প্রকাশিত : ১৮ ডিসেম্বর, ২০২৪ ০০:০৯

রাজশাহী মুক্ত দিবস আজ

রাজশাহী সংবাদদাতাঃ
রাজশাহী মুক্ত দিবস আজ

আজ ১৮ ডিসেম্বর (বুধবার) রাজশাহী মুক্ত দিবস। রাজশাহীবাসীর স্মৃতিপটে আঁচড় কেটে যাওয়া একটি উল্লেখযোগ্য দিন। এদিন পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী মুক্ত হয়েছিল রাজশাহী। ৫৩ বছর আগে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর এসেছিল বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল বিজয়। তবে রাজশাহীতে স্বাধীনতার সেই সূর্য কিরণের দেখা মেলে ১৮ ডিসেম্বর।

বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় আর আত্মপরিচয়ের ঠিকানা করে নেওয়ার অনুভূতিতে পুলোকিত হয়ে ওঠে রাজশাহীর মানুষ। মুক্তিকামী জনতার ঢল নামে প্রতিটি সড়কে। মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজশাহী অঞ্চলকে নেওয়া হয় ৭নং সেক্টরে। বিদেশি প্রতিনিধিদের পরিস্থিতি জানাতে মুক্তিযোদ্ধারা সীমান্ত পার হয়ে আসে।  একাত্তরের ১৭ জুন ২৩ জন মুক্তিযোদ্ধা রাজশাহী শহরে গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটিয়ে শুরু করে তাদের অ্যাকশন অপারেশন। পাকিস্তানি সৈন্য ও দোসরদের নির্যাতন হত্যাযজ্ঞ বাড়তে থাকে। রাজশাহীর নারীরাও অংশ নেন মুক্তিযুদ্ধে। কেউ সীমান্ত পার হয়ে ভূমিকা রাখেন, কেউ এ পারেই হয়ে ওঠেন দুঃসাহসিক গেরিলা।

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পাকিস্তানি সেনারা রাজশাহী পুলিশ লাইন দখল করার জন্য পুলিশের ওপর অতর্কিত গুলি বর্ষণ করে। এসময় পুলিশ সদস্যরাও পাল্টা গুলি চালায়। তারা রাজশাহী রেঞ্জের ডিআইজি মামুন মাহমুদকে পুলিশ সদস্যদের আত্মসমর্পণের এবং অস্ত্রাগারের চাবি হস্তান্তরের আদেশ দেয়। তিনি অসম্মতি জানান। এরপর সন্ধ্যায় পাকিস্তানি সেনারা আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পুলিশ লাইনের কাছাকাছি এসে কয়েকটি গুলি ছোঁড়ে। পাকিস্তানি বাহিনী পূর্ব দিক দিয়ে পুলিশ লাইনের দিকে এগোতে থাকে কিন্তু পুলিশ সদস্যদের প্রচণ্ড প্রতিরোধের মুখে পিছিয়ে যেতে বাধ্য হয়। ২৭ মার্চ সকাল থেকে আবারও পাকিস্তানি বাহিনীর তৎপরতা বাড়তে থাকে। সকাল ১০টায় পাকিস্তানি বাহিনীর এক কর্মকর্তা প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে মাইকের মাধ্যমে ‘ভাইয়ে ভাইয়ে’ আত্মঘাতি যুদ্ধ বন্ধের অনুরোধ জানান। পাশাপাশি আলোচনার মাধ্যমে শান্তি স্থাপন করতে বলেন।

কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনী তাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে। ২৮ মার্চ সকাল ১০টার দিকে পাকিস্তানি বাহিনীর একজন মেজর রাজশাহী জেলা প্রশাসকের সাহায্য নিয়ে গোলাগুলি বন্ধ করতে পুলিশ বাহিনীকে মাইকে আহ্বান করেন। পরে দুপুর ২টার দিকে পাকি বাহিনী মর্টার ও ভারি মেশিনগান নিয়ে তাদের ওপর অতর্কিতে হামলা করে। ঘটনার আকস্মিকতায় পুলিশের সদস্যরা দৌড়াদৌড়ি করতে থাকেন। যাঁরা বাংকারে ছিলেন, তাঁরা প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। সন্ধ্যার আগেই পুলিশ লাইনের নিয়ন্ত্রণ পাকিস্তানিদের হাতে চলে যায়। শেষ হয় রাজশাহীর প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধ। পুলিশ লাইনের ভয়াবহ যুদ্ধে শহিদ হন অন্তত ৬৯ জন পুলিশ সদস্য। এদের মধ্যে ১৭ জন শহীদ পুলিশ সদস্যের গণকবর রয়েছে পুলিশ লাইনের ভেতরে।

২৫ নভেম্বর পাকিস্তানি সৈন্যরা রাজশাহী মহানগরীর শ্রীরামপুর চরে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের জীবন্ত অবস্থায় বালির মধ্যে পুঁতে হত্যা করে। পরবর্তীতে একে ‘বাবলা বন’ হত্যাকাণ্ড নামে অভিহিত করা হয়। সবকিছু সহ্য করে স্বাধীন হওয়ার দিন গুণতে থাকেন রাজশাহীর মানুষ।

মিত্র বাহিনীর বিমানকে স্বাগত জানাতে সবাই তখন আকাশের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা  করতে থাকেন। সে সময় পাক সেনাদের বিমান বোমা ফেলতে থাকলো রাজশাহীতে। তবে লালগোলা সাব-সেক্টর কমান্ডার মেজর গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী ও শেখপাড়া সাব-সেক্টর কমান্ডার মেজর রশিদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা পাক সেনাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে মুক্ত করে ফেলে রাজশাহীর গ্রামাঞ্চল।

মহদিপুর সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর রাজশাহী অ্যাডভান্সের পরিকল্পনা নেন। তিনি ১৪ ডিসেম্বর চাঁপাইনবাবগঞ্জের রেহায় চরে শহীদ হন। মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনী রাজশাহীর দিকে দ্রুতগতিতে অগ্রসর হয়। ১৬ ডিসেম্বর পরাজয় বরণের পর যৌথ বাহিনীর এই অগ্রগামী দল পাকিস্তানি সৈন্যদের কাছ থেকে সাদা পাগড়ী ও আত্মসমর্পণের চিঠি নিয়ে রাজশাহী শহরে বীরদর্পে প্রবেশ করে।

এদিকে বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধাদের ফুলের পাপড়ি আর গোলাপ পানি ছিটিয়ে বরণ করে নেয়া হলো। বরণ করে নেয়া হলো মিত্রবাহিনীকেও। খাদ্য সংকট যাতে না হয়, সে জন্য বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ খাদ্য সামগ্রী সরবরাহ করতে থাকলো। অবাঙালি মহল্লা থেকে উদ্ধার করা হলো অস্ত্র। বিভিন্ন টর্চার ক্যাম্প, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উদ্ধার করা হলো নির্যাতিত নারী পুরুষদের। স্বজন ঘনিষ্ঠরা বধ্যভূমিগুলিতে স্বজনদের মরদেহ খুঁজতে থাকলো।

এরপর ১৭ ডিসেম্বর রাতে পাকিস্তানি আর্মিরা গোপনে নাটোর গিয়ে ১৮ ডিসেম্বর সকালে আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে মুক্ত হয়ে যায় রাজশাহী। রাজশাহীর ঐতিহাসিক মাদ্রাসা মাঠে জাতীয় সংগীত পরিবেশনের পর কমান্ডার মেজর গিয়াস উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী আনুষ্ঠানিকভাবে পতাকা তুলে রাজশাহীকে মুক্ত ঘোষণা করেন। তারপর কমান্ডার গিয়াস উদ্দিনকে এই অঞ্চল পরিচালনার জন্য প্রশাসকের দায়িত্ব দেয়া হয়।

উপরে