প্রকাশিত : ২ মার্চ, ২০২১ ২২:২৫

ধুনট উপজেলা চেয়ারম্যানের নিয়োগ বানিজ্যে নিঃস্ব শতাধিক পরিবার দীর্ঘদিনেও টাকা না পেয়ে মানবেতর জীবন যাপন চাকরি প্রার্থীদের

থানায় অভিযোগ দাখিলের হিড়িক
ইমরান হোসেন ইমন, ধুনট (বগুড়া) প্রতিনিধি
ধুনট উপজেলা চেয়ারম্যানের নিয়োগ
বানিজ্যে নিঃস্ব শতাধিক পরিবার
দীর্ঘদিনেও টাকা না পেয়ে মানবেতর জীবন যাপন চাকরি প্রার্থীদের

বগুড়ার ধুনট উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল হাই খোকনের বিরুদ্ধে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চাকরি, শ্রমিক নিয়োগ, জলমহাল, বালু ব্যবসা নিয়ন্ত্রন ও সরকারী প্রকল্প বিক্রি সহ তদবির বাণিজ্যের নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে। 

এসব বিষয়ে ধুনট থানায় ইতিমধ্যেই আ’লীগ নেতা উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুল হাই খোকনের বিরুদ্ধে ভুক্তভোগিদের ৬টি লিখিত অভিযোগ জমা পড়েছে। ধুনট থানা পুলিশ ভুক্তভোগিদের এসব অভিযোগের তদন্ত শুরু করেছে।

ধুনট উপজেলা চেয়ারম্যানের এসব অবৈধ বানিজ্যে নিঃস্ব হয়েছে শতাধিক পরিবার। দীর্ঘদিনেও এসব পরিবার টাকা ফেরত না পাওয়ায় মানবেতর জীবন যাপন করছেন তারা।       

তবে উপজেলা চেয়ারম্যান খোকনের এসব নিয়োগ বাণিজ্য ও অবৈধ অর্থ উপার্জনে সহায়ক ভূমিকায় রয়েছেন তার স্ত্রী আঞ্জুয়ারা বেগম, তার ছোট ভাই আব্দুল কাদের জিলানী ও উপজেলা যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিকুল ইসলাম। 

এদিকে সম্প্রতি ধুনট উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুল হাই খোকনের বিরুদ্ধে অনিয়ন ও দূর্ণীতি অভিযোগে ৯ জন ইউপি চেয়ারম্যান জেলা প্রশাসক বরাবর অনাস্থা জ্ঞাপনের পর থেকেই তার বিরুদ্ধে এসব অনিয়ম ও দূর্ণীতির চিত্র বেরিয়ে আসছে।   

থানায় দায়েরকৃত অভিযোগ ও অনুসন্ধানে জানাগেছে, ধুনট উপজেলার মথুরাপুর ইউনিয়নের খাদুলী রাম বল্লমপুর গ্রামের আবু বক্কারের ছেলে রাসেল আহমেদ ছিলেন একজন চাকরি প্রার্থী।

২০১৭ সালে রাম বল্লমপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দপ্তরী পদে চাকরি দেওয়ার নামে রাসেল আহমেদের বাবা আবু বক্কারের কাছ থেকে ৯ লাখ ১০ হাজার টাকা নিয়েছেন ধুনট উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুল হাই খোকন। 

তবে এত টাকা জোগাড় করা কষ্টসাধ্য ছিল রাসেলের দিনমজুর বাবার। কিন্তু তারপরও ছেলের সুখের কথা চিন্তা করে শেষ সম্বল ২৪ শতক ফসলী জমি বিক্রি করে এবং এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে সর্বমোট ৯ লাখ ১০ হাজার টাকা উপজেলা চেয়ারম্যান খোকনের হাতে তুলে দেন চাকরি প্রত্যাশি রাসেলের বাবা।  

কিন্তু ২০১৭ সালে ওই পদে চাকরি পান মিলন নামে আরেক ব্যক্তি। এদিকে চাকরি না পেয়ে হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়েন রাসেলের পরিবার। দীর্ঘীদিন ঘুরে ঘুরে ৫ কিস্তিতে ৫ লাখ টাকা আদায় করলেও অবশিষ্ট টাকা এখনও ফেরত পায়নি রাসেলের দিনমজুর বাবা।    

তবে শুধু রাসেলের পরিবারই নয়..। তার মতো শতাধিক পরিবারকে সরকারি-বেসরকারী বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চাকরি দেওয়ার কথা বলে কোটি কোটি হাতিয়ে নিয়েছেন ধুনট উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুল হাই খোকন।

তেমনি আরেকজন চাকরি প্রার্থীর বাবা কালেরপাড়া ইউনিয়নের সরুগ্রাম ৫নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম। তার ছেলেকেও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দপ্তরী পদে নিয়োগ দিতে ৬ লাখ টাকা নিয়েছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুল খোকন। কিন্তু ৬ লাখ টাকাতেও মন ভরেনি খোকনের স্ত্রী আঞ্জুয়ারা বেগমের। অবশেষে তাকেও বাধ্য হয়ে ৫০ হাজার টাকা দিতে হয়েছে রফিকুলকে। কিন্তু নিয়োগ পেয়েছে অন্য এক ব্যক্তি। এদিকে নিয়োগ না পেয়ে টাকা ফেরত চাইলে রফিকুল ইসলামকে কয়েক কিস্তিতে সাড়ে তিন লাখ দেন খোকন। কিন্তু বাকি ৩ লাখ টাকা চাইতে গেলে হুমকি-ধামকি দেন আব্দুল হাই খোকন। এবিষয়ে গত কয়েক দিন আগে স্থানীয় তরুণ যুবকেরা রফিকুল ইসলামের একটি ভিডিও সাক্ষাতকার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচার করলে ধুনট উপজেলা আ’লীগ সভাপতির মাধ্যম দিয়ে ২ লাখ টাকা প্রদান করেন খোকন। 

তবে শুধু আবু বক্কার ও রফিকুল ইসলামই নয়, তাদের মতো চাকরি প্রত্যাশী ভুক্তভোগি কোনাগাঁতি গ্রামের আব্দুল হাই এর কাছ থেকে ৩ লাখ, ঝিনাই গ্রামের একরাম সরকারের কাছ থেকে ৩ লাখ টাকা, হাফিজারের কাছ থেকে ৬ লাখ টাকা, হটিয়ারপাড়া গ্রামের মন্তাজ উদ্দিনের কাছ থেকে ৬ লাখ টাকা ও বড়িয়া গ্রামের যুবলীগ নেতা সাইদুল ইসলামের কাছ থেকে ৭ লাখ টাকা এবং বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দেওয়ার কথা বলে তারই ব্যক্তিগত সহকারী সুলতানহাটা গ্রামের আলমগীর হোসেনের কাছ থেকে ৪ লাখ ৮৪ হাজার টাকা, জলমহাল ইজারা দেওয়ার কথা বলে চিকাশী গ্রামের সিরাজুল ইসলামের কাছ থেকে ৩ লাখ ১০ হাজার টাকা, গোলাম মোর্শেদ বুলবুলের কাছ থেকে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা সহ প্রায় প্রতিটি গ্রামেরই শতাধিক মানুষের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন ধুনট উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুল হাই খোকন।

তবে তিনি শুধু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরি দেওয়ার নামেই টাকা আদায় করেননি। তিনি এবং তার স্ত্রী চারটি প্রতিষ্ঠানের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। আব্দুল হাই খোকন ধুনট মহিলা ডিগ্রী কলেজ ও ঝিনাই মাদ্রাসার সভাপতি এবং তার স্ত্রী আঞ্জুয়ারা বেগম সোনারগাঁ উচ্চ বিদ্যালয় ও চিকাশী আন্তঃ উচ্চ বিদ্যালয়ের সভাপতি। তারা স্বামী-স্ত্রী ওই চারটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রধান শিক্ষক, সহকারী শিক্ষক, দপ্তরী ও পিয়ন সহ প্রায় ১৪/১৫টি পদে নিয়োগ দিয়ে কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।

এছাড়া আব্দুল হাই খোকন, তার স্ত্রী আঞ্জুয়ারা বেগম, তার ছোট ভাই জিলানী ও যুবলীগ নেতা শফিকুল ইসলাম সরকারী বিভিন্ন প্রকল্প বিক্রি, তদবির বানিজ্যের নামে অর্থ আদায়, বালু মহল ও জলমহল নিয়ন্ত্রণ সহ বিভিন্ন দপ্তরে কাজের নামে আরো কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু দির্ঘদিনেও টাকা ফেরত না পাওয়ায় হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়েছে ভুক্তভোগিরা। 

তাই নিরুপায় হয়ে গত ২৮ ফেব্রুয়ারী ও ১ মার্চ চাকরি প্রার্থী আবু বক্কার, আব্দুল হাই, একরাম সরকার, আলমগীর হোসেন, সিরাজুল ইসলাম, গোলাম মোর্শেদ বুলবুল বাদী হয়ে ধুনট উপজেলা চেয়য়ারম্যান আব্দুল হাই খোকন ও তার স্ত্রী আঞ্জুয়ারা বেগম এবং গোপালনগর ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের আহবায়ক সেলিম রেজাকে আসামী করে ধুনট থানায় পৃথক পৃথকভাবে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন।

চাকরি প্রার্থী রাসেল আহমেদের বাবা আবু বক্কার বলেন, দিনমজুরী পেশায় কাজ করে সংসার চালাই। ছেলের চাকরির জন্য শেষ সম্বল ২৪ শত জমি বিক্রি করে এবং এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে ৯ লাখ ১০ হাজার টাকা উপজেলা চেয়ারম্যান খোকনকে দিয়েছিলাম। কিন্তু চাকরি পেয়ে অনেক ঘুরে ঘুরে কয়েক কিস্তিতে ৫ লাখ ১০ হাজার টাকা পেয়েছি। অবশিষ্ট ৪ লাখ টাকা এখনও ফেরত পাইনি। টাকা চাইতে গেলেই সে এবং তার স্ত্রী আমাকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করেন। তাই নিরুপায় হয়ে খোকনের বিরুদ্ধে বিচার চেয়ে থানায় লিখিত অভিযোগ দিয়েছি।

চিকাশী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কামরুজ্জামান কাজল বলেন, আব্দুল হাই খোকন দলের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর থেকেই নিয়োগ বানিজ্যের নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এরপর উপজেলা চেয়ারম্যান হওয়ায় তার এসব অবৈধ বানিজ্য আরো বেড়ে গেছে।

তবে এসব বিষয়ে ধুনট উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল হাই খোকনের মোবাইলফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি ফোন রিসিভ না করায় তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। 

এব্যাপারে ধুনট থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) কৃপা সিন্ধু বালা বলেন, ধুনট উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুল হাই খোকনের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত ৬ জন ব্যক্তি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন। অভিযোগগুলো তদন্ত করতে বিভিন্ন অফিসারকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। 

দৈনিক চাঁদনী বাজার  / সাজ্জাদ হোসাইন

উপরে