প্রকাশিত : ১৯ নভেম্বর, ২০২৪ ০০:৪৬

রংপুর শিশু হাসপাতালের স্বাস্থ্য সেবা থেকে বঞ্চিত শিশুরা।। বর্ণীল অবকাঠামো এখন যেন ভুতুরে বাড়ি

নিজস্ব প্রতিবেদক
রংপুর শিশু হাসপাতালের স্বাস্থ্য সেবা থেকে বঞ্চিত শিশুরা।। বর্ণীল অবকাঠামো এখন যেন ভুতুরে বাড়ি

শহীদ আবু সাঈদের রংপুরে বৈষম্যের আর এক নির্মম চিত্র। নির্মাণ কাজ শেষে ভবন হস্তান্তরের সাড়ে ৫ বছর পেরিয়ে গেলেও বহুল কাংখিত এবং র্দীঘ প্রত্যশিত ১০০ শয্যার বিশেষায়িত রংপুর শিশু হাসপাতালটি পূর্নাঙ্গ শিশু স্বাস্থ্য সেবা কার্যক্রম শুরুর অপেক্ষায় এখন অনিশ্চিত প্রহর গুনছে। হাসপাতালের স্বাস্থ্য সেবা থেকে র্দীঘদিন ধরে বঞ্চিত রয়েছে এই অঞ্চলের শিশুরা। সুদীর্ঘ সময় ধরে অব্যবহৃত থাকায় এর বর্ণীল অবকাঠামো সমুহে এখন ভুতুরে বাড়ির পরিবেশ বিরাজ করছে। এর অন্যান্য সামগ্রীও ক্রমান্বয়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, রংপুর শিশু হাসপাতালের কাংখিত শিশুস্বাস্থ্য সেবা আলোর মুখ দেখবে কবে ? ইতোমধ্যে হাসপাতালটি নির্মাণের সাড়ে ৫ বছর পেরিয়ে গেছে আবার সাবেক স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যান মন্ত্রীর উদ্বোধনের দেড় বছর অতিবাহিত হয়েছে। তারপরেও রংপুরে শিশু হাসপাতালের স্বাস্থ্য সেবা থেকে এই অঞ্চলের শিশুরা দীর্ঘদিন ধরে কাংখিত সেবা বঞ্চিত হয়ে আলোর মুখ দেখছে না।
সরেজমিন হাসপাতাল চত্বরে ঘুরে দেখা গেছে, বর্ণীল সাজে সজ্জিত রংপুর শিশু হাসপাতাল ভবনে যেন নির্জন এক ভুতুরে পরিবেশ বিরাজ করছে। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তত্বাবধানে এখানে সীমিত সেবায় বর্তমানে কেবল বর্হি-বিভাগ চালু রয়েছে। এজন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন আবাসিক চিকিৎসক, ৪ জন নার্স এবং নিরাপত্তা প্রহরীরা কর্মহীন অলস সময় পার করছেন। এই চত্বরে শিশুদের জন্য নির্মিত বিভিন্ন খেলার জমকালো রাইড গুলো দীর্ঘদিন ধরে অব্যবহৃত থাকায় এর অবকাঠামোসহ অন্যান্য সামগ্রী ধুলায় মলিন অবস্থায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
জানা যায়, প্রায় ২ কোটির অধিক জন অধ্যুষিত রংপুর বিভাগের শিশুদের বিশেষায়িত স্বাস্থ্য সেবার লক্ষ্যে মহানগরীর প্রাণ কেন্দ্রে পুড়াতন সদর হাসপাতাল চত্বরের প্রায় ১ দশমিক ৭৮ একর জমির উপর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে এবং স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের তত্বাবধানে সাড়ে ৫ বছর আগে রংপুর শিশু হাসপাতালটির নির্মান কাজ সম্পন্ন করা হয়।
সে সময় ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট এটির সকল ভবন হস্তান্তর করেন। এরপর করোনার ডামাডোলে এখানে শিশুদের চিকিৎসা সেবার কার্যক্রমের উদ্যোগ বন্ধ রেখে এটিকে করোনার বিশেষায়িত হাসপাতাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তবে করোনার প্রার্দূভাব অনেক আগেই মুছে গেলেও অজ্ঞাত কারণে শিশু হাসপাতালের কার্যক্রম আজও র্পূনাঙ্গ ভাবে চালু করা হয়নি। দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় ২০২৩ সালের ১৬ ই ফেব্রুয়ারী তৎকালীন সাবেক ’স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যান মন্ত্রী রংপুরে ১০০ শয্যার শিশু হাসতালটির ঢাকঢোল পিটিয়ে উদ্বোধন করেন। এর দেড় বছরেও হাসপাতালের কার্যক্রম শুরু হয়নি।
এই অঞ্চলের মানুষ আশায় বুক বেঁধে ছিল যে এবারে শিশু হাসতালটির স্বাস্থ্য সেবার কার্যক্রম আলোর মুখ দেখবে। তবে সে আশা এখন অফুরন্ত অনিশ্চয়তার প্রহর গুনছে। উদ্বোধনের দেড় বছর অতিবাহিত হলেও এখন পর্যন্ত এর প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির সংযোগ কিংবা প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ করে শিশুদের স্বাস্থ্য সেবার কার্যক্রম শুরু করা হয়নি।  
স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, রংপুরে পুড়াতন সদর হাসপাতাল চত্বরের প্রায় ১ দশমিক ৭৮ একর জমির উপর প্রায় সাড়ে ৩১ কোটি টাকা ব্যায়ে ২০১৭ সালের ২১ শে নভেম্বর এই শিশু হাসপাতালের নির্মান কাজ শুরু হয়। এর নির্মান কাজ ২ বছর সময় বেঁধে দেয়া হলেও ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান র্নিধারিত সময়ের আগেই এর কাজ সম্পন্ন করেন। ২০২০ সালের ৮ই মার্চ হাসপাতাল ভবনটি জেলা সিভিল সার্জনের নিকট হস্তান্তর করা হয়।

 

নবনির্মিত এই শিশু হাসপাতাল ক্যাম্পাসে তিনতলা বিশিষ্ট মূল হাসপাতাল ভবনের প্রতি তলায় ২০ হাজার ৮৮২ বর্গফুট আয়তন সহ মোট ৬২ হাজার ৮৪৬ বর্গফুট আয়তনের হাসপাতালের প্রথম তলায় জরুরী বিভাগ, বর্হি বিভাগ, চিকিৎসকদের চেম্বার ও প্যাথলজিক্যাল ল্যবরেটরীর ব্যাবস্থা রয়েছে। দ্বিতীয় তলায় অপারেশন থিয়েটার, ব্রোন ইউনিট এবং তৃতীয় তলায় শিশু ওর্য়াড এবং কেবিনের ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়া এখানে ৬ তলা বিশিষ্ট ডাক্তারদের আবাসিক ভবন এবং ষ্টাফ ও নার্সদের আবাসিক ভবন, তিন তলা বিশিষ্ট সুপারিনটেনডেন্ট কোয়াটার, দুই তলা বিশিষ্ট গ্যারেজ কাম ড্রাইভার কোয়াটার, কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সাপ্লাই সিষ্টেম, বিদ্যুৎ সাব ষ্টেশন, পানি ও পয়ঃ নিস্কাশন ব্যবস্থা, অভ্যন্তরীন সড়ক তৈরী করা সহ আনুষাঙ্গিক অবকাঠামো নির্মান করা হয়েছে। রংপুর শিশু হাসতালটি চালু হলে এখানে এই অঞ্চলের  শিশুদের বিনামূল্যে জটিল অপারেশন সহ বিশেষায়িত উন্নত চিকিৎসা সেবার  পরিকল্পনা রয়েছে।      
প্রকল্প অন্তর্ভূক্ত অবকাঠামো সমূহ নির্মানের পর করোনার প্রার্দূভাবের কারণে সে সময় এই হাসপাতালটিকে করোনা ডিটেকটিভ হাসপাতাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক এবং শূন্যের কোঠায় নেমে এলেও রহস্যজনক ভাবে দীর্ঘ দিনেও শিশু হাসতালের প্রয়োজনীয় জনবল এবং শিশু স্বাস্থ্য সেবার যন্ত্রপাতি সংযোজন করা হয়নি। এর ফলে রংপুর অঞ্চলের শিশুদের জটিল রোগের চিকিৎসার জন্য ঢাকা সহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছুটতে হচ্ছে। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সীমাবদ্ধ পরিসরে বর্তমানে এই অঞ্চলের শিশুদের চিকিৎসা সেবায় প্রয়োজনীয় জনবলসহ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সংকটে নাজুক অবস্থা বিরাজ করছে। এ কারণে এখানে শিশুদের মান সম্মত স্বাস্থ্য সেবা পাওয়া যাচ্ছেনা।

 এ ব্যাপারে রংপুরের সিভিল সার্জন ডাক্তার মোহাম্মদ মোস্তফা জামান চৌধুরী এই প্রতিবেদককে জানান, জুলাই মাসে রংপুরে যোগ দেয়ার পর ১০০ শয্যার শিশু হাসপাতাল চালুসহ স্বাস্থ্য খাতের বিভন্ন বিষয়ের সমস্যার ব্যাপারে বিগত ১৭ অক্টোবর/২৪ মন্ত্রণালয়ে লিখিত ভাবে অভিহিত করা হয়। এর প্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য অধিদফতরের নির্দেশনা অনুযায়ী এসবের বাস্তব চালচিত্র সম্বলিত একটি পরিদর্শন প্রতিবেদন তৈরী করে গত ৫ ই নভেম্বর অধিদফতরে প্রেরন করা হয়েছে। সেখানে উল্লেখ করা হয় যে দীর্ঘদিন ধরে অব্যবহৃত থাকায় এর অবকাঠামোসহ অন্যান্য সামগ্রী ক্রমান্বয়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় চাহিদাপত্র স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে মন্ত্রনালয়ে পাঠানো হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন সাপেক্ষে কর্তৃপক্ষ নির্ধারন করে  প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি এবং জনবল পাওয়া গেলেই এটি চালু করা হবে।  
এ ব্যাপারে রংপুর বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডাক্তার হারুন অর রশীদ প্রতিবেদককে জানান, ২ মাস পুর্বে রংপুরে যোগদান করে শিশু হাসপাতাল সরেজমিন পরির্দশন করেছেন। এর জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ, পরিচালনার জনবল ও কর্তৃপক্ষ নির্ধারন এবং চাহিদা র্নিধারন করে এসব বরাদ্দের জন্য মন্ত্রণালয়ে প্রয়োজনীয় চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে। দাপ্তরিক কাজ চলছে। মন্ত্রণালয়ের নতুন তথ্য অনুযায়ী রির্পোট তৈরী হয়েছে। তিনি স্বিকার করেন অব্যবহৃত থাকায় অবকাঠামোসহ অন্যান্য সামগ্রী ক্রমান্বয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।  

উপরে