'মার্চ ফর গাজা' কর্মসূচি থেকে কী বার্তা দেওয়া হলো?

ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলি 'গণহত্যার' প্রতিবাদে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে 'মার্চ ফর গাজা' কর্মসূচিতে বিপুল সংখ্যক মানুষের সামনে ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয়। এতে গাজাবাসীর পাশে থাকার প্রতিশ্রুতিসহ বেশ কিছু ঘোষণা এসেছে।
ঘোষণাপত্রে ইসরায়েলের সঙ্গে সব ধরনের চুক্তি বাতিল ও সম্পর্ক ছিন্নের আহ্বান জানানো হয়েছে। পাশাপাশি চারটি স্তরে আলাদা দাবি ও অঙ্গীকার তুলে ধরা হয়।
'প্যালেস্টাইন সলিডারিটি মুভমেন্ট বাংলাদেশ' নামের একটি প্ল্যাটফর্ম ঘোষিত 'মার্চ ফর গাজা' কর্মসূচিতে ঘোষণাপত্র পাঠ করেন দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান।
পূর্বঘোষণা অনুযায়ী, বিকেল তিনটায় কর্মসূচি হওয়ার কথা ছিল। তবে সকাল থেকেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে উপস্থিত হতে থাকে অনেকে।
ফিলিস্তিনের পতাকা ও গাজায় ইসরায়েলি হামলার প্রতিবাদে নানা প্ল্যাকার্ড, ব্যানার, ফেস্টুন নিয়ে অনেককেই এই কর্মসূচিতে অংশ নিতে দেখা যায়।
এই কর্মসূচিতে অংশ নেয়া ব্যক্তিদের হাতে থাকা প্ল্যাকার্ড ও ফেস্টুনে ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি 'গণহত্যা' বন্ধ, ইসরায়েলি পণ্য বয়কট, আমেরিকা ও ভারতকে বয়কটেরও আহ্বান জানাতে দেখা যায় অনেককে।
কর্মসূচি মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি, হেফাজতে ইসলামের নেতাসহ কয়েকজন ইসলামি বক্তা এবং জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিব।
কর্মসূচিতে অংশ নিতে আসা কয়েকজন বিবিসি বাংলাকে বলেন, ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলি হামলা বন্ধের দাবি এবং মুসলিম বিশ্বকে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানাতেই এই কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন তারা।
বিপুল সংখ্যক মানুষের জমায়েত
নির্ধারিত কর্মসূচি শুরু হওয়ার সময় ছিল বিকাল তিনটা। তকে সকাল থেকেই খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে ঢাকা ও ঢাকার বাইরের বিভিন্ন এলাকা থেকে অনেকেই জড়ো হতে থাকেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এলাকায়।
দুপুর একটার আগেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যান মাঠ ছাপিয়ে মৎস্যভবন, শাহবাগ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা মানুষে পূর্ণ হয়ে যায়।
দুপুর দুইটার পর অনেকেই ঢুকতে পারেনি সোহরাওয়ার্দী উদ্যান মাঠে। তাদের অনেককে রাস্তায় প্রতিবাদী মিছিল করতে ও স্লোগান দিতে দেখা যায়।
এর আগে সকাল থেকে ঢাকার বিভিন্ন রাস্তায় বাস, মিনিবাস, মাইক্রোবাস, ট্রাক, মোটরসাইকেলে করে লোকজনকে এই মার্চ ফর গাজা কর্মসূচিতে অংশ নেয়ার জন্য যেতে দেখা যায়।
সাদিকুর রহমান নামে একজন বিবিসি বাংলাকে জানান, তিনি সকালে গাজীপুর থেকে বাসে চড়ে ঢাকায় এসেছেন এই কর্মসূচিতে অংশ নিতে।
গাজীপুর, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ জেলা থেকে অনেকে এসেছিলেন বাসে করে। ট্রেনে করেও অনেককে কর্মসূচিতে অংশ নিতে আসতে দেখা গেছে।
মুসলিম বিশ্বের সোচ্চার হওয়ার দাবি
এই কর্মসূচিতে অংশ নিতে যারা এসেছিলেন তাদের অনেকের হাতে ছিল ফিলিস্তিনের পতাকা। ইসরায়েলবিরোধী স্লোগান দিতে ও প্রতিবাদী নানা ধরনের ফেস্টুন বহন করতেও দেখা যায় অসংখ্য মানুষকে।
আল আমিন মল্লিক নামে একজন শিক্ষক এসেছিলেন এক কর্মসূচিতে অংশ নিতে।
তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, "এই প্রতিবাদ কর্মসূচির মাধ্যমে আমরা বিরোধী শক্তিকে জানিয়ে দিতে চাই আমরা মুসলিমরা এক ও অভিন্ন। এদের ভিন্ন করা যাবে না। ইসরায়েল যে ফিলিস্তিনের ভূমিকে রক্তাক্ত করছে আমরা সেখানে একটা ম্যাসেজ দিতে চাই- এই যুদ্ধ বন্ধ করতে হবে এবং ফিলিস্তিনকে স্বাধীন করতে হবে।"
এই কর্মসূচিতে অংশ নেন বাংলাদেশে অধ্যয়নরত ভারতের কাশ্মীর থেকে আসা মো. সোহেল।
তিনি বলেন, "আমাদের জায়গা থেকে আমরা এই প্রতিবাদ করে সারা বিশ্বকে একটা ম্যাসেজ দিতে চাই যে গাজাবাসীর পাশে সারাবিশ্বের মুসলমানরা রয়েছে।"
সুরাইয়া খাতুন নামে একজন বলেন, "ইসরায়েল যে অত্যাচার-নির্যাতন শুরু করছে তার বিরুদ্ধে অনেক অমুসলিম রাষ্ট্রও প্রতিবাদ জানাচ্ছে। কিন্তু আরব বিশ্বকে আমরা অনেকটা নীরব দেখছি। এটা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না।"
"আমরা চাই ইসরায়েলি এই নির্যাতন বন্ধ হোক। ফিলিস্তিন স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে থাকুক। খাদ্য-পানির সংকট এই কষ্ট মেনে নেয়া যায় না।" যোগ করেন তিনি।
মোহাম্মদ সুমন নামে একজন বলেন, "আমরা যেহেতু যাইতে পারতেছি না সেখানে, আমরা তাদের প্রতি সহমর্মিতা জানাতে এখানে এসে কর্মসূচি পালন করছি। আমরা এই কর্মসূচির মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে জানাতে চাই যে গাজাবাসীর ওপর অত্যাচার চলছে।"
ঘোষণাপত্রের দাবি ও অঙ্গীকার
ঘোষণায় জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশ্বের মুসলিম নেতা ও বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আলাদা আলাদা দাবি জানানো হয়। একই সাথে ইসরায়েলি পণ্য বয়কটসহ বেশ কিছু অঙ্গীকার করা হয়।
জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি ইসরায়েলি 'গণহত্যার' বিচার আন্তর্জাতিক আদালতে নিশ্চিত করা, হত্যা বন্ধে কার্যকর ও সম্মিলিত পদক্ষেপ গ্রহণ, ১৯৬৭ সালের পূর্ববর্তী ভূমি ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য বাধ্যবাধকতা তৈরি করা, পূর্ব জেরুজালেমকে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দেয়া এবং ফিলিস্তিনদের আত্মনিয়ন্ত্রণ, নিরাপত্তা ও রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার পথ উন্মুক্তের দাবি জানানো হয়।
মুসলিম নেতাদের প্রতি ইসরায়েলের সঙ্গে অর্থনৈতিক, সামরিক ও কূটনৈতিক সব সম্পর্ক ছিন্ন করা, বাণিজ্যিক অবরোধ ও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা; গাজার জনগণের পাশে চিকিৎসা, খাদ্য, আবাসন ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতাসহ সর্বাত্মক সহযোগিতা করা; আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইসরায়েলকে একঘরে করতে সক্রিয় কূটনৈতিক অভিযান শুরু করার আহ্বান জানানো হয়।
ভারতে মুসলিমদের 'অধিকার হরণ', বিশেষ করে ওয়াকফ আইনে হস্তক্ষেপের মতো বিষয়ে ওআইসি ও মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে দৃঢ় প্রতিবাদ ও কার্যকর কূটনৈতিক অবস্থান নেয়ার দাবি জানানো হয় ঘোষণাপত্রে।
একই সাথে বাংলাদেশি পাসপোর্টে 'একসেপ্ট ইসরায়েল' শর্ত পুনর্বহাল, ইসরায়েলকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি না দেওয়ার অবস্থান আরও সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করা, ইসরায়েলি কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যত চুক্তি হয়েছে তা বাতিল করা, রাষ্ট্রীয়ভাবে গাজায় ত্রাণ ও চিকিৎসা সহায়তা পাঠানোর কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া, সব সরকারি প্রতিষ্ঠানে এবং আমদানি নীতিতে 'জায়নবাদী কোম্পানির' পণ্য বর্জনের নির্দেশনা প্রদান, পাঠ্যবই ও শিক্ষা নীতিতে আল-আকসা, ফিলিস্তিন ও মুসলিমদের সংগ্রামী ইতিহাসকে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানানো হয়।