বিমান ছিনতাই চেষ্টায় নিহত পলাশ আহমদ ছিলেন একজন ছদ্মবেশী প্রতারক। এইচএসসির গণ্ডি পাড়ি না দিয়েও নিজেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে পরিচয় দিতেন। ঢাকার উত্তরায় বাড়ি-গাড়িসহ বাবার অঢেল সম্পদ রয়েছে উল্লেখ করে একাধিক মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার চেষ্টা করতেন পলাশ।
একইভাবে বগুড়ার মেয়ে ফাতেমা নুসরাত জাহান মেঘলাকে ভালোবাসার জালে ফেলেন তিনি। বিয়ের পর তার মুখোশ উন্মোচন হলে নির্যাতনের শিকার হতে হয় মেঘলাকে। পলাশ এবং তার পরিবারের নির্যাতনের শিকার মেঘলা এক সময় আত্মহত্যার চেষ্টা করে মুক্তি পেতে চেয়েছিলেন।
সোমবার পলাশের সাবেক স্ত্রী ফাতেমা নুসরাত জাহান মেঘলার সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানান, একটি ভুল সিদ্ধান্ত তার এবং তার পরিবারের সুখগুলো কেড়ে নিয়েছে। মেঘলার পরিবারের সবাই উচ্চশিক্ষিত। শহরে নিজেদের বাড়ি ছাড়াও এই পরিবারের একটা সুনাম রয়েছে। তার বাবা অ্যাডভোকেট এবং মা উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত)। ২০১৩ সালে মেঘলা যখন অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্রী তখন ফেসবুকে পরিচয় হয় পলাশের সঙ্গে। মাত্র ৬ মাসের পরিচয়ে বাবা-মায়ের অমতে পালিয়ে পলাশকে বিয়ে করেন মেঘলা। পলাশ বলেছিলো তার বাবা বিদেশে থাকে। তাদের ঢাকায় বাড়ি রয়েছে। সেখানেই মেঘলাকে রাখবে। কিন্তু পালিয়ে ঢাকায় নিয়ে বিয়ের পর মেঘলাকে নিয়ে যাওয়া হয় নারায়ণগঞ্জের বাড়িতে।
মেঘলা জানান, শুরুতেই পলাশের খামখেয়ালিপনা তার কাছে ধরা পড়ে। তার বাউন্ডুলে স্বভাব এবং বাজে খরচের বিষয়টি জানার পরও সে চেষ্টা করেছিল তাকে সুপথে ফিরিয়ে আনার। কিন্তু পলাশ এবং তার বাবা-মায়ের শ্বশুরবাড়ির টাকার প্রতি লোভ ছিল। তাকে মানসিক নির্যাতন করা হতো সব সময়। বলা হতো বাবা-মা বড় লোক, যাও টাকা নিয়ে এসো। এসব কারণে মেঘলা পলাশের সঙ্গে তিন মাসের বেশি সময় কোথাও থাকতে পারেনি। মেঘলার বাবা-মা একপর্যায়ে ঢাকায় বাসা ভাড়া করে ঘরের সমস্ত আসবাবপত্র কিনে দিলেও পলাশের চাহিদা দিনদিন বাড়তে থাকে।
তিনি আরও জানান, এছাড়া অন্য মেয়েদের সঙ্গে তার অনৈতিক সম্পর্কের লিস্টও বড় হতে থাকে। সব কিছু সহ্য করে ঘর করার চেষ্টা করতে থাকেন মেঘলা। ২০১৭ সালের প্রথম দিকে ছেলে সন্তানের জন্ম দেন মেঘলা। ছেলের নাম রাখা হয় আয়ান। বগুড়ায় সর্বশেষ সেই সময় এসেছিলেন পলাশ। এরপর আর শিশুর মুখ দেখেননি। ছেলে হওয়ার সংবাদ পেয়ে পলাশ এবং তার বাবা-মা টাকার জন্য আগের চাইতে বেশি জোর করতে থাকে মেঘলার পরিবারের প্রতি।
মেঘলা জানান, মানসিক নির্যাতন সইতে না পেরে ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি সুইসাইড করার চেষ্টা করেন। পরিবারের সদস্যদের সহায়তায় বেঁচে যান। তবে এতো কিছুর পরও ফিরাতে পারেননি পলাশকে। ২০১৮ সালের শুরুর দিকে নিজের ফেসবুক ও ইউটিউবে চিত্রনায়িকা সিমলাকে বিয়ে করার সংবাদ দেয় পলাশ। এটি জানতে পেরে ২০১৮ সালের মার্চ মাসে পলাশকে ডিভোর্স দেন মেঘলা। এরপর থেকে সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ রাখেননি। এমনকি বিমান ছিনতাই চেষ্টায় পলাশের নিহত হওয়ার খবরটিও তিনি জেনেছেন এই প্রতিবেদকের কাছ থেকে।
মেঘলার মা জানান, মেয়ে ভুল করেছে, তার শাস্তিও পেয়েছে। এখন সে তার একমাত্র শিশু সন্তানকে নিয়ে বেঁচে থাকতে চায়। পলাশ এবং তার পরিবারের সঙ্গে অনেক আগে থেকেই তাদের সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও উপজেলার পিরোজপুর ইউনিয়নের দুধঘাটা গ্রামের পিয়ার জাহানের ছেলে পলাশ। তার বাবা ১৯৯০ সাল থেকে বিদেশে থাকতেন। প্রথমে কুয়েত এবং পরে সৌদি আরবে ছিলেন তিনি। প্রবাসী বাবার দেয়া টাকা-পয়সা নিয়ে উচ্ছৃঙ্খল জীবন-যাপন করতেন পলাশ। এর মধ্যে নাচগান থেকে শুরু করে চলচ্চিত্র শিল্পে জড়ান তিনি। কয়েকটি শর্টফিল্মও তৈরি করেন।
উল্লেখ্য, গতকাল রোববার সন্ধ্যায় ঢাকা থেকে দুবাইগামী বাংলাদেশ বিমানের ‘ময়ূরপঙ্খী’র ফ্লাইটটি (বিজি-১৪৭) ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে। প্রায় দুই ঘণ্টার শ্বাসরুদ্ধকর অভিযানে চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিমান ছিনতাই চেষ্টার অবসান হয়। কমান্ডো অভিযানে বিমান ছিনতাই চেষ্টাকারী তরুণ পলাশ নিহত হন।