প্রকাশিত : ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ০০:১৬

নওগাঁয় হতদরিদ্রদের ক্ষুধা মেটাতে ফ্রেন্ডস প্যানেলের এক টাকায় আহার

নওগাঁ প্রতিনিধি
নওগাঁয় হতদরিদ্রদের ক্ষুধা মেটাতে ফ্রেন্ডস প্যানেলের এক টাকায় আহার

নওগাঁয় ফ্রেন্ডস প্যানেল নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের উদ্যোগে হতদরিদ্র ও অসহায় মানুষদের ক্ষুধা মেটাতে ১ টাকায় ১ বেলা ভরপেট খাবারের আয়োজন করা হয়েছে। শুক্রবার (০৯ সেপ্টেম্বর) দুপুর ২টার দিকে শহরের বাটার মোড় আসমান সিটি শপিং মলে দেড় শতাধিক হতদরিদ্রদের নিয়ে এই মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন করা হয়।
সরেজমিনে জানা যায়, ২০১৬ সালের ১২ ডিসেম্বর ৩৯ জন সদস্য নিয়ে “ফ্রেন্ডস প্যানেল” নামে একটি স্বেচ্ছসেবী সংগঠন আত্মপ্রকাশ করে। এরপর থেকেই সংগঠনটি নওগাঁ পৌরসভার বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি, শীতবস্ত্র বিতরন, ১ টাকায় ফল বিতরন, ১ টাকায় ডাব বিতরন, মানবতার দেয়াল, করোনাকালীন সময়ে সুরক্ষা সামগ্রী বিতরনসহ নানাবিধ সমাজসেবামূলক কাজে অংশ নেয়। শহরজুড়ে তাঁদের সাংগঠিক কার্যক্রম সুধীজনদের নজরে আসায় সম্প্রতি তাঁদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে কিছু ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান। যাদের আর্থিক সহযোগীতায় এবং সদস্যদের চাঁদা আদায়ের মাধ্যমে ১৩ মে থেকে নিয়মিত প্রতি সপ্তাহে শুক্রবার দিন জুমআ’র নামাজ শেষে দেড় শতাধিক হতদরিদ্রদের ১ টাকায় ১ বেলা ভরপেট খাবারের আয়োজন করা হচ্ছে। খাবারের আয়োজনে ভাতের সাথে থাকছে মুরগীর মাংস, মুরগীর রোস্ট, ডিম-আলু তরকারী। আবার কখনো কখনো থাকছে ঝাল বিরিয়ানী ও মাছের ভূনা। অর্ধাহারে অনাহারে থাকা মানুষরা এক বেলা খাবারের আশায় শহর ও পাশ^বর্তী বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রতি শুক্রবার ছুটে আসছেন বাটার মোড় আসমান সিটি শপিং মলে। সেখানে রান্না শেষে তাঁদের মাঝে ১ টাকার বিনিময়ে স্বযত্নে খাবার পরিবেশন করছেন স্বেচ্ছাসেবীরা।
শহরের কাঁঠালতলী মহল্লা থেকে আসা দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ভিক্ষুক নজরুল ইসলাম বলেন, স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে ঘুরে ভিক্ষা করছি ৩০ বছর হলো। ভিক্ষার টাকা দিয়ে সন্তানদেরকে খাইয়ে বড় করে তুলেছিলাম। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হওয়ায় এবং ভিক্ষুক হওয়ায় তারা সবাই আমাদেরকে ছেড়ে চলে গেছে। এখন বয়সের ভারে নড়তে চড়তেও কষ্ট হয়। তাই আর আগের মতো ভিক্ষা করতেও পারিনা। প্রতি সপ্তাহে স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে এখানে খেতে আসি। ১ টাকার বিনিময়ে পেট ভরে খেতে পারি। এই খাওয়া দিয়েই দিন পার করে দিই।
পার নওগাঁ বউ বাজার মহল্লা থেকে আসা বৃদ্ধা ভিক্ষুক মাজেদা বেওয়া বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বামীকে হারিয়েছে। দুই মেয়ে বিয়ের পর স্বামীর ঘরে চলে গেছে। কেউই আমার খোঁজখবর নেয় না। তাই বাধ্য হয়ে ভীক্ষায় নেমেছি। প্রতি শুক্রবার সকাল থেকে ভিক্ষা করার পর দুপুরের মধ্যেই এখানে চলে আসি। মুরগীর মাংসসহ ভালো ভালো খাবার তৃপ্তি মতো খেতে পারি। আমাদের কথা এই সমাজের কেউই ভাবে না। অথচ এসব অল্প বয়সী ছেলেগুলো ভাবছে। আল্লাহ এদের মঙ্গল করুক।
সদর উপজেলার দুবলহাটি ইউনিয়নের দুবলহাটী গ্রাম থেকে আসা রিক্সা চালক আব্দুস সামাদ বলেন, ২৪ বছর যাবত পায়ে ঠেলা রিক্সা চালাই। সংসারে ২টা মেয়ে ছিলো। তাঁদের বিয়ে দিয়েছি। এখন ১২ বছর বয়সী একটা ছেলে আছে। ছেলের পড়ালেখার খরচ চালাতে গিয়ে দ্রব্যমূল্যের এই উর্ধ্বগতির বাজারে হিমশিম খাচ্ছি। বেশিরভাগ সময়ই ১ বেলা খেয়ে অর্ধাহারে অনাহারে থাকতে হয়। এই পথ দিয়ে যাচ্ছিলাম। খুব খিদে লেগেছিল। কিন্তু সকাল থেকে তেমন ভাড়া না পাওয়ায় খাবার কিনে খাওয়ার মতো টাকা কাছে নেই। রাস্তায় দেখলাম লাইন ধরে সবাই মার্কেটের ভেতরে খেতে ঢুকছে। তাই আমিও এসে পেটপুরে খেলাম।
ফ্রেন্ডস প্যানেলের সাধারন সম্পাদক আলো হোসেন বলেন, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির কারণে দেশজুড়ে অনেক মানুষ এখন তাঁদের আয়-ব্যয়ের সমীকরন মেলাতে পারছেন না। এই সংকটকালীন মুহুর্তে সবচেয়ে বেশি কষ্টে আছেন হতদরিদ্র অহসায় মানুষরা। তাঁদের অনেকেই অর্ধাহারে অনাহারে দিন পার করছেন। তাই তাদের মুখে এক বেলা খাবার তুলে দিতে আমাদের এই ক্ষুদ্র উদ্যোগ। মানুষগুলো যখন ভরপেট খেয়ে তৃপ্তি পায়, তাঁদের মুখে অন্যরকম একটা খুশির ছাপ ভেসে উঠে। যা দেখেই আমরা তৃপ্তি পাই।
ফ্রেন্ডস প্যানেলের সভাপতি রিমন আলী বলেন, নিজ জেলায় সমাজসেবামূলক কাজ করার পাশাপাশি বন্যাকালীন মুহুর্তে দেশের বিভিন্ন জেলায় আমরা শুকনা খাবার বিতরন করে সাধারন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সাধ্যমত চেষ্টা করেছি। তবে ইচ্ছে থাকলেও মানুষগুলোর জন্য খুব বেশি কিছু করতে পারিনা। একটি মোবাইল দোকানে সেলস ম্যান হিসেবে কর্মরত আছি। কত টাকাই বা বেতন পাই। আমাদের অন্যান্য সদস্যরাও একই রকম। বেশিরভাগই মাধ্যমিকের গন্ডি পেরোয়নি। আমরা কেউই ধনী ঘরের ছেলে না। এখন কিছু কিছু ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান আমাদের সহযোগীতা করছে বলে এই যাত্রা অব্যাহত রয়েছে। ১ টাকায় আহারের ধারাবাহিক কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে সমাজের বিত্তবানদের সুদৃষ্টির পাশাপাশি সরকারীভাবে আর্থিক সহযোগীতা কামনা করেন তিনি।

 দৈনিক চাঁদনী বাজার / সাজ্জাদ হোসাইন

 

উপরে