প্রকাশিত : ৪ আগস্ট, ২০২৪ ২৩:৪৭
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন
বগুড়ায় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনায় দুইজন নিহত, পুরো জেলা রনক্ষেত্র
নিজস্ব প্রতিবেদক
-04-08-2024.jpg)
বগুড়া শহরের সাতমাথায় আন্দোলকারীদের ছাত্রভঙ্গ করতে পুলিশ টিয়ারসেল নিক্ষেপ করে। ৪ আগস্ট, ২০২৪; ছবি: চাঁদনী বাজার
বগুড়ায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনায় দুইজন নিহত হয়েছে। গতকাল রবিবার সরকারের পদত্যাগের এক দফা কর্মসূচির অংশ হিসেবে বগুড়া শহরের সাতমাথাসহ বিভিন্ন স্থান অবরোধ করে আন্দোলনকারীরা। এসময় দফায় দফায় সংঘর্ষ হয় পুলিশ ও আন্দোলনকারীদের মাঝে। আন্দোলনকারীরা তিন থানায় হামলা, টিএন্ডটি, পিবিআই, সদর ভূমি অফিস, আওয়ামী লীগ কার্যালয়সহ সদর আসনের সংসদ সদস্য রাগেবুল আহসান রিপুর বাড়িতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। এছাড়া বিটাক বগুড়া কার্যালয়ের মেইন ফটকসহ কম্পিউটার হিউ মেডিকেল কন্ট্রোল রুমের দরজা-জানালা ভাঙচুর করে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ডাকা অসহযোগ কর্মসূচির কারণে স্থবির হয়ে পড়ে বগুড়া। এছাড়া ছাত্রদের এই আন্দোলনে বিএনপির শীর্ষ স্থানীয় নেতৃবৃন্দকে রাজপথে দেখা গেছে। তারাও ছাত্রদের সাথে বিক্ষোভে যোগ দেন।
এদিকে রবিবার বেলা ১১টা থেকে বগুড়া শহর ও আশপাশের এলাকা থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীরা মিছিল নিয়ে আসেন শহরের সাতমাথার দিকে। সকাল থেকে শহরের কলেজ বটতলা, ফুলবাড়ি, বিসিক, মাটিডালী, কলোনী, দত্তবাড়ি, ইয়াকুবিয়া মোড়, মফিজপাগলার মোড়, ঠনঠনিয়া, পলিটেকনিক, বনানী এলাকাসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলার প্রধান বন্দর গুলোতে মিছিল ও সড়কে আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করে আন্দোলনকারীরা। এসময় পুলিশের সাথে দফায় দফায় সংঘর্ষ বাঁধে ছাত্র-জনতার। পুলিশকে লক্ষ্য করে তারা ইট-পাটকেল ছোড়তে থাকে। পুলিশও তাদের ছত্রভঙ্গ করতে রাবার বুলেট, টিয়ারসেল ও সাউন্ডগ্রেনেড নিক্ষেপ করে।
এদিন শহরের সাতমাথায় আওয়ামী লীগসহ অঙ্গ-সহযোগি সংগঠনের নেতাকর্মীরা সকাল থেকে অবস্থান নেয়। আন্দোলনকারীরা শহরের সাতমাথায় আসার চেষ্টা করলে যুবলীগের সাথে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পরে আন্দোলনকারীরা তাদের হটিয়ে দেয়।
একপর্যায়ে আন্দোলনকারীরা বেলা ১২টার দিকে শহরের টেম্পল সড়কে অবস্থিত ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের টিএন্ডটি অফিসে প্রবেশ করে আগুন লাগিয়ে দেয়। এসময় সেখানে থাকা বেশ কয়েকটি গাড়ি ও মোটর সাইকেল, তারের স্তুপ, গার্ড রুম, গ্যারেজ ঘর ও সিসি টিভি ক্যামেরা আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয়। অপর দিকে শহরের বিসিক এলাকার পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এর অফিস ও ফুলবাড়ি পুলিশ ফাঁড়ির সামনের অংশ ভাংচুর করে। এরপর আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগ করে। এছাড়া সদর ভূমি অফিস, সদর আসনের সংসদ সদস্য রাগেবুল আহসান রিপুর বাড়ি ও গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। বিক্ষোভকারীরা এমপি রিপুর কাটনারপাড়া বাসভবনের আশপাশের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও ভাঙচুর করে। এদিন দুপুরে বিটাক বগুড়া কার্যালয়ের মেইন ফটকসহ কম্পিউটার হিউ মেডিকেল কন্ট্রোল রুমের দরজা-জানালা ভাঙচুর করে আন্দোলনকারীরা। আন্দোলনকারীরা বগুড়া সদর থানা, দুপচাঁচিয়া ও শেরপুর থানায় হামলা ও অগ্নিসংযোগ করে।
সংঘর্ষের ঘটনায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ২ জনের মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে একজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। নিহত একজনের নাম মুনিরুল ইসলাম (৩৪)। তার বাড়ি কাহালু উপজেলার বীরকেদার এলাকায়। মুনিরুল মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। অপর জনের পরিচয় এখনো পাওয়া যায়নি। এছাড়া সংঘর্ষে আহত হয়ে বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ৩২ জন চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
জানা গেছে, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনাকারীরা অসহযোগ আন্দোলনের ডাকে বগুড়া-নওগাঁ মহাসড়কের দুপচাঁচিয়া উপজেলার সামনে সকাল ১০ টার দিকে অবস্থান নেন। সেখানে বিক্ষোভ মিছিল করতে থাকেন। এসময় উত্তেজিত জনতা নেতাকর্মীদের উপস্থিতি টের পেয়ে আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে হামলা করে। পরে সেখানে থাকা একটি পুলিশ বক্স ভাঙচুর করা হয়। উপজেলা ভূমি অফিসসহ একাধিক সরকারি স্থাপনায় হামলা করা হয়। এ সময় পুলিশের সাথে আন্দোলনকারীদের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এক পর্যায়ে পুলিশ থানার মধ্যে অবস্থান নেন। তখন আন্দোলনকারীরা থানার গেট ভাঙচুরের চেষ্টা চালায়। পরে থানার মধ্যে থেকে পুলিশ আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করেন। আন্দোলনকারী ও পুলিশের সংঘর্ষের মধ্যে আহত হয়ে মুনিরুল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মারা যান।
বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মোছা. শামসুন্নাহার জানান, মুনিরুলের মাথায় গুলি লেগেছিল।
বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. আব্দুল ওয়াদুদ জানান, আহত অবস্থায় দুই যুবককে জরুরি বিভাগে আনা হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাদের মৃত ঘোষণা করেন। তবে তারা কি কারণে মারা গেছেন তা তিনি প্রাথমিক ভাবে নিশ্চিত করতে পারেননি। নিহতদের লাশ মর্গে রাখা হয়েছে।
এছাড়াও বগুড়ার শেরপুরে পুলিশ বক্সে আগুন ও থানা ঘেরাওয়ের চেষ্টাকালে সংঘর্ষে পুলিশ, সাংবাদিকসহ শতাধিক ছাত্র-জনতা আহত হয়েছেন। এরমধ্যে গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত ত্রিশজনকে স্থানীয় উপজেলা স্বাস্থ্যকমপ্লেক্সে ও বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতালে নেওয়া হয়। এছাড়া শহরের স্থানীয় বাসস্ট্যান্ডস্থ উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে ঢুকে ভাঙচুর চালায় আন্দোলনকারীরা। রবিবার বেলা এগারোটা থেকে শুরু হয়ে বিকেল চারটা পর্যন্ত দফায় দফায় এই হামলা-ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এসময় পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিনত হয়।
এদিন রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের ১৬ জেলায় বড় বাস-ট্রাক-মিনিট্রাক চলাচল বন্ধ ছিল। রাস্তায় ছোট ছোট যানবাহন চলাচল করলেও যাত্রী ছিল কম। আন্দোলনকারী বিভিন্ন সড়কে গাছের গুড়ি-বাঁশ ফেলে চলাচলা বাধা সৃষ্টি করে। এছাড়া সড়কে তারা টায়ার জ্বালিয়ে আগুন লাগিয়ে দেয়। এ কারণে জরুরি সেবার যানবাহন ছাড়া রাস্তা দিয়ে কেউ চলাচল করতে পারেনি। জেলার সহাসড়কে বড় যান চলাচলও দেখা যায়নি।
উত্তরবঙ্গ পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম জানান, উত্তরবঙ্গে প্রায় ৫০ হাজারের উপরে যানবাহন চলাচল করে। রাস্তায় গাড়ি চলাচল করার কারণে গত ১২ ঘণ্টার মধ্যে আমাদের আটটি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে। এই কারণে উত্তরবঙ্গের কোনো সড়কে আর বড় যানবাহন চলাচল করেনি।
বগুড়া জেলা পুলিশ সুপার জাকির হাসান জানান, বগুড়া সদর, দুপচাঁচিয়া ও শেরপুর থানায় হামলা করা হয়েছে। এছাড়াও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপর হামলা করা হয়। জেলার বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি স্থাপনাতেও হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।