প্রকাশিত : ৩০ আগস্ট, ২০২৪ ২২:০৫

নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে যত বাধা

বিভিন্ন দপ্তরে বাড়তি উৎকোচ গ্রহণের অভিযোগ
জালাল উদ্দিন, রংপুরঃ
নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে যত বাধা

নিত্যপন্য তৈরির কারখানা চালু করার পূর্বে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র,কলকারখানা অধিদপ্তরের সুপারিশপত্র,বিএসটিআই টেস্টিং সনদপত্র,সিটি কর্পোরেশন লাইসেন্স,ফায়ার সার্ভিস অফিসের প্রশংসাপত্রসহ বিভিন্ন ভ্যাট টেক্স দেয়ার রশিদ হাতে পাওয়ার পর পরেই মোটা টাকা জমা দিতে হয় 
জেলা প্রশাসক এর এলার ফান্টে।এতো কিছুর পরেও জেলা প্রশাসক কার্যালয় থেকে লাইসেন্স কিংবা ছাড়পত্র পাওয়া নিয়েও রয়েছে শঙ্কা।
উদ্যোক্তাদের অভিযোগ,বিভিন্ন দফতরের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন অনেকে । এছাড়াও অনেক উদ্যোক্তা হয়েছেন অর্থনৈতিক ভাবে ক্ষতির শিকার। ফলে নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি না হওয়ায় ক্রমাগত বাড়ছে বেকারত্ব।
নগরীর মুলাটোল এলাকার বাসিন্দা ইনি্জনিয়ার মনির হোসেন বলেন, আমি ছোট পরিসরে একটি ফুড ও আইসক্রিম ফ্যাক্টরি করার জন্য  অনেক কষ্টে ৫ লাখ টাকা জমিয়ে সেই টাকা দিয়ে বেশ কয়েকটি মেশিনসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ক্রয় করে কারখানা দেই। তবে সেই কারখানা চালু করার জন্য যখন বিএসটিআই, পরিবেশ অধিদপ্তর,ফায়ার সার্ভিস, সিটি কর্পোরেশনসহ ভ্যাট টেক্সের কাগজপত্র সংগ্রহ করতে উৎকোচসহ খরচ লাগে ৫ লাখ টাকার উর্দ্ধে। আমার পুরো কারখানায় মেশিনারি সরঞ্জাম ক্রয় করতে লাগেনি ৫ লাখ টাকা, অথচ প্রতিষ্ঠান চালু করার অনুমতি নিতে খরচ লাগছে ৫ লাখ টাকার উর্দ্ধে। আমি একজন সুশিক্ষিত বেকার যুবক এতো টাকা কোথায় পাবো।
নিউ জুম্মা পাড়ার বাসিন্দা মেহেদী হাসান মানিক বলেন, আমি রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করি। আমার ছোট থেকে ইচ্ছে আমি একটি জুসের কারখানা চালু করবো, যেখানে এলাকার বেকার লোকজনের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে সেই আশা আমার ভেস্তে গেছে। গত ২০২২সালের ফেব্রুয়ারিতে বাবার কাছ থেকে ৭ লাখ টাকা নিয়ে ঢাকা থেকে মেশিনারি জিনিসপত্র ক্রয় করে কারখানা দেই। এবং সেই কারখানা চালু করতে অনুমতি নিতে বিভিন্ন দফতরে নিয়মের বাহিরেও টাকা পরিশোধ করার পরেও ঘুরতে হচ্ছে বছরের পর বছর। এখন পর্যন্ত মুল লাইসেন্স পাওয়া যায়নি,আর লাইসেন্স না পাওয়ার কারণে মেশিনারি সরঞ্জাম গুলো দিনে দিনে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অপরদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন চিপস চানাচুর চকলেটসহ রুটি বিস্কুট ফ্যাক্টরির মালিক প্রতিবেদককে বলেন, আমরা যে ভাবে এই খাদ্য পণ্য তৈরি করি তাতে কোনো ভাবেই জনগণের স্বাস্থ্যের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এর পরেও ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে অযথা আমাদের জেল জরিমানা করানো হয়। এছাড়াও বিভিন্ন দফতরের লোকজন এসে চাঁদাবাজি করেন। প্রশাসনের যত্রতত্র মোবাইল কোর্ট আর বিভিন্ন দফতরে চাঁদা দিতেই সর্বশান্ত হয়ে যাই।
রংপুরের সুনাম ধন্য একজন বেকারির মালিক প্রতিবেদককে বলেন, আমার কারখানায় রুটি বিস্কুট কেক চানাচুরসহ লাচ্ছা সেমাই তৈরি হয় তবে এসব প্রত্যেক পণ্যের জন্য আলাদা আলাদা করে বিএসটিআই দফতর থেকে অনুমতি নিতে হয়। এতে একই কারখানায় এতো কিছুর অনুমতি নিতেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলে অনেকে। এই নিয়মগুলো সংস্কার করা দরকার বলে মনে করছেন তিনি।
পীরগঞ্জ রসুলপুরের ইট ভাটার মালিক রাঙ্গা মিয়া বলেন, আমি ইট ভাটার অনুমতি নিতে গিয়ে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের এলার ফান্টে টাকা দিতে লাগছে ৪৫ হাজার,ইট ভাটা মালিক সমিতিতে দেয়া লাগছে ১ লাখ ৯০হাজার, ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ট্রেড লাইসেন্স নিতে লাগছে ৫০ হাজার এছাড়াও ফায়ার সার্ভিস, পরিবেশ অধিদপ্তর, কৃষি কর্মকর্তা, কলকারখানার কাগজপত্র সংগ্রহ করতে খরচ গেছে আরও ৭ লাখ টাকা। একবছর হয়েগেছে এখন পর্যন্ত মুল লাইসেন্স পাইনি এ নিয়ে হতাশায় আছি।
তবে চাঁদাবাজি কিংবা বাড়তি উৎকোচসহ বছরের পর বছর ভুক্তভোগীদের হয়রানির বিষয়ে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডডর্স এন্ড টেস্টটিং ইনস্টিটিউট (বিএসটিআই) এর রংপুর বিভাগীয় উপ—পরিচালক মুবিন —উল ইসলাম উল্লেখিত অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, বর্তমানে আমাদের অফিসের এমন অভিযোগ বিরল। তবে আমি এই অফিসে আসার এখনো ৪৫ দিন হয়নি।আমার পূর্বে যিনি ছিলেন তার আমলে অবৈধ প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে ১৯১টি মামলা করানো হয়। একই কারখানায় তৈরি একই ক্যাটাগরির পণ্যের জন্য আলাদা আলাদা ভাবে সনদ বা অনুমতি নেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি প্রতিবেদককে বলেন,এই সবকিছুর বিষয়ে জবাবদিহি দিবেন নীতি নির্ধারকরা,আমরা উনাদের দিকনির্দেশনাকে প্রাধান্য দেই। তবে অনিয়ম দুর্নীতি প্রসঙ্গে কারো বিষয়ে অভিযোগ থাকলে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এসংক্রান্ত বিষয়ে রংপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা মুখ খুলতে নারাজ, তবে ঘুষ কিংবা স্বেচ্ছাচারিতা হয়না জানান পরিবেশ অধিদপ্তর রংপুর জেলার সহকারী পরিচালক বিজন কুমার রায়। এছাড়াও কলকারখানা অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস,ট্রেড লাইসেন্সসহ অন্যান্য সনদ প্রদানকারী সংশ্লিষ্ট দফতর কর্মকর্তারাও একই উক্তি দেন।
এবিষয়ে রংপুর জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের রেভিনিউ এক্সিকিউটিভ মেজিস্ট্রেট মাহমুদুল হাসান মৃধা বলেন,উদ্যোক্তাদের হয়রানি নয় বরং উৎসাহিত করার জন্য ইতিপূর্বে সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোকে দিকনির্দেশনা দেন জেলা প্রশাসক মহোদয়,যদিও প্রত্যেক অধিদপ্তর তাদের নিজস্ব নিয়ম অনুযায়ী চলে, তবে জেলা প্রশাসক কার্যালয় থেকে বলা হয়েছে কোনো উদ্যোক্তা যদি আবেদন করেন তাহলে সেই দিন থেকে আগামী ৭ কার্য দিবসের মধ্যে ছাড়পত্র দেয়া হয়।
এদিকে সচেতন মহল ও উদ্যোক্তাদের দাবি—কলকারখানা বা পণ্য উৎপাদনের জন্য সহজ শর্তে ব্যবসায়ীক কলকারখানার অনুমোদন দিলে নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি হবে ব্যাপক।এবং মানুষ সরকারি চাকরি নয়, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান করার জন্য ঝুকে পড়বে। 

 

উপরে