প্রকাশিত : ৩১ জুলাই, ২০২৫ ০১:৫৫

বগুড়ায় আবাদি জমি কমলেও খাদ্য উৎপাদনে স্বাবলম্বী জেলা

এনামুল হক, বগুড়াঃ
বগুড়ায় আবাদি জমি কমলেও খাদ্য উৎপাদনে স্বাবলম্বী জেলা

জনসংখ্যা বৃদ্ধি, নগরায়ণ ও শিল্পায়নের ফলে ক্রমেই কমছে দেশের আবাদি জমির পরিমাণ, যার স্পষ্ট প্রভাব পড়ছে উত্তরবঙ্গের অন্যতম কৃষি সমৃদ্ধ জেলা বগুড়াতেও। গবেষণা বলছে, ২০০৮ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত দেশে প্রতিবছর গড়ে ০.২১ শতাংশ হারে আবাদি জমি কমেছে। তবে এই চ্যালেঞ্জের মাঝেও আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি ও বহুমুখী জমি ব্যবহারের মাধ্যমে বগুড়া জেলায় কৃষি উৎপাদন ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে—যা দেশের জন্য এক ইতিবাচক দৃষ্টান্ত।

আবাদি জমি হ্রাসের কারণ

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আবাদি জমি হ্রাসের পেছনে প্রধানত দায়ী জনসংখ্যা বৃদ্ধি, যেহেতু বাড়তি মানুষকে আবাসন ও অবকাঠামোর জন্য কৃষিজমি ব্যবহার করতে হচ্ছে। একইসঙ্গে শিল্পায়ন, নগরায়ণ, অনিয়ন্ত্রিত পুকুর খনন, নদীভাঙন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে জমির উর্বরতা হ্রাস পাচ্ছে।
বাংলাদেশ মৃত্তিকা সম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট (SRDI) জানিয়েছে, দেশের ৮৫ শতাংশ আবাদি জমির উর্বরতা হ্রাস পেয়েছে এবং ৩৮ শতাংশ জমিতে রয়েছে জৈব পদার্থের ঘাটতি—যা আগামী দিনের কৃষির জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ।

বগুড়ার কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি

বাংলার স্বাধীন সুলতান নাসিরউদ্দিন বগরার নামানুসারে নামকরণ হওয়া বগুড়া জেলা কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির অন্যতম শক্তিশালী কেন্দ্র। জেলার মোট জমির পরিমাণ ২,৮৯,৮৮২ হেক্টর, যার মধ্যে ২,২৪,৮৪০ হেক্টর জমিই আবাদযোগ্য। এ ছাড়া ৬৩৮ হেক্টর পতিত আবাদযোগ্য জমি, ১,৪৩১ হেক্টর বনভূমি এবং ভূমি ব্যবহারের ঘনত্ব ৭৭.৫৬ শতাংশ।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, জেলায় মাথাপিছু জমির পরিমাণ ০.২১ হেক্টর। অথচ জনসংখ্যা ঘনত্ব প্রতি বর্গ কিলোমিটারে প্রায় ১,২৮৮ জন (২০২২ সালের শুমারি অনুযায়ী)। জেলার মোট জনসংখ্যা প্রায় ৩৯,৯২,০০০ জন।

উৎপাদনে উদ্বৃত্ত

সব বাধা সত্ত্বেও বগুড়া এখনো খাদ্য উৎপাদনে স্বাবলম্বী। ২০২০-২১ অর্থবছরের তথ্য অনুযায়ী, জেলার মোট খাদ্য চাহিদা ৫৭৯,৫৭৩ মেট্রিক টন, আর উৎপাদন ১৪৪৯,৫৯৮ মেট্রিক টন—ফলে প্রায় ৬৬১,৫১০ মেট্রিক টন উদ্বৃত্ত খাদ্য উৎপাদিত হয়েছে।

এই সাফল্যের মূল কারণ হলো দুই ও তিন ফসলি জমির সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি। জেলায় প্রায় ৯০,২০০ হেক্টর দুই ফসলি এবং ১,১১,২৭৫ হেক্টর তিন ফসলি জমি রয়েছে।

প্রধান শস্যের মধ্যে রয়েছে ধান, পাট, গম, আলু, সরিষা ও মরিচ। বিশেষ করে লাল মরিচের উৎপাদনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে, যার বাজার মূল্য প্রায় ১০০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।

জমি কমছে জাতীয় গড়ের চেয়েও বেশি হারে

বিভিন্ন পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বগুড়ায় প্রতিবছর গড়ে ০.৭ শতাংশ হারে আবাদি জমি কমছে—যা জাতীয় গড়ের (০.২১%) তুলনায় প্রায় তিন গুণ বেশি।

শেরপুর উপজেলায়ও একই চিত্র

জেলার শেরপুর উপজেলার চিত্রও প্রায় একই। উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ২৯,৬৪০ হেক্টর আয়তনের উপজেলার মধ্যে আবাদি জমি রয়েছে ২৫,৫৭৮ হেক্টর। এর মধ্যে দুই ফসলি জমি ১৬,৫৯০ হেক্টর এবং তিন ফসলি ৩,৮৭৯ হেক্টর। উপজেলার জনসংখ্যা ৩,৭৭,৫৬১ জন এবং খাদ্য উৎপাদন ১,৬৪,৬২৭ মেট্রিক টন, যেখানে চাহিদা মাত্র ৬৯,৭৪৮ মেট্রিক টন—ফলে এখানেও উদ্বৃত্ত রয়েছে।

পরিকল্পিত ব্যবহারেই সমাধান

বগুড়া জেলা পরিসংখ্যান অফিসের উপপরিচালক মো. সোহেল রানা বলেন, “জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে কৃষি জমির উপর ব্যাপক চাপ পড়ছে। অনেক ক্ষেত্রেই কৃষিজমি অকৃষি কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে।” তবে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, “আধুনিক প্রযুক্তি এবং একাধিকবার চাষাবাদের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদনে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে।”

উপরে