শপথ গ্রহন শেষে ঝকঝকে পৌরসভায়-শেরপুরের নবনির্বাচিত পৌর পরিষদ
অত্যন্ত শৃঙ্খলাপূর্ণ পরিবেশে গত ১৬ই জানুয়ারী দ্বিতীয় ধাপে বগুড়ার শেরপুর সহ মোট ৬০টি পৌরসভার নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। নির্বাচনে, শেরপুর পৌরসভায় চমকপ্রদ ভাবে মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন বিএনপি’র বিদ্রোহী প্রার্থী, আলহাজ¦ মো: জানে আলম খোকা। নির্বাচনের একদিন পরেই পৌর ভবনের মেরামত ও সাজসজ্জার কাজ শুরু করতে দেখা গেছে। এরপর ৮ফেব্রুয়ারী আনুষ্ঠানিক শপথ গ্রহনের মাধ্যমে সূচনা হয় নবনির্বাচিত পৌর পরিষদের। নির্বাচনী প্রচারনায় পৌরবাসীকে দেয়া বর্তমান মেয়রের উল্লেখযোগ্য প্রতিশ্রুতির মধ্যে শুকুরের অবাধ বিচরণ রোধ অন্যতম। যা ইতোমধ্যেই কার্যকর হতে শুরু করেছে।
গত ৯ফেব্রুয়ারী শেরপুরের নবনির্বাচিত পৌর পরিষদের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম অধিবেশনেই সকল কমিশনার ও সংশ্লিষ্টদের উপস্থিতিতে পৌরসভার আয়তন বাড়ানোর প্রস্তাব রাখা হয়েছে। আর এই আয়তন বিস্তারের এলাকা নির্ধারণের জন্য ১৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিতে আহ্বায়ক হিসেবে আছেন, পৌরসভার সহকারি প্রকৌশলী এসএম শফিকুল ইসলাম সামীম, সদস্য হিসেবে আছেন পৌরসভার উপ-সহকারি প্রকৌশলী মো: হুমায়ুন কবির, উপ-সহকারি প্রকৌশলী মো: রিয়াজুল ইসলাম এবং পৌরসভার নয় ওয়ার্ডের সকল কাউন্সিলরবৃন্দ। তবে প্রথম অধিবেশনেই এমন প্রস্তাবের খবরে শেরপুরের অধিকাংশ মানুষের মধ্যে সংশয় সৃষ্টি করেছে।
১৮৭৬ সালে স্থাপিত শেরপুর পৌরসভার বর্তমান আয়তন প্রায় ১০ দশমিক ৪৩ বর্গ কিলোমিটার। ১৪৫ বছর আগে গঠিত এই পৌরসভা ক শ্রেণীর অন্যতম পৌরসভা হিসেবে স্বীকৃত হলেও নাগরিক সুযোগ-সুবিধা ক শ্রেণীতে উন্নীত হয়নি এখনও। বিগতদিনে কাজ না হওয়ায় সরকারি বরাব্দকৃত কোটি কোটি টাকা সরকারি কোষাগারে ফেরৎ যাওয়ার কথা শোনা গেছে।
অনুধাবনে জানা গেছে, ২০১১ সালে শেরপুর পৌরসভার ভোটে মেয়র নির্বাচিত হন স্বাধীন কুমার কুন্ডু। তৎকালীন মেয়রের মাধ্যমে ২০১৪ সালের শেষের দিকে বিশ^ব্যাংকের আওতাধীন প্রকল্প’র সাথে চুক্তি করা হয়। যার মাধ্যমে বেজ-এলিগেসন নামক তহবিলে শেরপুর পৌসভার জন্য ৭৫ কোটি টাকার বাজেট ধরা হয়। কিন্তু এই বাজেটের পরবর্তীতে তৎকালীন মেয়র স্বাধীন কুন্ডু সাময়িক বরখাস্ত হওয়ায় ২৫মে ২০১৫ থেকে ১১ডিসেম্বর ২০১৫ পর্যন্ত ভারপ্রাপ্ত মেয়র হিসেবে ফিরোজ আহম্মেদ জুয়েল দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৫ সালে স্বাধীন কুন্ডুর অনুপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত মেয়র ফিরোজ আহম্মেদ জুয়েলের মাধ্যমে প্রথম ৬ কোটি টাকার টেন্ডার প্রকাশ করা হয়। এর পরে স্বাধীন কুন্ডু পৌরসভায় ফেরৎ এসে ওই ৬ কোটি টাকার কাজ সম্পন্ন করেন। এর পরবর্তীতে আব্দুস সাত্তার মেয়র নির্বাচিত হয়ে ওই একই প্রকল্পের আওতায় আরো ৩৫ কোটি টকার কাজ বাস্তবায়ন করেন। ইতোপূর্বে জুন ২০২০ সালে ওই প্রকল্পের সময় শেষ হয়েছে।
সে হিসেবে এপর্যন্ত সর্বোমোট ৮টি প্যাকেজে প্রায় ৪৭ কোটি টাকার টেন্ডার সম্পন্ন হয়েছে। ৭৫ কোটি টাকার ওই বাজেটের মধ্যে পৌর শিশু পার্কের কাজ, পৌর শ্মশানের কাজ, করতোয়া নদীর সংস্করণ ও সৌন্দর্য বর্ধন উল্লেখযোগ্য যা অসম্পন্ন রয়ে গেছে। তবে এই অসম্পন্ন কাজ গুলো নতুন পরিকল্পনায় সম্পন্ন করার দাবি এলাকাবাসীর। প্রথম শ্রেণীর পৌরসভা হওয়া সত্তেও অনেক সুযোগসুবিধা থেকে এখনও বঞ্চিত শেরপুর পৌরবাসী। এখনও অনেক অসম্পন্ন কাজ পরিলক্ষিত হয়। সাধারণ মানুষের কাছে এই সুযোগ সুবিধাগুলো শতভাগ পৌঁছতে ও অসম্পন্ন কাজগুলো সম্পন্ন করতেই অনেক কাঠ-খড়ি পোড়াতে হবে পৌর কতৃপক্ষকে বলে মনে করছেন সচেতন মহল। পৌরসভার জন্য আইনে নির্ধারিত কাজের সংখ্যা ১৭২টি।
তবে পৌরসভা সীমিত কিছু কাজের মধ্যেই ঘুরপাক খায় এবং সেই সীমিত কাজগুলোও যথাযথভাবে করা হয় না। যেমন- শেরপুর পৌর শিশুপার্কটির জরাজীর্ণ পরিস্থিতি, দ্রুত সংস্কার প্রয়োজন। প্রয়োজন পৌর শহরের যাবতীয় পানি ও পয়ঃ নিস্কাশন এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। সঠিক পানি ও পয়ঃ নিস্কাশন এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাবে পৌর এলাকার সকল নোংরা, ময়লা-আবর্জনা, বিভিন্ন কারখানার বর্জ্য ফেলে করতোয়া নদী দূষিত ড্রেনে পরিনত হচ্ছে। অতি দ্রুত এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহন আবশ্যক বলে মনে করছেন পরিবেশসচেতন ব্যক্তি বর্গ। এছাড়াও পৌর শহরের অধিকাংশ রাস্তা-ঘাট চলাচলের অযোগ্য। শেরপুর পৌর মহাশ্মশানটিও দ্রুত সংস্কার অতি প্রয়োজন। উপরোল্লিখিত সমস্যাগুলির অবসান ঘটিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপে এলাকা বিস্তারের সীদ্ধান্ত গ্রহনের আহ্বান জানিয়েছেন একাধিক পৌর নাগরিক।
শেরপুর উপজেলা বিএনপি’র আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ও শেরপুর পৌরসভার সাবেক মেয়র স্বাধীন কুমার কুন্ডু জানান, পৌরসভার নিজস্ব আয় বাড়াতে হলে আয়তন বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। কারণ, আশপাশের ইউনিয়ন থেকে যদি শিল্প প্রতিষ্ঠান বা কল-কারখানাগুলো শেরপুর পৌরসভার আওতাভুক্ত করা যায় তাহলে পৌরসভার নিজস্ব আয় বৃদ্ধি করা সম্ভব। তবে নতুন করে আশপাশের অনুন্নত এলাকাগুলো পৌরসভার আওতাভুক্ত করলে ওই এলাকাগুলোকে উন্নত করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যয় করতে কতটুকু সক্ষম হবে পৌরসভা? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি চাঁদনী বাজার প্রতিনিধিকে বলেন, পৌরসভার চারিদিক থেকে যদি সমপরিমানে বর্ধিত করা হয় সে ক্ষেত্রে এই সমস্য হতে পারে, আর যদি বর্তমান পৌর পরিষদ দক্ষতার সহিত সুনির্দিষ্ট কিছু এলাকা পৌরসভার আওতাভুক্ত করে সেটাই হবে উত্তম সিদ্ধান্ত বলে আমি মনে করি।
শেরপুর পৌরসভার সাবেক মেয়র ও শেরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুস সাত্তার সরকারি টাকা ফেরৎ প্রসঙ্গে জানান, সরকারি টাকা ফেরৎ যাওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না কারণ, কোনো কাজেরই টাকা আসে না, আমরা শুধু কাজের নাম প্রকাশ করি ওনারা কাজ বুঝিয়ে দিয়ে যান। তবে আমি এমন কোনো লোক দেখানো কাজের নাম প্রকাশ করিনি যা দীর্ঘস্থায়ী হবে না। কারণ সরকারি টাকার অপচয় বা অকার্যকর জায়গায় আমি লাগাইনি। পৌরসভার আয়তন প্রসারণের ব্যাপারে সাবেক এই মেয়র বলেন, বর্তমান আয়তনে সংশ্লিষ্ট প্রকল্প বাস্তবায়ন করে আয়তন প্রসরণের ব্যাপারে চিন্তা করা উচিৎ বলে আমার মনে হয়।
তবে এ বিষয়ে শেরপুর উপজেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক ও বগুড়া জেলা বিএনপির সাবেক উপদেষ্টা এবং শেরপুর পৌরসভার বর্তমান মেয়র আলহাজ¦ জানে আলম খোকা চাঁদনী বাজারকে বলেন, আশেপাশের প্রথম শ্রেণীর সকল পৌরসভার তুলনায় শেরপুর পৌরসভার আয়তন অনেকাংশেই ছোটো, তাই এই পৌরসভার আয় বাড়াতে হলে এর আয়তন বৃদ্ধি প্রয়োজন বলে আমার মনে হয়েছে।
এ বিষয়ে মতামত জানতে চাইলে একাধিকবার নির্বচিত এবং সর্বশেষ ২০০৪ সালের আগে শেরপুর পৌরসভায় মেয়র, বর্তমানে বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও শেরপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আলহাজ¦ মজিবর রহমান মজনু বলেন, আমি এই মুহুর্তে এই সিদ্ধান্ত যথার্থ বলে মনে করি না, কারণ, পৌরসভার যে আয় তাতে পৌরসভার কর্মকর্তা কর্মচারীদের বেতনই পরিষোধ হয় না। আর আয়তন বৃদ্ধির মাধ্যমে অনুন্নত এলাকাগুলো পৌরসভার অন্তর্ভুক্ত হলে সেগুলো উন্নয়নের ব্যয়ভার সংকুলান করা কষ্টদায়ক হবে। বর্তমান আয়তনের মধ্যে প্রয়েজনীয় কাজগুলো সম্পন্ন হওয়ার পরে আয়তন বৃদ্ধি করা যেতে পারে। যেকারণে এই মুহুর্তে এই সিদ্ধান্ত গ্রহন না করাই ভালো হবে বলে আমি মনে করি।
শেরপুর পৌরসভার আয়তন প্রসারের ব্যাপারে বগুড়া-৫ আসনের (শেরপুর-ধুনট) জাতীয় সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ¦ হাবিবর রহমান তার মন্তব্যে বলেন, বগুড়ার একদিন আগে স্থাপিত শেরপুর পৌরসভা। এর আয়তন বাড়ানো যেতেই পারে, তবে সবদিক থেকে সমপরিমাণ বর্ধিত করা বাঞ্ছনীয়। এতে কারো কোনো আপত্তি বা অসমতা থাকবেনা।
দৈনিক চাঁদনী বাজার / সাজ্জাদ হোসাইন