প্রকাশিত : ১১ অক্টোবর, ২০২৫ ২৩:৪১
মতামত
এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের মর্যাদা ও অধিকার: রাষ্ট্রের দায়িত্ব
নিজস্ব প্রতিবেদক

ছবিতে এনটিআরসিএ ভবনের চিত্র ও ইনসেটে গাইবান্ধা ইসলামিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক ( আইসিটি) মো.শের আলী ।
বাংলাদেশের মাধ্যমিক (মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক) স্তরের শিক্ষাব্যবস্থার মূলভিত্তি গড়ে উঠেছে বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর। দেশের অধিকাংশ শিক্ষার্থী—প্রায় শতকরা ৮০ ভাগেরও বেশি—এইসব প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করে। একইভাবে এই স্তরে প্রায় ৯৭% শিক্ষক এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। তারা শিক্ষা বিস্তারে, আলোকিত মানুষ গড়ায় এবং জাতি গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এই শিক্ষকগণ দীর্ঘদিন ধরে বৈষম্য, অবহেলা ও আর্থিক অনিশ্চয়তার শিকার হয়ে আসছেন।
সরকারি ও এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের মাঝে পার্থক্য এখন প্রায় অন্যায়ের পর্যায়ে। সরকারি চাকরিজীবীরা মূল বেতনের ৪৫% বাড়ি ভাড়া ভাতা পেয়ে থাকলেও এমপিওভুক্ত শিক্ষক ও কর্মচারীরা পান মাত্র এক হাজার টাকা যা পরিচ্ছন্ন কর্মী থেকে শুরু করে অধ্যক্ষ পর্যন্ত সবার জন্য সমান। উৎসব ভাতা হিসেবে তারা পান মূল বেতনের মাত্র ৫০%, যেখানে সরকারি চাকরিজীবীরা পান ১০০%। সবচেয়ে বড় অন্যায় হলো—এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা পেনশন সুবিধা থেকে বঞ্চিত। অবসরের পর সামান্য অবসর ভাতা ও কল্যাণ তহবিলের টাকা পেতে তাদের অপেক্ষা করতে হয় বছরের পর বছর। অনেকে জীবিত অবস্থায় সেই অর্থও পান না, মৃত্যুর পর পরিবার অপেক্ষা করতে থাকে অনিশ্চিতভাবে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এই ‘বিমাতা সুলভ আচরণ’ শুধু আর্থিক বৈষম্য নয়, এটি মানসিক অপমানেরও সামিল। শিক্ষক জাতির বিবেক—এই বাক্যটি আজ অনেকাংশে ব্যঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষকদের সরলতা, নীরবতা এবং দায়িত্ববোধকে দুর্বলতা হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। অথচ এই শিক্ষকেরাই আগামী প্রজন্মকে অধিকার সচেতন, ন্যায়পরায়ণ ও নৈতিক মানুষ হিসেবে গড়ে তোলেন। কিন্তু যদি তারা নিজেরাই অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকেন, তবে কীভাবে শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের শিক্ষা দেবেন?
এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের প্রতি অবহেলা কেবল একটি শ্রেণির প্রতি অন্যায় নয়; এটি গোটা জাতির ভবিষ্যতের প্রতি অবহেলা। কারণ, শিক্ষক যদি সম্মান না পান, তবে শিক্ষার্থীও তাকে সম্মান করবে না। আর যে সমাজে শিক্ষক অবমূল্যায়িত, সেই সমাজে কখনোই জ্ঞান, ন্যায় ও নৈতিকতার চর্চা বিকশিত হতে পারে না। ফলস্বরূপ, তৈরি হবে বিশৃঙ্খল, মূল্যবোধহীন একটি জাতি।
রাষ্ট্রের দায়িত্ব কেবল শিক্ষা প্রদান নয়, শিক্ষকতা কে মর্যাদাপূর্ণ পেশা হিসেবে গড়ে তোলাও তার কর্তব্য। শিক্ষকরা যদি সমাজে যথাযথ মর্যাদা ও আর্থিক নিরাপত্তা পান, তবে তারা আরও নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও সৃজনশীলতার সঙ্গে শিক্ষাদান করতে পারবেন। তাই সরকারের প্রতি আহ্বান,
এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বেতন-ভাতা, বাড়ি ভাড়া, উৎসব ভাতা ও অবসর সুবিধা সরকারি শিক্ষকদের সমপর্যায়ে উন্নীত করতে হবে। এতে শুধু শিক্ষক নয়, গোটা জাতি উপকৃত হবে।
শিক্ষক সমাজের মেরুদণ্ড। মেরুদণ্ড ভেঙে গেলে শরীর যেমন অচল হয়ে পড়ে, তেমনি শিক্ষকদের অধিকার উপেক্ষা করলে একটি জাতিও পিছিয়ে পড়ে। তাই সময় এসেছে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের যথাযথ সম্মান ও অধিকার ফিরিয়ে দিয়ে শিক্ষাক্ষেত্রে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার। রাষ্ট্র যদি সত্যিই উন্নত, মানবিক ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনে বিশ্বাসী হয়, তবে শিক্ষকদের মর্যাদা রক্ষায় তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ গ্রহণ করাই তার সর্বপ্রথম দায়িত্ব।
মতামত লিখেছেন -
মো.শের আলী
সিনিয়র শিক্ষক ( আইসিটি)
গাইবান্ধা ইসলামিয়া উচ্চ বিদ্যালয়