সরকারি উদ্যোগে নওগাঁয় সেবাগ্রহীতারা বিনামূল্যে পাচ্ছে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা

শিক্ষা, সংস্কৃতি ও নানা দর্শনীয় স্থানের এক ঐতিহ্যবাহী জেলা নওগাঁ যেখানে বসবাস করছে প্রায় ২৬ লক্ষ মানুষ। ১১টি উপজেলা ও ৩টি পৌরসভা নিয়ে গঠিত এই জেলায় এই বৃহৎ জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে রয়েছে মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল, মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র, প্রতিটি উপজেলায় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, কমিউনিটি ক্লিনিকসহ সরকারি-বেসরকারি নানা হাসপাতাল ও ক্লিনিক। তবে এই জেলার মোট জনগোষ্ঠীর একটি সিংহভাগ অংশ হচ্ছে কিশোর-কিশোরী এবং তরুণ প্রজন্ম যাদের কৈশোরকালীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতেও নওগাঁয় সরকারিভাবে নেয়া হয়েছে নানা প্রশংসনীয় উদ্যোগ। যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিতে কিশোর-কিশোরী কর্ণার স্থাপনসহ গোপনীয়তার সাথে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে দেয়া হচ্ছে চিকিৎসাসেবা। কিন্তু জেলার স্বাস্থ্য বিভাগে দক্ষ জনবল সংকট, সেবা সম্পর্কে প্রচারণার অভাব এবং প্রশাসনিক নানা অব্যবস্থাপনার জন্যে এই খাতে সরকারি নানা ইতিবাচক উদ্যোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে জেলার একটি বিশাল জনগোষ্ঠী। যা সমাধানে দ্রুততম সময়ে উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার (এসআরএইচআর) নিয়ে জেলায় কাজ করা শিশু সংগঠনের নেতৃবৃন্দরা।
সোমবার সকালে সরেজমিনে নওগাঁ মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র পরিদর্শন পরবর্তী সেখানে কর্মরত মেডিকেল অফিসার ডা: এম,এইচ,এম মাহফুজুল আলম এর সাথে কথা বললে তিনি জানান, সেখানে তারা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সকল সেবা প্রদান করছেন। প্রসব পূর্ববর্তী, প্রসবকালীন এবং প্রসব পরবর্তী মায়ের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতকরণসহ শিশুদের টিকাদান কার্যক্রম, সাধারণ জনগণদের সরকার নির্ধারিত স্বল্পমূল্যে গর্ভনিরোধক কনডম, বড়ি, বিভিন্ন স্থায়ী ও অস্থায়ী ব্যবস্থা প্রদানসহ সেখানে রয়েছে সুসজ্জিত একটি কিশোর-কিশোরী কর্ণার। তিনি আরো জানান, কিশোর-কিশোরী কর্ণারে সুপেয় পানির ব্যবস্থাসহ রয়েছে একটি সংযুক্ত টয়লেট। উক্ত র্কণারে গোপনীয়তার সাথে জেলার যে কোন কিশোর-কিশোরী এসে বসে তাদের বয়সন্ধি:কালীন কাঙ্খিত সেবা নিতে পারবেন।
কিন্তু হতাশ হতে হয়েছে নওগাঁর ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে গিয়ে। এসআরএইচআর বিষয়ে সেবাপ্রদানের লক্ষ্যে উক্ত হাসপাতালে ৭/৮ বছর আগে বেসরকারি একটি এনজিও’র উদ্যোগে স্থাপিত কিশোর-কিশোরী কর্ণার থাকলেও কক্ষের স্বল্পতা এবং নানা জটিতলতায় তা এখন আর নেই। হাসপাতালের তত্বাবধায়ক ডা: জাহিদ নজরুল ইসলামের সাথে কথা বললে তিনি জানান, কাগজে কলমে উক্ত হাসপাতাল ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট হলেও তাদের প্রশাসনিক জনবল সক্ষমতা রয়েছে ১০০ শয্যা হাসপাতালের। তিনি বলেন, বর্তমানে মেডিকেল অফিসারদের মাধ্যমেই কিশোর-কিশোরীদের সেবা নিশ্চিতে তারা আন্তরিকভাবে কাজ করছেন। তবে ইতিবাচক সেবা হিসেবে উক্ত হাসপাতালে রয়েছে আইএমসিআই (সমন্বিত মা ও শিশু সাস্থ্য সেবা কেন্দ্র) কর্ণার, ব্রেস্ট ফিডিং কর্ণার, ওসিসি সেন্টার, ইপিআই সেবাপ্রদান কার্যক্রম। এছাড়াও হাসপাতালে রয়েছে পর্যাপ্ত ওষুধ এর সাপ্লাই যাতে নাগরিকরা বেশ উপকৃত হচ্ছেন।
সেবাগ্রহীতা হিসেবে ২ জন কিশোরী চৈতি মন্ডল এবং নুরুন্নাহান নিশাত জানান, তারা বিভিন্ন সময় এসআরএইচআর সম্পর্কিত সেবা নিতে মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে গিয়ে বেশ ইতিবাচক সেবা পেয়েছেন। শুধু তাই নয় গোপনীয়তা রক্ষা করে তাদের চিকিৎসা সেবা সংক্রান্ত পরামর্শ প্রদানসহ বিনামূল্যে ওষুধও পেয়েছেন তারা। তবে পুরুষ সার্জন হওয়ায় তাদের কথা বলতে বেশ অস্বস্তিতে পরতে হয়েছিল কিন্তু দায়িত্বপ্রাপ্ত সকলের ভাল আচরণে তারা খুশি।
তবে নওগাঁয় কিশোর-কিশোরীদের বয়সন্ধি:কালীন চিকিৎসাসেবা এবং এসআরএইচআর সম্পর্কিত সকল সেবা আরও কিভাবে মানোন্নয়ন করা যায় সে প্রসঙ্গে নওগাঁ জেলা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক এস.এম আজাদ হোসেন মুরাদ জানান, নওগাঁ মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে কোন মহিলা সার্জন নেই। যাতে করে সাধারণ ডেলিভারির ক্ষেত্রে অনেকেই লজ্জায় একজন পুরুষ সার্জন এর নিকট যেতে চাইনা। এতে করে গরীব ও অসহায় জনগোষ্ঠী কিছুটা হলেও অপ্রকাশ্য ভোগান্তি পোহাচ্ছে। আবার যে সার্জন আছেন তিনিও অধিকাংশ সময় জেলার বাহিরে থাকে।
নওগাঁয় যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার নিয়ে কাজ করা ইয়েস বাংলাদেশের সদস্য মনিরা সুলতানা এবং শিশু সংগঠন এনসিটিএফ এর শিশু সাংবাদিক সুমিত কুন্ডুর সাথে পৃথকভাবে কথা বললে তারা জানান, তাদের জেলায় এসআরএইচআর সম্পর্কিত সেবা প্রদানের মান নানামুখী ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে। তারা নিজেরাও স্কোরকার্ড কর্মসূচীর মাধ্যমে কিশোর-কিশোরীর বয়সন্ধিঃকালীন সেবার সার্বিক বিষয়ে মনিটরিং কার্যক্রমও পরিচালনা করেন। তবে তারা যে প্রতিবন্ধকতা জেলা স্বাস্থ্যবিভাগে রয়েছে তা দ্রুততম সময়ে সমাধানেরও আহ্বান জানান।
সার্বিক বিষয়ে নওগাঁয় নব-যোগদানকৃত সিভিল সার্জন ডাঃ আবু হেনা মোহাম্মদ রায়হানুজ্জামান সরকার এর সাথে কথা বললে তিনি জানান, তিনি যোগদান করার পর থেকেই সার্বিক বিষয়েই খোঁজখবর নিচ্ছেন এবং স্বাস্থ্যবিভাগে মনিটরিং কার্যক্রম জোরদার করেছেন। জেনারেল হাসপাতালে পুনরায় কিশোর-কিশোরী কর্ণার স্থাপনেও তিনি উদ্যোগ নেবেন বলে জানান। এছাড়াও এসআরএইচআর বিষয়ে তিনি করণীয় সকল কিছুই ইতিবাচকভাবে করার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন।
দৈনিক চাঁদনী বাজার / সাজ্জাদ হোসাইন