প্রকাশিত : ১৪ জানুয়ারী, ২০২৩ ২২:৪৫

মামলার দৌরাত্ব রুখবে কে? এক দ্বন্দ্বে ১৫ মামলা

শ্যামল রায়, স্টাফ রিপোর্টার :
মামলার দৌরাত্ব রুখবে কে? এক দ্বন্দ্বে ১৫ মামলা

দবির উদ্দিনের বয়স ৮০ ছুঁই ছুঁই। স্ত্রী সালেহা বেগমের বয়স ৭০ এর কোটায়। এই দম্পতির রয়েছে পাঁচ সন্তান। বড় ছেলে সানোয়ার, মেজো মনোয়ার, ছোটো আ. রশিদ এবং কন্যাদের মধ্যে বড় বেবি বেগম ও ছোট মাসুমা। অন্যের বাড়িতে কাজের পাশাপাশি নিজের ২ একর ৪০ শতক জমিতে চাষাবাদ করত। বড় ছেলে সানোয়ারকে বিয়ে করান একই গ্রামের আফরোজা বেগমের সাথে। বাবার সাথে নিয়মিত সংসারের কাজ-কর্ম করতেন সানোয়ার। একন্ন পরিবারে কাজ-কর্মের দ্বন্দ্বে ছোট দুইজন মনোয়ার ও রশিদ বাড়িতে টিকতে পারেনি। বাড়ি থেকে বের হয়ে মামার বাড়িতে বসবাস করতে হয় তাদের। এর মাঝে পিতৃ ভক্তে মুগ্ধ হয়ে অন্য সন্তানের দিকে না তাকিয়ে পিতা দবির উদ্দিন বড় ছেলে সানোয়ারের নামে ১৯৮৭ সালে ১ একর সাড়ে ১৯ শতক জমি হেবার ঘোষণাপত্র করেন। এরপরে সংসারের আয় থেকে দুই বোন বেবি ও মাসুমার বিয়ে দেন। ধীরে ধীরে বয়সের ভারে কাজ-কর্মে অক্ষম দবির উদ্দিনের বাকি সম্পত্তি হাতানোর চেষ্টায় বড় ছেলে ও তার পরিবার ওঠে পড়ে লাগে। সম্পত্তি হাতাতে না পেরে অসহায় বাবা-মা’কেও বাড়ি থেকে বের হতে হয়। তাদের আশ্রয় হয় নানার বাড়িতে বসবাসকারী মনোয়ার ও আ. রশিদের সংসারে। এবার বৃদ্ধ দম্পত্তি তার অবশিষ্ট জমি-জমা এই দুই ছেলে ও দুই মেয়েকে দিতে অংশ অনুযায়ী ২০২১ সালে একটি হেবার ঘোষণা করেন। সেখানে বিপত্তি দেখা দেয়। বড় ছেলে প্রতিটি জমিই তার নিজের দাবি করতে থাকে। একাধিক গ্রাম্য শালিস শেষে অ্যাডভোকেটের (উকিল) উপস্থিতিতে ফারায়েজ মূলে জমির ভাগ-বাটোয়ারা হয়। সে অনুযায়ী শান্তিতে বসবাস করতে থাকে উভয়েই।
কিন্তু সে শান্তির পরিবেশ বিশৃঙ্খলায় রূপ নেয়। সানোয়ারের হেবার ঘোষণাপত্রে যে দাগ নম্বরের উল্লেখ নেই; সেই একটি পুকুর ও এর চারপাশের ফসলি জমির ১ একর ২০ শতক জমি দখলের পায়তারায় সংঙ্ঘবদ্ধ হামলা হয়। প্রথম ঘটনায় সানোয়ার বাদী হয়ে ২৫ জুলাই ২০২১ তারিখে মামলা নম্বর ৩৪/৩৬৮ এবং দবির গংরা আহত হয়ে হাসপাতালে থাকলে তাদের মামলা ২৮ জুলাই ২০২১ তারিখে ৪৬/৩৮০ রেকর্ড হয়। এর মাঝে এডিএম কোর্টে সাত ধারার মামলা হলে সেখানে শান্তি বজায় রাখার শর্তসাপেক্ষ সহি স্বাক্ষর করে সানোয়ার গংরা। সে রেশ না কাটতেই আবারও হামলায় মাথায় ধারালো অস্ত্রের আঘাতে ৩১টি সেলাই নিতে হয় সবার ছোটো বোন মাসুমাকে। তার সাথে মাথায় ১৬টি সেলাই নিতে হয় ছোট ভাই আ. রশিদকে; বড় বোন বেবির বাম হাত ভেঙ্গে যায়; বৃদ্ধ বাবা দবির উদ্দিন ও নাতনি মিতু আকতার ছেলা ফোলা জখম হতে রেহাই পায়নি। এ ঘটনায় ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২ সালে গোবিন্দগঞ্জ থানায় মামলা নং ২৩/৭৬ রেকর্ড হলে পুলিশ সানোয়ারকে গ্রেফতার করে জেল হাজতে পাঠায়। একই ঘটনায় সানোয়ারের স্ত্রী আফরোজা বেগম বাদী হয়ে গোবিন্দগঞ্জ থানা ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ সালে মামলা নং ৩২/৮৫ রেকর্ড করে। মামলার একাধিক আসামী মুমূর্ষূ অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থেকে বিজ্ঞ আদালতে জামিন লাভ করে। সেই শুরু কাউন্টার প্রতি কাউন্টার মামলার সংখ্যা গত ২ জানুয়ারি ২০২৩ এ সংখ্যা দাঁড়ায় ১৫ তে। এদিন সর্বশেষ ঘটনায় পুনরায় হাজতে যাওয়া সানোয়ারের স্ত্রী আফরোজা বেগম এর দায়ের করা মামলা নম্বর ৬/৬। এর মধ্যে বৃস্পতিবার (৫ জানুয়ারি) সানোয়ার আদালত থেকে জামিন নিয়ে শুক্রবার বেড়িয়ে আসে। আবারও হামলা-মামলা ও কাউন্টার এজাহারের শঙ্কায় বৃদ্ধ দবির গংরা।
বিগত সময়ের মামলাগুলোর সংক্ষিপ্ত বর্ণনায়- দবির গংরা বাদী হয়ে: পুকুর সহ জমিতে জোরপূর্বক সানোয়ার গংরা ঢুকতে না পারে সেজন্য আদালতে ১৬ নভেম্বর ২০২১ তারিখের মামলা নং ২৩১; বাড়ন্ত ধানগাছ কীটনাশক দিয়ে জ¦ালিয়ের দেওয়ার জন্য আদালতে ১৬ মার্চ ২০২২ তারিখে মামলা নং- ১৯০; পুকুরে মাছ গ্যাস ট্যাবলেট দিয়ে ধ্বংসের জন্য আদালতে ১৪ এপ্রিল ২০২২ তারিখে মামলা নং- ৩৩৪; হেবার ঘোষণাপত্র বাতিল চেয়ে আদালতের মামলা নম্বর ২৬৬ এবং সর্বশেষ মেকানিকের দোকানে থাকা জমি চাষের পাওয়ার টিলার জব্দ ও মারাপিটের জন্য ৩১ ডিসেম্বর ২০২২ তারিখে গোবিন্দগঞ্জ থানায় মামলা নম্বর ৫৯/৬৮৫।
অপরদিকে সানোয়ার গংদের দায়ের করা মামলা নম্বরগুলো হলো ২৫ জুলাই ২০২১ তারিখে মারামারি ঘটনায় ৩৪/৩৬৮; ২৬ আগস্ট ২০২১ তারিখে সিআর ২৯৮; ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ তারিখে ৩২/৮৫; ৮ জুন ২০২২ তারিখে সিআর ১৯৪; ১৫ জুন ২০২২ তারিখে সিআর ১৯৬; বাটোয়ারা মামলা নম্বর ২৩৯/২১। এছাড়াও পিবিআই তদন্তাধীন আরও দুটি মামলার কথা জানান ভুক্তভোগীরা। 
নাতিদীর্ঘ এ ঘটনা গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার কাটাবাড়ী ইউনিয়নের বিশুলিয়া গ্রামের মৃত ইনছের আলী মণ্ডলের পাঁচ পুত্রের সবার বড় দবির উদ্দিনের। সরেজমিনে দবির উদ্দিন, তার সন্তানদের এবং গ্রামবাসীর সাথে আমাদের প্রতিনিধিরা কথা বললে ওঠে আসে পরিবারটির আদ্যপান্ত। অসহায় ও অস্বচ্ছল একটি পরিবারের সদস্যদের দুটি ধারায় বিভক্ত হয়ে চলছে মামলা আর পাল্টা মামলার দৌরাত্ব। এতে রসদ যোগাচ্ছেন খোদ জনপ্রতিনিধি ও থানা প্রশাসনের ক্ষমতাবানরা। এমন কথাই বলছেন ভূক্তভোগীরা। তবে বার্ধক্যে ন্যুব্জ দবির উদ্দিন তার ছেলে,  মেয়ে, জামাই ও নাতি-নাতনিদের মামলা-হামলা থেকে রক্ষায় সকলের কাছে আকুতি জানান।
এসব মামলার বাদী-বিবাদী আর এলাকাবাসীর দাবি একটি সুযোগ সন্ধানী গোষ্ঠী বা কর্তা ব্যক্তি উভয়-পক্ষকে কু-পরামর্শে একাধিক ক্ষতি-হামলায় উৎসাহিত করে মামলার সংখ্যা বাড়িয়ে অর্থনৈতিক ফায়দা লুটছে। যেখানে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক কর্তাদের ইন্ধন রয়েছে। কখনো কখনো ইন্ধনদাতারা বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টির ক্ষেত্র তৈরি করছে। আদালতে বাটোয়ারা ও স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা চেয়ে উভয় পক্ষের মামলা থাকলেও মাঝ পথে ইউনিয়ন পরিষদ ও থানার পক্ষে একটি জিডি বা একটি আবেদনের অজুহাতে সুযোগ সন্ধানী নোটিশ করে ঘটনার নতুন মোড় দিচ্ছে। যেখানে দখলদারকেও অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বলা হচ্ছে। নয়ত দবির গংরা কোনো ফসল চাষ করতে না পারে তার ব্যবস্থা করার পায়তারা করা হচ্ছে। ফলে বাড়ছে মামলার সংখ্যা। যার সুষ্ঠু তদন্ত প্রয়োজন; বলছেন এলাকাবাসী।
এলাকাবাসীর দাবী দবির উদ্দিনের ২ একর ৪০ শতক জমি পৃথক দুটি হেবার ঘোষণায় দুটি পক্ষ ভোগ দখল করার কথা। কিন্তু সানোয়ার তার ১ একর সাড়ে ১৯ শতক জমি বহাল তবিয়তে ভোগদখল করলেও অপর পক্ষ তাদের জমিতে কোনো ফসল বা মাছ চাষ করতে পারছে না। বীজতলা থেকে বাড়ন্ত ফসল-পুকুরের মাছ রাতের আঁধারে কীটনাশক দিয়ে জ¦ালিয়ে বা ধ্বংস করা হচ্ছে। পেশীশক্তির প্রতিযোগিতায় প্রায়শই একাধিক আহতের ঘটনা ঘটছে। যা নিরসন করে উভয় পরিবারকে রক্ষায় এগিয়ে আসার দাবি এলাকাবাসী ও সচেতন মহলের। প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক কর্তারা এগিয়ে আসবেন কি?

দৈনিক চাঁদনী বাজার / সাজ্জাদ হোসাইন

 

উপরে