প্রকাশিত : ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ১৯:৩৯
চাঁদনী সাহিত্য

কোহিনুর বর্ষা হয়ে ফিরে আসে

ইসলাম রফিক -
কোহিনুর বর্ষা হয়ে ফিরে আসে
প্রতীকি ছবি।- nenearts.in

টানা তিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছে। বগুড়া ব্যাপিয়া, দেশ ব্যাপিয়া এই বৃষ্টি। আগেকার আমলের সাঁতা আসলে এখন আর  নেই। অনেকদিন পর টানা এই বৃষ্টি সাঁতা’র কথা মনে করে দেয়। বৃষ্টির আছে এক মোহনীয় শক্তি, মন খারাপ করে দেয়ার এই শক্তি প্রত্যেক মানুষকে বিরহী করে তোলে, কবি করে তোলে, প্রেমিক করে তোলে। এই ‘বৃষ্টি ভেজা রাতে তুমি চলে যেও না’ রুনা লায়লার গাওয়া আর অনজু ঘোষের অভিনয়ের এই গানটি বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের মনে অমর হয়ে গেথে আছে। বৃষ্টি এলেই রুনা লায়লা, বৃষ্টি এলেই অনজু ঘোষ সামনে চলে আসে। বৃষ্টি এলেই আর একজন চোখের সামনে এসে নাড়া দিয়ে যায়। চোখ ভরে যায়, চোখের আগুনে, চোখের ব্যথায়। 

আহা বৃষ্টি ! ছোট্ট অজপাড়া গাঁ আমাদের। শহর থেকে দূরে, উপজেলা থেকে দূরে, রামেশ্বরপুর কিংবা নাড়–য়ামালা হাট থেকে দূরে। নাড়–য়ামালা হাট থেকে যে রাস্তাটি সোনাপুর গ্রামের মধ্যে দিয়ে রামেশ্বরপুর হাটে গেছে তারই মাঝে আমাদের গ্রাম। বড় সাগাটিয়া। পশ্চিম পাড়া। সেখানে, সেই উর্বর মাটিতে কালেভদ্রে যে কজন প্রেমিকা জন্মগ্রহণ করেছেন তাদের মধ্যে তিনিও একজন। কোহিনুর। কহিনুর। পরের বানানে তার নাম। এই গ্রামে আজ থেকে একশ বছর আগে কিংবা তারও আগে নিশ্চয়ই কোন প্রেমিকা ছিলো, ছিলো কোন প্রেমিক। তার উত্তরসুরিই তো বর্তমান বহন করে চলেছে। যদি দেখা হতো আজ থেকে একশ বছর আগের সেই প্রেমিক—প্রেমিকার ! জানা যেতো তাদের প্রেমকাহিনী । তাহলে নিশ্চয়ই সেটাও হতো অমর প্রেমকাহিনী। ইতিহাসের খাতায় লেখা না হোক, গ্রামের মানুষের মনে মনে, হৃদয়ে হৃদয়ে স্থান করে নিতো। প্রেম চলে আসে আপনি আপনি। সকল মানুষই প্রেমে পড়ে জ্ঞাতসারে কিংবা অজ্ঞাতসারে, সকল মানুষই কষ্ট পায় সময়ে কিংবা অসময়ে। আমরা বিনা কারণেই প্রেমের নামে শপথ করি, আমরা বিনা কারণেই সংসার পাতি। মানুষের সকল প্রেম আর জীবন লুকিয়ে থাকে প্রভুর মায়ায়। 

বৃষ্টিমুখর দিনে পুরো সময় জুড়ে, পুরো হৃদয় জুড়ে বসে থাকেন তিনি। গ্রামের উচ্ছ্বল তরুণী। সময়ের চেয়ে বেশী বেড়ে ওঠা। সারাটা দিন, সারাটা দিনমান, সারাটা সন্ধ্যা, সারাটা সময় জুড়ে কহিনুরের পথচলা। পাড়ার সমবয়সী  ছেলেরা তার বন্ধু। কহিনুর ছাড়া আমাদের একদিনও চলে না। সকাল নাই, সন্ধ্যা নাই, স্কুল নাই, পড়া নাই। আমাদের একসাথে যাপন। একসাথে খেলাখুলা, চলাফেরা, ঘুরে বেড়ানো, স্কুলে যাওয়া, বৃষ্টির দিনে পুকুরে হরি হরি খেলা। হরি হরি খেলাচ্ছলে ডুব সাঁতারে কহিনুর কাছাকাছি আসা। এমনও দিনে মন পড়ে থাকে সাগাটিয়া গ্রামের আমাদের পুুকুরঘাটে, পাথারের জমির আইলে, স্কুলের হাঁটাপথে। বৃষ্টিমুখর দিনে ফ্যানের পাতা মাথায় করে আমাদের স্কুলে যাওয়া, বিলে নৌকায় চড়ে বৃষ্টিতে ভেজা। বৃষ্টি শেষ হয়, ভেজা শেষ হয় না, আমাদের প্রেম শেষ হয় না। বাড়ি তখন তো অচ্ছুৎ। বাড়ী তখন বাড়তি বেদনা, বাড়ি তখন একা করার কাটরা ঘর। পুরো দুপুর ধরে আমরা গান শুনি, সিনেমার গান, নব্বই দশকের সিনেমার গান। সকল গানের নায়িকা তখন কহিনুর, সকল গানের কলি কহিনুর। বৃষ্টির রাতে উঁচু স্বরে স্কুলের পড়া করি। পাড়ার ও প্রান্ত থেকে হয়তো শুনতে পাবে, হয়তো শুনতে পাবে না। তবুও তাকে শোনানোর জন্য, ভাল ছাত্র প্রমাণ করার জন্য পড়ি। সকল আলো নিভে যায়, মধ্য রাতে কুকুরের ঘেউ ঘেউ বাড়ে, চোরেরা দুপা, এক পা করে পাড়ার মধ্যে ঘুরে বেড়ায়। আমরা পড়ার নামে প্রেম করি, আমরা জেগে থাকার নামে প্রেম করি। সকালে কহিনুর এসে ডাক দিয়ে ঘুম থেকে তুলে দেয়। কোনদিন সকালে ঘুম থেকে তুলে না দিলে সুন্দর, শুভ্র সকালটা কেমন ম্যাড়ম্যাড় হয়ে যায়, অন্ধকার হয়ে যায়। কহিনুর তাই এখনো প্রতিবছর বর্ষা হয়ে ফিরে আসে। কহিনুরকে উৎসর্গিত বর্ষা নিয়ে লেখা কবিতাটি পড়ি—

আমরা জানি
অনেকটা মাদকতা আছে বর্ষার জলে
ফলে বর্ষাকাল আমাদেরকে আচ্ছন্ন করে 
প্রেম, বিরহ আর মায়ায়।

আর কতটুকু মাদকতা থাকলে
বর্ষার জলে আমাদের যৌথ স্নান হবে
বিরহীরা ক্লান্ত হবে, ক্লান্ত হবে....

এখনো বৃষ্টি হয় ঋতুবতী মাসে 
এখনো দেবদাস পড়ে কাঁদে পাড়ার ছেলেরা।

কে না জানে
বর্ষা বিরহী করে, কবি আর প্রেমিকদের
তাই এখানো বর্ষার অপেক্ষায় থাকে
প্রেমিক, বিরহী আর কবিরা।

তোমরা যদি সাগাটিয়া গ্রামে যাও, দেখতে পাবে একজন কহিনুর এখনো বিয়ে না করে অপেক্ষায় আছে। ভালবাসা বিলিয়ে দিতে দিতে সে এখন ভালবাসাহীন। সাগাটিয়া গ্রামের পথে পথে, পাথারে পাথারে, সকাল কিংবা সন্ধ্যায় একজনকে খুঁজে ফেরে। আমাদের সকল ব্যথা লুকিয়ে থাকে বৃষ্টির সন্ধ্যায়, আমাদের সকল প্রেম জেগে থাকে রাতের আলোয়। 

লেখক— 
সম্পাদক, লিটল ম্যাগাজিন 
সভাপতি, বগুড়া লেখক চক্র

উপরে