প্রকাশিত : ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ১৬:০৮

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের পরোক্ষ ইঙ্গিতেই চলছে সারের সিন্ডিকেট

শুভ কুন্ডু, শেরপুর(বগুড়া)প্রতিনিধিঃ
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের পরোক্ষ ইঙ্গিতেই চলছে সারের সিন্ডিকেট

“সারের বরাদ্দে গাফিলতি নাকি কথিত সংকট? এ সম্পর্কে মিলেছে ভিন্ন ভিন্ন অভিমত। ডিলারদের কেউ কেউ বলছেন, কৃষি অফিস থেকে জরিপের মাধ্যমে সারের প্রকৃত চাহিদা দেয়া হচ্ছে না, বরাদ্দকৃত সারের তিনগুন চাহিদা রয়েছে। তবে এই মুহুর্তে সারের চরম সংকট না থাকলেও শেরপুরের প্রত্যন্ত কৃষকদের সার কিনতে হচ্ছে অতিরিক্ত দামেই। ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা চাচ্ছেন প্রমানপত্র। আর অতিরিক্ত দামে সার ক্রয়-বিক্রয়ের রসিদ না পাওয়ায় দিনের পর দিন চলছে এই সিন্ডিকেট যা ওপেন সিক্রেট।
বগুড়ার শেরপুরের সার ব্যবসায়ীদের এই সিন্ডিকেট দীর্ঘদিনের। সার পরিবহন ও বিতরণ ব্যবস্থায় সংশ্লিষ্টদের সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণের অভাবেই এই সিন্ডিকেট দিন দিন শক্তিশালী হচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ডিলার জানান, সারের পর্যাপ্ত বরাদ্দ না থাকায় বিভিন্ন এলাকা থেকে অতিরিক্ত দামে সার সংগ্রহ করে সরকার নির্ধারিত মূল্যের বাইরে বিক্রি করতে হচ্ছে। এতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও সারের সংকট নিরসনে সায় দিচ্ছেন।
প্রসঙ্গত, ২০০৯ সালে বিতরণ ব্যবস্থা কৃষক বান্ধব করার অভিপ্রায় নিয়ে ইউনিয়ন পর্যায় থেকে সার বন্টনের উদ্দেশ্যে গঠন করা হয় “সার ডিলার নিয়োগ ও সার বিতরণ সংক্রান্ত স্বমন্বিত নিতীমালা। যে নিতীমালার প্রথম বৈশিষ্ট খুচরা সার বিক্রেতার প্রচলন করা। নিতীমালা অনুযায়ী প্রতিটি উইনিয়নে একজন করে ডিলার এবং প্রতিটি ওয়ার্ডে একজন করে কার্ডধারী খুচরা বিক্রেতা থাকার কথা। নিতীমালায় স্ব স্ব ইউনিয়নের নিয়োগপ্রাপ্ত ডিলারদের স্ব স্ব ইউনিয়নের মধ্যে সহায়ক বিতরণ কেন্দ্র স্থাপন করে সার বিতরণ করার কথা। ডিলারদের নিকট থেকে সার সংগ্রহ করে খুচরা বিক্রেতা কৃষকের নিকট সার বিক্রয়ের কথা। কিন্তু শেরপুর উপজেলায় এ নিতীমালার কোনো রকম তোয়াক্কা না করেই দীর্ঘদিন যাবৎ চলছে বিতরণ কার্যক্রম। শেরপুরে উপসহকারি কৃষি কর্মকর্তা (বিএস) হিসেবে দায়িত্বে আছেন ২৪ জন। সে হিসেবে প্রতি ইউনিয়নের জন্য ২/৩ জন করে দায়িত্বে থাকার কথা।

কুসুম্বী ইউনিয়নের বেলঘরিয়া বাজারের ৫নং ওয়ার্ডের কার্ডধারী খুচরা সার বিক্রেতা মো: তোফায়েল আহম্মেদ বলেন, আগস্ট মাসে ডিলারের কাছ থেকে সার পেয়েছি শুধু ২০ বস্তা ইউরিয়া। তিনি বলেন, এই ইউনিয়নের বিতরণকৃত সারের সর্বোচ্চ ৫০/৭০ পার্সেন্ট কৃষক পাচ্ছে আর বাদবাকী বাহিরে বিক্রি হচ্ছে ব্লাকে। আমার চাহিদা পূরণ করতে আমিও বাধ্য হয়ে ব্লাকে বেশি দামে কিনে ১৪শ টাকা প্রতি বস্তা ইউরিয়া বিক্রি করছি।
ওই বাজারের ৬নং ওয়ার্ডের খুচরা সার বিক্রেতা মো: কামাল জানান, ডিলারের কাছ থেকে ১০/১২ বস্তা ইউরিয়া পেয়েছি, এর বাইরে সাধারণত নন্দীগ্রাম থেকে ব্লাকে সার নিয়ে এসে বিক্রি করি। তিনি বলেন, নন্দীগ্রাম থেকে ১১৮০ টাকায় প্রতিবস্তা ইউরিয়া কিনেছি।
এছারাও ওই বাজারে একাধিক কার্ডবিহীন খুচরা ব্যবসায়ী রয়েছে। কার্ডবিহীন খুচরা ব্যবসায়ীদের একজন মো: আবু রায়হান বলেন, শেরপুর থেকে ভুটভুটি ও ভ্যানওয়ালার মাধ্যমে সার বেশি দামে নিয়ে আসতে হয়। ডিলাররা এদের মাধ্যমে সার বেশি দামে বিক্রি করেন। আমরাও অবৈধভাবে কিনেই সার বিক্রি করছি। একাধিক লাইসেন্স বিহীন খুচরা ব্যবসায়ী জানান, উপজেলা কৃষি অফিসে বছরের পর বছর ধর্ণা দিয়েও খুচরা বিক্রেতার কার্ড করতে পারিনি। তারা শুধু আশ^াস দিয়ে সময় ক্ষেপণ করছেন।
ভবানীপুর ইউনিয়নের ছনকা বাজারের বিএডিসি ডিলার মো: মোখলেছুর রহমান বলেন, শেরপুর থেকে বিভিন্ন ডিলারদের কাছ থেকে ইউরিয়া কিনে বিক্রি করি। ব্লাকে ছাড়া সার পাই না। ডিলারদের কাছ থেকে চাইলে তারা ২/৪ বস্তা দিয়ে ডানবাম থেকে সংগ্রহ করতে বলেন। আমরাও ব্লাকে সংগ্রহ করেই বিক্রি করি। গতদিন শেরপুরের এক ডিলারের কাছ থেকে অতিরিক্ত দামে কিছু ইউরিয়া সংগ্রহ করেছি।
পুরো উপজেলা জুড়েই চলছে সারের এই কালোবাজারি। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সবকিছু দেখেও না দেখার ভান করছেন। তাহলে কি বরাদ্দের মালগুলো বাহিরে বিক্রি হচ্ছে? নাকি বরাদ্দেই গাফিলতি? কৃষি অফিস বলছে, শেরপুরে আমন মৌসুমে মোট জমি চাষাবাদ হচ্ছে ২৫ হাজার ৫৮২ হেক্টর এবং লক্ষমাত্রা ২১ হাজার ৮৬০ হেক্টর। আগস্ট মাসে মোট সারেরে চাহিদা ছিলো ১ হাজার মেট্রিকটন যার মধ্যে পূরণ হয়েছে ৯০৭ মেট্রিকটন।
এ বিষয়ে কুসুম্বী ইউনিয়নের বিসিআইসির ডিলার মো: শফিকুল ইসলাম শিরু বলেন, সারের কোনো সংকট নাই। সারের কৃত্তিম সংকট তৈরী করছে কৃষকরাই। ইউনিয়নে সহায়ক বিতরণ কেন্দ্র স্থাপনের বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের ইউনিয়নে বিতরণ কেন্দ্র আছে কিন্তু কৃষকদের জন্য শহর থেকে সার সংগ্রহ করাই সুবিধাজনক হয়। এখানে কোনো সিরিয়াল দিতে হয় না। বরং ইউনিয়নে সার বিতরণ করতে গেলেই সমস্যায় পরতে হয়।
শেরপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোছা: সারমিন আক্তার চাঁদনী বাজারকে জানান, ইউনিয়ন থেকে সার বন্টন ও বিতরণ কেন্দ্র স্থাপন এবং খুটরা বিক্রেতাদের নিয়মিত সার দেওয়ার ব্যপারে ডিলারদেরকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ওয়ার্ড পর্যায়ে খুচরা বিক্রেতাদের তালিকা হালনাগাদ করা হয়নি।

এ বিষয়ে শেরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো: ময়নুল ইসলাম বলেন, অতিরিক্ত দামে সার বিক্রির কোনো তথ্য জানা নেই। এ বিষয়ে আমাদের মনিটরিং অব্যাহত আছে, সুনির্দিষ্ট তথ্য পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে। তিনি জানান, অতি দ্রুত ওয়ার্ড পর্যায়ে খুচরা বিক্রেতা নিয়োগের সার্কুলার দেওয়া হবে এবং ডিলারদেরকেও ইউনিয়নে বিতরণ কেন্দ্র স্থাপনের ব্যপারে নির্দেশনা দেওয়া হবে।

 দৈনিক চাঁদনী বাজার / সাজ্জাদ হোসাইন

উপরে