প্রকাশিত : ২৮ নভেম্বর, ২০২৪ ১০:২৫

চলনবিলের মিঠা পানির শুঁটকি দেশের চাহিদা মিটিয়ে যাচ্ছে বিদেশে

উপজেলা সংবাদদাতা, তাড়াশ, সিরাজগঞ্জ
চলনবিলের মিঠা পানির শুঁটকি দেশের চাহিদা মিটিয়ে যাচ্ছে বিদেশে

দেশের উত্তর অঞ্চলের বৃহত্তর চলনবিলের মিঠা পানির মাছের শুঁটকি দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। দামের সাথে কদর বাড়ায় উৎপাদনও বেড়েছে । চলতি মৌসুমে চলনবিলে অঞ্চলে প্রায় ১৩৩ কোটি টাকার শুঁটকি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে এখানকার সুস্বাদু শুঁটকি এখন বিশ্ব বাজারে যাচ্ছে।
চলনবিল অঞ্চলের  আট জেলায় গত ৫ বছরে উন্মুক্ত জলরাশিতে দেশীয় মাছের শুঁটকির উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৫৬ দশমিক ৫৮ মেট্রিকটন। চলতি বছরের অক্টোবর থেকে শুরু হয়েছে শুঁটকি মৌসুম  চলবে জানুয়ারির শেষ পর্যন্ত। মৎস্যজীবীদের ভাষ্যমতে, চলনবিলে এবছর দুই দফায় বন্যা হয়েছে। দুই দফার পানিতেই প্রচুর পরিমাণে দেশীয় মাছ ধরা পড়েছে জেলের জালে। দেশীয় এসব মাছে কোনো প্রকার রাসায়নিকের মিশ্রণ ছাড়াই শুধু লবণ যুক্ত মাছ সূর্যের আলোতে শুকিয়ে শুঁটকি তৈরি করা হচ্ছে। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে অতিরিক্ত শুঁটকি বাণিজ্যিকভাবে ভারত ও মালয়েশিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে রপ্তানিও করা হচ্ছে। রাজশাহী বিভাগীয় মৎস্য অফিসের দেওয়া তথ্যমতে, চলতি মৌসুমে চলবিলের আট জেলায় ১ হাজার ৩২৪ দশমিক ৩৩ মেট্রিকটন শুঁটকি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এর মধ্যে নাটোরে ৮৫০ দশমিক ৩১, নওগাঁয় ২৩৪ দশমিক ৩১, পাবনায় ১৩৬ দশকি ৩১, সিরাজগঞ্জে ৬৩ দশমিক ১৫, রাজশাহীতে ১৩ দশমিক ৩০, বগুড়ায় ১০ দশমিক ৩২, জয়পুরহাটে ৪ দশমিক ১ এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় ৩ দশমিক ৬২ মেট্রিক টন শুঁটকি উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। ১ হাজার টাকা গড় কেজি দরে যার বাজার মূল্য প্রায় ১৩২ কোটি ৪৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা। ৮০০ বর্গমাইল আয়তনের চলনবিলে ৪২৮৬ হেক্টর আয়তনের নদী আত্রাই, নন্দকুঁজা, গুমানী, বড়ালসহ ১৬টি নদী, ১৭৫৭ হেক্টর আয়তনের ৩৯টি বিল, এবং ১২০ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের ২২টি খালের মিঠাপানিতে মেনি, পুঁইয়া, চিতল, ফোলি, চিংড়ি, ভেদা, বেলে, পাবদা, কাঁচকি, চাঁদা, মলা-ঢেলা, দাঁড়কিনা, বৌমা, ঘাড়ুয়া, ভাঙ্গন, কালিবাউশ, বাঁশপাতা, পুটি, শোল, বোয়াল ,শিং ,মাগুর ,টাকি , রুই, গজার,  পাঙাশসহ অন্তত ৪০ প্রজাতির মাছ মিলছে। বর্ষা মৌসুমে  এসব জলাশয় থেকে মাছ সংগ্রহ করে চলনবিলের পাবনার চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর, সুজানগর, নওগাঁর আত্রাই, মান্দায়, বগুড়ার নন্দীগ্রাম, সিরাজগঞ্জের তাড়াশ, রায়গঞ্জ, উল্লাপাড়া, শাহজাদপুর, নাটোরের সিংড়া ও গুরুদাসপুরসহ কয়েক শ চাতালে শুঁটকি তৈরি করা হয়। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত শুঁটকি তৈরিতে ব্যস্ত থাকেন কয়েক হাজার শ্রমিক। তবে চলনবিলের যে কয়টি চাতালে বড় পরিসরে শুঁটকি উৎপাদন করা হয়, তার মধ্যে নাটোরের সিংড়ার নিংগইন অন্যতম। আবার চলনবিলের মধ্যে নাটোরেই সবচেয়ে বেশি ৮৫০ দশমিক ৩১ মেট্রিকটন শুঁটকি উৎপাদন হচ্ছে চলতি মৌসুমে। দেশি মাছের মধ্যে শৈল, বোয়াল, চিংড়ি, শিং, চিতল, ট্যাংরা, পুঁটি, রুই, কাতলা, বাতাসী, মলা, টাকি, খলসে, গোলসা, পাবদা, গুচি, বাইনসহ নানা প্রজাতির মাছের বাহারি সব শুঁটকি তৈরি করেন উৎপাদনকারীরা। উৎপাদনকারীদের ভাষ্যমতে, মাছের আকার এবং মানভেদে শুঁটকির দাম পাইকারি বাজারেই ২০০ থেকে শুরু করে ৩ হাজার টাকা কেজিতে বিক্রি হয়। ভোক্তা পর্যায়ে এর দাম আরও বেশি। বিশেষ করে বিদেশে রপ্তানির ক্ষেত্রে মানসম্পন্ন শুঁটকির দাম বাড়ে কয়েক গুণ। 
মৎস্য অফিসের হিসেব মতে— শুঁটকির মধ্যে বোয়াল ২ হাজার, বড় শোল ১ হাজার ৬০০ থেকে ১ হাজার ৮০০, বড় টাকি ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৬০০, মাঝারি টাকি ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০, ছোট টাকি ৭০০ থেকে ৮০০, ছোট গুলসা ৭০০ থেকে ৮০০, চিংড়ি ৫০০ থেকে ৬০০, তারা বাইম ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা এবং বিভিন্ন আকারের পুঁটির শুঁটকি ৩০০ থেকে ৬০০ টাকা পর্যন্ত কেজি দরে পাইকারি বিক্রির আশা করা হচ্ছে।গুরুদাসপুরের নাসির উদ্দীন, সিংড়ার আবু বক্করসহ অন্তত ১০জন ব্যবসায়ী  বলেন, ব্যবসায়ীরা কষ্ট করে শুঁটকি উৎপাদন করে তার ন্যায্যমূল্য পান না। উৎপাদিত শুঁটকি বাজারজাত করার ক্ষেত্রে একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট তৈরি করেন। চলনবিলে উৎপাদিত শুঁটকির কদর বেশি হলেও উচ্চমূল্যের বাজারে উপযুক্ত দাম পাচ্ছেন না তারা। তাড়াশের মহিষলুটি শুঁটকি আড়তের সভাপতি মজনু সরকার  জানান, বর্ষা মৌসুমে চলনবিলে প্রচুর পরিমাণে শুঁটকি তৈরি হয়। কিন্তু সংরক্ষণাগার না থাকায় বছরজুড়ে শুঁটকি তৈরি করা সম্ভব হয়না। একারণে  চলনবিলে উৎপাদিত শুঁটকি প্রস্তুতের পরই সৈয়দপুরের পাইকারি মোকামে বিক্রি করা হয়। তবে পাইকারদের কাছে বিক্রি না করে সরাসরি বিদেশে রপ্তানি করতে পারলে উৎপাদনকারীরা শুঁটকি বিক্রি করে অধিক লাভবান হতেন। তারা সংরক্ষণাগার তৈরির পাশাপাশি সরাসরি বিদেশে শুঁটকি রপ্তানিতে সরকারের হস্তক্ষেপ দাবি করেন।
রাজশাহী বিভাগীয় মৎস্য অফিসের উপপরিচালক মো. আব্দুল ওয়াহেদ মোল্লা বলেন, চলতি মৌসুমে চলনবিলজুড়ে প্রায় ১ হাজার ৩২৪ মেট্রিক টন শুঁটকি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা আছে। মৎস্যভান্ডারখ্যাত চলনবিলের দেশি মাছ সুস্বাদু ও মানসম্পন্ন হওয়ায় বিদেশের বাজারে এর চাহিদা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাড়ছে শুঁটকির উৎপাদনও।

উপরে