রংপুরে বাড়ছে জলাতঙ্কে আক্রান্তের সংখ্যা, সংকটে প্রতিষেধক টিকা

রংপুরে জলাতঙ্কে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। তবে সরকারিভাবে বিনামূল্যে দেওয়া জলাতঙ্ক প্রতিষেধক টিকার সরবরাহ বন্ধ থাকায় সাধারণ মানুষকে পড়তে হচ্ছে চরম ভোগান্তিতে।
জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় এই টিকার অন্যতম প্রাপ্তিস্থান হলেও বর্তমানে সেখানে সরবরাহ না থাকায় টিকাদান কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। কবে নাগাদ আবার কার্যক্রম শুরু হবে, তা নিশ্চিত করে জানানো হয়নি। বাধ্য হয়ে অনেকেই সিটি করপোরেশন বা ব্যক্তিগত উদ্যোগে টিকা নিচ্ছেন।
সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের এপ্রিল থেকে ১৫ জুন পর্যন্ত ৪ হাজার ৪২৪ জন জলাতঙ্কের প্রতিষেধক টিকা নিয়েছেন। কিন্তু বর্তমানে স্টক না থাকায় বিনামূল্যে টিকা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
চিকিৎসকদের মতে, জলাতঙ্ক একটি মারাত্মক ভাইরাসজনিত রোগ, যা প্রধানত কুকুর, বিড়াল, শিয়াল, বাদুড়, বানর ও অন্যান্য বন্য প্রাণীর কামড় বা আঁচড়ের মাধ্যমে ছড়ায়। আমাদের দেশে প্রায় ৯৫ শতাংশ জলাতঙ্কের ঘটনা ঘটে কুকুরের কামড় থেকে। সঠিক সময়ে প্রতিষেধক টিকা না নিলে এই রোগে মৃত্যুর ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি।
ভুক্তভোগীদের দুর্ভোগ
৯ বছরের শিশু ফারহানা জামান ফুল ঈদের আগের দিন চিকার কামড়ে আহত হয়। তার বাবা মেয়েকে নিয়ে সিভিল সার্জন কার্যালয়ে গেলে টিকার অভাবে ফিরে আসতে হয়। পরে সিটি করপোরেশন থেকে ১৪০ টাকা মূল্যে ছয় ডোজ টিকা সংগ্রহ করে চিকিৎসা নিতে হয়।
রংপুর নগরীর শাপলা চত্বর হাজীপাড়া এলাকার রুজিনা জামান রোজ জানান, "রাতে বাড়ি ফেরার পথে আমার মেয়েকে চিকা কামড় দেয়। পরদিন সিভিল সার্জন কার্যালয়ে গিয়ে টিকা না পেয়ে আমরা বাধ্য হয়ে সিটি করপোরেশন থেকে টিকা নিই।"
একই অভিজ্ঞতা জানান দিনমজুর আফজাল হোসেন, দেলোয়ার মিয়া ও লায়লা বেগম। সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে টিকা না পেয়ে তারা সবাই পরে সিটি করপোরেশনে গিয়ে প্রতিষেধক সংগ্রহ করেন।
সিটি করপোরেশনে বাড়ছে চাপ
রংপুর সিটি করপোরেশনের টিকাদান কেন্দ্র ঈদের দিন ব্যতীত প্রতিদিন খোলা থাকে। ইনচার্জ শরিফা বেগম জেবা জানান, “ঈদের আগ ও পরে রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। শিশু ও বয়স্করাই বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। মে ও জুন মাসের (২৬ তারিখ পর্যন্ত) মধ্যে প্রায় ৩,৬০০ জনকে টিকা দেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে বিড়ালের আঁচড়ের ঘটনা বেশি।”
সংক্রমণের ঝুঁকি ও প্রতিরোধ নিয়ে বিশেষজ্ঞ মত
রংপুর এনিমেল রেস্কিউ অ্যান্ড এডপশন নেটওয়ার্কের প্রতিষ্ঠাতা মুনতাসির সজীব বলেন, “জলাতঙ্ক শুধু কুকুর বা বিড়াল নয়, চিকা, বাদুড়, ইঁদুর, শিয়াল, খরগোশসহ বিভিন্ন প্রাণীর মাধ্যমেও ছড়ায়। তাই শুধু পোষা প্রাণী নয়, পথকুকুর ও বিড়ালের টিকাদানও জরুরি।”
তিনি জানান, তারা বিভিন্ন মহল্লায় কুকুরের বন্ধ্যত্বকরণ ও টিকা প্রদানের কাজ করছেন এবং রংপুর সিটি করপোরেশনে এ বিষয়ে একটি কর্মপরিকল্পনা জমা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখনো আশানুরূপ সাড়া মেলেনি। কর্মপরিকল্পনায় টিকাদান, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিতকরণ ও সচেতনতা কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. পলাশ কুমার রায় বলেন, “র্যাবিস ভাইরাসজনিত জলাতঙ্ক রোগ প্রতিরোধে সচেতনতা জরুরি। পোষা প্রাণী যেমন কুকুর ও বিড়ালের নিয়মিত টিকাদান এবং আঁচড় বা কামড়ের পর দ্রুত প্রতিষেধক গ্রহণ করতে হবে।” তিনি জানান, রংপুর সিটি করপোরেশন প্রতি মাসে গড়ে ৪৫০–৫০০ জনকে টিকা দেয়, যার প্রতিটির মূল্য ১৪০ টাকা।
প্রশাসনের অবস্থান
সিভিল সার্জন ডা. শাহীন সুলতানা জানান, “টিকার স্টক শেষ হয়ে গেছে। সংশ্লিষ্টদের বিলম্বে জানানোয় টিকা সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। বর্তমানে সীমিত কিছু টিকা শুধু ভিআইপি ব্যবহারের জন্য সংরক্ষিত আছে। সরবরাহ এলে কার্যক্রম পুনরায় চালু হবে।”
রংপুর জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. আবু ছাঈদ বলেন, "জেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগ থেকে কুকুর নিয়ন্ত্রণে এখন কোনো সরাসরি কার্যক্রম নেই। তবে রংপুর সিটি করপোরেশনকে আমরা একটি পরিকল্পনা দিয়েছি, যাতে জন্ম নিয়ন্ত্রণ ও টিকা কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত আছে।"
সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা উম্মে ফাতিমা বলেন, “বর্তমানে কুকুর টিকাদান বা জন্মনিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম চালু নেই। তবে কোনো সংস্থা অর্থায়ন করলে আমরা প্রস্তুত। এছাড়া জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে নিয়মিত ক্যাম্পেইন পরিচালিত হচ্ছে।”