ধুনটে স্বাধীনতার ৫০ বছরেও নির্মিত হয়নি শহীদদের স্মৃতি স্তম্ভ : অযত্নে-অবহেলায় পড়ে রয়েছে গণকবর
![ধুনটে স্বাধীনতার ৫০ বছরেও নির্মিত হয়নি শহীদদের
স্মৃতি স্তম্ভ : অযত্নে-অবহেলায় পড়ে রয়েছে গণকবর](./assets/news_images/2021/03/01/02.jpg)
১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী দেশের অন্যান্য স্থানের ন্যায় বগুড়ার ধুনট উপজেলাতেও তাদের নৃশংসতম হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল। এ নির্মমতার সাক্ষী হয়ে আছে বেশকিছু বধ্যভূমি ও গণকবর। কিন্তু দেশ স্বাধীনের ৫০ বছর অতিবাহিত হলেও ধুনট উপজেলায় এখনও নির্মিত হয়নি শহীদদের নামে কোন স্মৃতিসৌধ বা স্মৃতি স্তম্ভ। সংরক্ষণ না করায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত এসব স্থানগুলো আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। অযত্নে-অবহেলায় অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে রয়েছে বধ্যভূমি ও গণকবরগুলো।
ধুনটের বধ্যভূমি ও গণকবর :
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে দেশের অন্যান্য স্থানের ন্যায় ধুনটেও কিছু বধ্যভূমি ও গণকবর মহান স্বাধীনতার স্মৃতিকে অম্লান করে রেখেছে। ১৯৭১ সালে পাক হানাদাররা এবং তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর, আলসামস্ যে সমস্ত স্থানে নির্বিচারে মানুষ হত্যা করেছে সে সমস্ত স্থানকে বধ্যভূমি এবং যে সমস্ত স্থানে জীবিত অথবা মৃত একাধিক মানুষকে পুতে রেখেছে সে সমস্ত স্থান হচ্ছে গণকবর।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে ধুনট উপজেলার সবচেয়ে বড় বধ্যভূমি হচ্ছে এলাঙ্গী বধ্যভূমি। এলাঙ্গী ইউনিয়নের বিলচাপড়ী গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা হামিদুল ইসলাম ফটিক ও হাসাপোটল গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা শামছুল হক সহ ওই এলাকার বীর মুক্তিযোদ্ধারা জানান, তৎকালীন খান সেনারা ২৭ এপ্রিল প্রথম ধুনটে আসে। ঐদিন থেকেই ধুনট উপজেলায় পাক সেনাদের স্থায়ী ক্যাম্প স্থাপিত হয়। এই ক্যাম্পের ইঞ্চারজ ছিলেন ক্যাপ্টেন দবিবর রহমান খান পাঞ্জাবী। তারা ধুনট থানা মুসলিম লীগ নেতাদের সহায়তায় এলাঙ্গী গ্রামের হিন্দু বসতির উপর আক্রমন চালায়। প্রতিটি বাড়ি থেকে পুরুষ, মহিলা ও শিশু ধরে নিয়ে গিয়ে এলাঙ্গী গ্রামের দুর্গাচরন ঘোসের পুকুরপাড়ে দাড় করিয়ে ৩৯ জনকে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে। তাদের মধ্যে দূর্গাচরন ঘোসের মেয়ে সরবালা ঘোস, শেরপুরের বীরেন কুন্ডু, তার শিশু পুত্র মাধব কুন্ডু, এলাঙ্গী গ্রামের খাকুনি বিনি, হরাই প্রমাণিক, মাধাই সাহা ও নায়েব আলী সহ ৩২ জনের নাম পাওয়া যায়। শরনার্থী হওয়ায় শহীদ আরো ৭ জনের নাম এখনও অজানাই রয়ে গেছে। তবে ইতিহাস না জানলে এসব বধ্যভূমি খুঁজে পাওয়াই দুস্কর। এসব বধ্যভূমিগুলোতে নেই কোন নাম ফলক। উদ্যোগ নেয়া হয়নি রক্ষণা-বেক্ষনের।
ধুনটের গণকবর :
এই উপজেলায় বেশ কয়েকটি গণকবর রয়েছে। গণকবরগুলো ধুনট থানা ভবনের আশপাশেই অবস্থিত। তন্মধ্যে ধুনট থানা সংলগ্ন পূর্বপাশে জেল হোসেন নামে এক ব্যবসায়ীর চাতালের অবস্থিত গণকবরটি ধুনটের একমাত্র গণকবর হিসেবে পরিচিত। ১৯৭১ সালে পাক সেনারা এই গণকবরে কান্তনগর গ্রামের মোস্তাফিজুর রহমান, ভরনশাহী গ্রামের জহির উদ্দিন, মাঝবাড়ী গ্রামের ফরহাদ হোসেন, জিল্লুর রহমান, পর্ব্বত আলী, শিয়ালী গ্রামের নুরুল ইসলাম ও চান্দারপাড়া গ্রামের আব্দুল লতিফ সহ নাম না জানা আরো ২৮ জনকে হত্যা করে একসঙ্গে পুতে রেখেছে। বর্তমানে এই গণকবরটি অযত্ন আর অবহেলায় পড়ে রয়েছে। এই গণকবরে যাওয়ার কোন রাস্তা নেই। ব্যক্তি মালিকাধীন একটি চাতালের এক কোনায় একটি কবরের মতো পড়ে রয়েছে এই গণকবরটি। প্রতি দিবসে এই গণকবরে প্রশাসনের পক্ষে দোয়ার আয়োজন করা হলেও এটা রক্ষনা-বেক্ষনে কোন উদ্যোগে নেয়া হয়নি দীর্ঘদিনেও।
এই গণকবর ছাড়াও ধুনট থানার উত্তর পার্শ্বে অবস্থিত ‘গায়েন বাড়ী’ গণকবর ধুনট উপজেলার সবচেয়ে বড় গণকবর।
গায়েন বাড়ির নাতি আনোয়ার হোসেন জানান, এই গণকবর সম্পর্কে আমার দাদি মইফুল বিবির কাছ থেকে অনেক গল্প শুনেছি। ১৯৭১ সালের আগষ্ট মাসের মাঝামাঝি রাত ১০টার দিকে যমুনা পাড়ি ৫০/৬০ জনের একটি কাফেলা আমাদের বাড়ীর পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু পাশে যে থানা বা সেনা ক্যাম্প আছে, তারা বুঝতে পারেনি। তখন এই কাফেলার লোকদের ধরে এনে নারী ও শিশু সহ ৪২ জনকে আমার দাদির চোখের সামনে তাদেরকে জীবিত অবস্থায় আমাদের বাঁশঝাড়েপুতে রেখেছে পাক সেনারা।
এছাড়া এর পাশেই রয়েছে ‘বাবু বাড়ি’ গণকবর নামে পরিচিত আরেকটি গণকবর। যজ্ঞেশ্বর বাবুর বাড়ীর দক্ষিন-পশ্চিম পার্শ্বে একটি নারিকেল গাছের নিচে এখানেও একসঙ্গে ১৩ জনকে জীবিত অবস্থায় পুতে রেখেছে পাক সেনারা। এছাড়াও আশেপাশে আরো বেশ কয়েকটি গণকবর বিচ্ছিন্নভাবে অবস্থিত।
তবে ‘গায়ের বাড়ী’ ও ‘বাবু বাড়ি’ দুটি গণকবরই অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। রক্ষনা-বেক্ষন করা হয়নি। বাঁশঝাড় ও আবর্জনায় ভরে রয়েছে এই গণকবরগুলো। দীর্ঘদিন ধরে সংরক্ষণ না করায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত এসব স্থানগুলো আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। তবে এখনও যেসব বধ্যভূমিতে স্মৃতিসৌধ বা স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি এবং সেখানকার ইতিহাস সংরক্ষণ করা হয়নি, তা বাস্ততবায়নে দ্রুতই পদক্ষেপ নিতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, প্রশাসন এবং সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা।
গোসাইবাড়ী ইউনিয়নের বীর মুক্তিযোদ্ধা ইলিয়াস হোসেন জানান, শিমুলবাড়ী গ্রামের মোজাম্মেল হোসেন পাইকারের ছেলে শহীদ গোলাম মোস্তফা খোকন আমাদের গর্ব। ১৯৭১ সালের এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে পাক সেনাদের সঙ্গে যুদ্ধকালে জয়পুরহাটের ক্ষেতলালে শহীদ হন গোলাম মোস্তফা খোকন। তার নামে বগুড়া শহরে শহীদ খোকন পার্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং খোকন লেন স্থাপিত হয়েছে। কিন্তু আমাদের ধুনট উপজেলায় কোন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নামে কোন স্মৃতি স্তম্ভ নেই। তাই সরকারের কাছে শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নামে স্মৃতি স্তম্ভ নির্মানের দাবি করছি।
মথুরাপুর ইউনিয়নের পিরহাটি গ্রামের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রউফের সন্তান রেজাউল হক মিন্টু বলেন,যারা দেশের জন্য জীবন দিয়েছে তাদের গণকবরগুলো আজও পর্যন্ত রক্ষণা-বেক্ষণ করা হয়নি। অযত্নে-অবহেলায় পড়ে রয়েছে গণকবরগুলো। সেখানকার ইতিহাস সংরক্ষণের কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। ফলে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে নতুন প্রজন্ম।
ধুনটের ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা গ্রস্থের রচয়িতা গবেষক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, সংগ্রহ ও সংরক্ষনের অভাবে মুক্তিযুদ্ধের অনেক স্মৃতি ধুনট থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ভবিষ্যতে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনায় সহায়ক হবে। তিনি আরো বলেন, ধুনটের ৮জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সহ ৭৮ জন শহীদের নামে একটি শহীদ স্মৃতি স্তম্ভ নির্মান এবং গণকবরগুলো রক্ষণা-বেক্ষন করলে আমাদের নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানতে পারবে।
এসব বিষয়ে ধুনট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সঞ্জয় কুমার মহন্ত বলেন, এই উপজেলায় নতুন যোগদান করেছি। তাই এসব বিষয়ে জানা নেই। খোঁজ নিয়ে গণকবরগুলো রক্ষণা-বেক্ষন ও স্মৃতি স্তম্ভ নির্মানের উদ্যোগ নেয়া হবে।
এবিষয়ে বগুড়া-৫ (শেরপুর-ধুনট) আসনের সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্ব হাবিবর রহমান বলেন, ধুনট-শেরপুর এলাকায় যেসব বধ্যভূমি রয়েছে সেগুলোতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ এবং সংরক্ষণে আমরা কাজ শুরু করছি। এরই মধ্যে এগুলো তালিকাভুক্তকরণ, চিহ্নিতকরণ এবং সেগুলো বাস্তবায়নে মন্ত্রণালয়ে প্রজেক্ট আকারে পাঠানো হবে। তবে ইতিমধ্যে ধুনট উপজেলায় একটি মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স নির্মান এবং প্রাথমিক বিদ্যালয় ও উচ্চন বিদ্যালয় সহ প্রায় ২৫০টির মতো শহীদ মিনার নির্মান করা হয়েছে।
দৈনিক চাঁদনী বাজার / সাজ্জাদ হোসাইন