত হয়না। বরং তাদের উল্লিখিত অভিযোগ সহ আরো নানা কথাও শুনতে হয়। 

এই অসহায়ত্বগুলোকে সঙ্গী করেই মা-বাবা’রা তাদের শিশুর সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন। এ সামাজিক চ্যালেঞ্জগুলো নতুনকিছু নয় বরং এগুলো সব যুগেই ছিলো। আমাদের মা-বাবাও এই ধরণের পরিস্থিতির মাঝ দিয়ে আমাদের মানুষ করার চেষ্টা করেছেন। হয়তো তাদের সাথে আধুনিক সময়ের পরিস্থিতির ধরণগুলো একটু আলাদা। তবে কোভিড-১৯ তো আমাদের জীবনে এই প্রথম এসেছে! সুতরাং বর্তমানে বেঁচে থাকা জনগোষ্ঠিকে এর আগের মহামারিগুলোতে তার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আচরণ পরিবর্তন করার প্রয়োজন পড়েনি। কিন্তু এবার কোভিড১৯ এর সাথে যুদ্ধটা আসলে বিদ্যমান সামাজিক আচরণের সঙ্গে। ব্যক্তিগত পরিচর্যার সর্বোচ্চ সতকর্তা ও চর্চাই কেবল নিজেকে এবং আমাদের পরিবারকে বাঁচাতে পারে।

পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে, শিশুরা যেহেতু তার মা-বাবা এবং অভিভাবকের উপর নির্ভরশীল সেহেতু তাদের সুরক্ষা দেবার সমস্ত দায়িত্ব মা-বাবা’র উপরই বর্তাবে। তবে শিশুর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে উল্লিখিত সামাজিক চ্যালেঞ্জগুলোকে সঙ্গে নিয়ে মা-বাবা’দের কঠিন সমস্যার মোকাবিলা করতে হবে তা বলা বাহুল্য। তবে পরিবারের সবাই এবং কাছের মানুষগুলো যদি শিশু সুরক্ষার বিষয়টি নিয়ে সচেতন হতে পারেন তাহলেই কেবল আমরা কোভিড-১৯ এর মহামারীর দিনগুলোতেও শিশুর জন্য একটি নিরাপদ আবাসস্থল উপহার দিতে পারি। পরিবারের সবার করণীয় বিষয়ে কয়েকটি দিক নিচে উপস্থাপন করা হলো যা নিজেদের পরিবারের বিদ্যমান কাঠামোর উপর ভিত্তি করে আমরা সাজিয়ে নিতে পারি। 

পরিবারের কর্মজীবি সদস্যদের জন্য: জরুরি কাজ এবং জীবিকার প্রয়োজনে আমাদের বের হতেই হবে। সুতরাং নিজের জন্য এবং পরিবারের অন্য সবার নিরাপত্তার কথা ভেবে আমরা আমাদের সর্বোচ্চ সুরক্ষা নিশ্চিত করবো। মুখে মাস্ক এবং হাতে গ্লাভস্ ব্যবহার করে আমরা বাইরে বের হবো। বাইরে কাজের ক্ষেত্র বিবেচনায় নিয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করবো। বাড়ীতে ফিরে সারা শরীর জীবানুমুক্ত করে ব্যবহৃত পোষাক বাইরে পরিবর্তন করে বাসার ভিতরে প্রবেশ করবো। এক্ষেত্রে নিজ উদ্যেগে বাসার বাইরে জীবাণুমুক্ত করা এবং পোশাক পরিবতর্ন করার কাঠামোগত ব্যবস্থা তৈরি করে নিতে হবে। এরপরে ঘরে প্রবেশ করেই সরাসরি গোসলখানায় গিয়ে গোসল করে নিতে হবে। পরিবারে শিশুদের কাছ থেকে যতটুকু সম্ভব একটু দূরে থাকাটা জরুরি।

শিশুর গালে, ঠোঁটে চুমু দেওয়া কিংবা স্পর্শ করা থেকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে। সম্ভব হলে রাতে একই বিছানায় শিশুর সাথে না ঘুমানোই উচিত। এই সময়গুলোতে বাহির থেকে যেকোন খাবার যেমন চকোলেট, চিপস, বিস্কুট ইত্যাদি বাসায় নিয়ে এসেই শিশুদের হাতে দেওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। বরং এগুলো জীবাণুমুক্ত করার পরেও অন্তত ২ দিন পরে তাদের হাতে তুলে দেন। এসময় মাসে সর্বোচ্চ দুই দিনের বেশি বাজার করা থেকে বিরত থাকাই ভালো। পরিবারের সবার পাশাপাশি শিশুটির মাথার চুলটা বাসাতেই নিজ দায়িত্বে ছোট করে দিতে হবে। সেলুনের মতো হয়তো ভালো হবেনা, তাতে কি? নিজের হাতে শিশুটির নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আনন্দে ভাসার এটিই তো সুযোগ!  সবসময় নিজের শারীরিক অবস্থার দিকে বিশেষ নজর দেওয়া ভীষণ জরুরি। ভাইরাসের লক্ষণ দেখা দিলে আইডিসিআর এর গাইডলাইন অনুযায়ী নিজেকে অন্তরীন করে নিতে হবে এবং পরবর্তীতে স্বাস্থ্য সেবা গ্রহণের স্তরগুলো মেনে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।  

বাসায় অবস্থানরত সদস্যদের জন্য: শিশুর বয়স যদি ৩ এর বেশি হয় তাহলে তাদেরকে কোভিড-১৯ বিষয়ে সাধারণ ধারণা দিতে হবে। তাদের সচেতন করে তুলতে হবে। এটি পরবর্তীতে তাদের গাইড করতে আপনাকে সাহায্য করবে। নিজের শারীরিক সমস্যা না থাকলে বাসায় কাজের সাহায্যকারীকে আপাতত বাসায় না প্রবেশ করানোই ভালো। যদি তাদের বাসায় প্রবেশ করাতেই হয় তবে জীবাণুমুক্ত করার ধাপগুলো অনুসরণ করতে হবে। এক্ষেত্রে আইইডিসিআর এর গাইড লাইন এবং নিজেদের বাসার বিদ্যমান সুযোগ-সবিধা বিবেচনায় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আমরা ইতিমধ্যেই জেনেছি যে ইউরোপ ও আমেরিকাতে অনেক মানুষ বাসার মাঝে থেকেও কোভিড-১৯ পজিটিভ হয়েছেন।

অনেক গবেষণার ফলাফলে বলা হচ্ছে যে বাইর থেকে কেনা কাঁচা সবজি, ফলমূল ও মাছ-মাংসের সঙ্গে এই ভাইরাস বাসার ফ্রিজে প্রবেশ করেছে এবং তা অনেকদিন সেখানে জীবিত থেকেছে। সুতরাং এই প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো খুব ভালোভাবে জীবাণুমুক্ত করে নিতে হবে। এরপরে ফ্রিজে রাখা জিনিসগুলো ব্যবহারে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। অতএব ঘরে কাজ করলেও আমাদের বারবার হাত ধুয়ে নিতে হবে। ঘরে জিনিসপত্রগুলো জীবাণুমুক্ত করার সময় শিশুদের অবশ্যই আলাদা ঘরে রাখতে হবে। ঘরের মাঝে যে ব্যক্তিটি জীবাণুমুক্ত করার কাজ করবেন তিনি গোসল না করা পর্যন্ত শিশুর কাছে যাবেননা এবং স্পর্শ করবেননা।

বাসায় ছাদে বেড়াতে গেলেও ভীষণ সতর্ক থাকতে হবে। বিশেষ করে ঢাকা শহরের মতো বাসাগুলিতে যেখানে অনেক অপরিচিত মানুষ একসাথে বসবাস করেন সেখানে বাসার ছাদে বেড়াতে না যাওয়ায় ভালো। এসময়ে শিশুদের এমন কোন খেলনা কিনে দেওয়া ঠিক হবেনা যাতে যে আহত হতে পারে। কারণ এসময় জীবন নাশের মতো সমস্যা না হলে হাসপাতালে না যাওয়ায় ভালো। বর্তমানে দেশে প্লাজমা সংগ্রহ করে কোভিড১৯ আক্রান্ত রোগিদের চিকিৎসার পরিকল্পনা চলছে। সুতরাং এখানেও রক্তের গ্রুপ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আর আপনার শিশুটি যদি নেগেটিভ গ্রুপের রক্তের বাহক হয় সেক্ষেত্রে আপনাকে আরো সতর্ক হতে হবে।

শিশুটির নিকট আত্মীয় ও প্রতিবেশিদের জন্য: আমাদের সামাজিকতা এবং ভালোবাসা বহিপ্রকাশের ধরণ ভীষণ অকৃত্রিম। আমরা বাসায় ফিরেই নিজে বাইরের পোশাক পরিবর্তন না করেই শিশুদের জড়িয়ে ধরি। এটি আমাদের সংস্কৃতির অংশ। কিন্তু কোভিড-১৯ এই আচরণগুলোতেই সরাসরি আঘাত হানলো। আমরা এখন অনেক কিছুই করতে পারবোনা যা আগে করতাম। এ সময়গুলোতে আমরা খুব জরুরি না হলে অন্য কারো বাসায় বেড়াতে যাবোনা। যদি প্রয়োজন এর খাতিরে যেতেই হয় তাহলে অবশ্যই বাসার শিশুটির কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকার চেষ্টা করবো।

শিশুটির যে মামা, চাচা, খালু, কিংবা প্রতিবেশি কেউ প্রতিদিন শিশুটিকে নিয়ে বিকেল বেলায় খেলা করতেন তাদের জন্য এমন একটি পরিস্থিতি ভীষণ কষ্টের। কিন্তু আশার কথা হলো এই বিচ্ছেদ তো সারা জীবনের জন্য নয় বরং অল্প কিছু দিনের। এমন পরিস্থিতিতে শিশুটির মা-বাবাকে এমন কোন আবদার করা আমাদের উচিত হবেনা যা তারা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করতে পারবেননা। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, শিশুটির মা-বাবা শিশুটির নিরাপত্তার কথাটি সবথেকে গুরত্ব দিচ্ছেন। তাদের একটাই চাওয়া, আবার যেনো সবাই মিলে আরো অনেকটা দিন একসাথে এ পৃথিবীতে আনন্দ উপভোগ করতে পারেন।

সুতরাং আমাদের উচিত হবে তাদেরকে সহযোগিতা করা। আমরা যেনো না ভাবি যে, শিশুটির মা-বাবা প্যানিক হয়ে গিয়েছেন! মাঝে মাঝে প্যানিক হওয়া হয়তো ভালো যদি তা মানুষকে সতর্ক হতে সাহায্য করে। অন্ততঃ কোভিড-১৯ এর সাথে যুদ্ধটা করতে হলে আমাদের অবশ্যই সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে। কোন বিকল্প নেই। উপরের আলোচনা থেকে আমরা অন্তত এটুকু বুঝতে পারি যে, শিশুর সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য সামাজিক চ্যালেঞ্জগুলো স্বাভাবিক সময়েই বেশ কঠিন। কিন্তু কোভিড-১৯ এর এই মহামারীতে শিশুর সুরক্ষা নিশ্চিত করাটা আরো কঠিন হয়ে যাবে কারণ এবার যুদ্ধটা সরাসরি সামাজিক আচরণের বিরুদ্ধে। সুতরাং মা-বাবাদের পাশাপাশি পরিবার এবং প্রতিবেশিদের এ ব্যাপারে সরাসরি ভুমিকা রাখা প্রয়োজন।

আমাদের মনে রাখা জরুরি যে, আমাদের এই সামাজিক দূরত্ব অল্প কিছুদিনের জন্য। পরিস্থিতি একদিন অবশ্যই স্বাভাবিক হয়ে যাবে। আর প্রযুক্তির এই সময়ে সামাজিক মাধ্যমে আমরা সবাই সবার সাথে দেখা করতে পারছি। সুতরাং সামাজিক আচরণগুলো নিয়ে ভাববার এখনই শ্রেষ্ঠ সময়। এই মহামারীতে শিশুর নিরাপত্তা সহ পরিবারের প্রতিটি মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের পাশাপাশি সমাজবিজ্ঞানী ও মনোবিঞ্জানীদেরও গবেষণা কার্যক্রম চালানোও সময়ের দাবি। সামাজিক আচরণ পরিবর্তনের সাম্ভাব্যতা এবং করণীয় বিষয়ে আলোচনার সময় চলে এসেছে।

দেশবরেণ্য সমাজবিজ্ঞানী ডঃ এ এইচ এম মোস্তাফিজার রহমান সভ্যতা বিষয়ে আলোচনায় বলেছিলেন, “আমরা নিজেকে যদি সভ্য বলে দাবি করি তাহলে যেনো কখনও অন্যের কষ্টের কারণ না হই।”  অতএব, ‘অন্যের মৃত্যুর কারণ যেনো আমি না হই’- এটিই হোক কোভিড-১৯ মোকাবিলায় আমাদের মূলমন্ত্র। পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণী ভালো থাকুক আর প্রতিটি আবাসস্থল হোক শিশুদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়।

মোঃ তৌহিদুর রহমান, 
উন্নয়নকর্মী ও এমফিল গবেষক, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অফ প্রফেশনালস।
উপরে