নারী নেতারা অনেক সময় নির্বাচনে জিততে পারেন না। তার কারণ কিন্তু সবসময় যোগ্যতা নয়। তাঁদের পোশাক ও অভ্যাস চিরাচরিত সামাজিক ব্যবস্থার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে তাঁকে অবজ্ঞার চোখে দেখা হয়। এবং ফ্যাশন-ডিজাইনিংয়ের এক গবেষণা বলছে, মেয়েদের যে পোশাক সমাজ মানসিকতার বিরুদ্ধাচরণ করে তা পুরুষদের ক্রোধ উৎপাদন করে। মেয়েদের কোন পোশাকে দেখতে ঠিক কেমন লাগবে তার জনমত নির্ধারিত একটা গ্রাফ আছে। রাজনৈতিক ভাবেও গুরুত্ব অর্জন করতে হলে প্রথমেই মেয়েদের লক্ষ্মণরেখায় বন্দি হতে হয়। তাঁর ক্ষমতা নয়, সামাজিক কাপুরুষতাকে প্রশ্রয় দেওয়ার মধ্যেই তাঁর সনাতন ‘ভাল মেয়ে’র স্বীকৃতি লুকিয়ে থাকে। সমাজের পক্ষে একমাত্র সেই মহিলানেত্রীই কল্যাণকর যিনি পোশাকে নম্র, আচরণে বিনয়ী এবং নিশ্চিত ভাবে ঘরোয়া।
রাজনীতিতে যোগ দেওয়া অভিনেত্রী জয়াপ্রদাকে নিয়েও রাজনীতির এক নেতা বলেছিলেন, ‘‘রামপুরের লোকজনকে তিনি ঘুঙরু ও ঠুমকার সঙ্গে মোহিত করবেন।’’ যাঁরা মোহিত হবেন তাঁরা কিন্তু ‘নিষ্পাপ’! মোহিত হওয়ার অধিকার নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে না। কারণ, সেটা তাঁদের ‘জন্মগত অধিকার’। বসিরহাটের প্রার্থী নুসরাত জাহানকে নিয়েও উড়ছে সেই একই রকম মন্তব্য। মিমি চক্রবর্তী, মুনমুন সেন, শতাব্দী রায়ের সিনেমার অভিনয়ের বিশেষ দৃশ্য খুঁজে, তাঁদের পাশে জুড়ে দেওয়া হচ্ছে সেই ছবি। সোশ্যাল সাইটে ঘুরছে তাঁদের নিয়ে নিম্নমানের চটুল জোকস। সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত মুনমুন সেনের এক চোখ বন্ধ করা ছবিও পীড়াদায়ক।
তিনি রাজনীতিতে আসার অনুপযুক্ত, তা প্রমাণ করতে পোশাকের স্বল্পতা বা অঙ্গভঙ্গি তুলে ধরার কুরুচিকর প্রয়াস চলছে। এই প্রয়াসে শামিল হচ্ছেন তথাকথিত শিক্ষিত লোকজনেরাও। সিনেমায় ছুড়ে দেওয়া নুসরত ও মিমির চুমুর দৃশ্য দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা চলছে যে, তাঁদের বাস্তব জীবনও বুঝি এমনই। পেশা নিরপেক্ষ তাঁদের আলাদা অস্তিত্ব হতে পারে— এই সহজ বোধ সমাজে কখনও জারিত হয়নি। নির্বাচনে যোগ দিতে নেতাদের কোনও পরীক্ষা দিতে হয় না। লাগে সেই মিথ্যা প্রতিশ্রুতি আর নিজস্ব সম্পদের ভাণ্ডার। মেয়েদের বেলায় প্রয়োজন পড়ছে সুন্দর ও জনপ্রিয় চেহারা। এই প্রবণতাও ভয়াবহ। তার থেকে ভয়াবহ জনতার একাংশের দৃষ্টিভঙ্গী। শালীনতার দায় শুধু মেয়েদের ঘাড়ে তুলে দিয়ে তাঁদের বাকি ক্ষমতা বা কৃতিত্বকে একরকম জলাঞ্জলি দেওয়ার খুঁটিতে জোর ধাক্কা দেওয়ার কেউ নেই।
পোশাক কখনও মেয়েদের ভাল-মন্দের দলিল নয়। অহঙ্কার, ঔদ্ধত্য বা নম্রতার সঙ্গেও যুক্ত নয়। পোশাকের সঙ্গে মেয়েদের স্বকীয়তা, আত্মমর্যাদা বা প্রদর্শনেরও কোনও সম্পর্ক নেই। আছে পছন্দ, প্রাচুর্য ও স্বাচ্ছন্দ্যের সহজ সাযুজ্য। শুধুমাত্র মহিলার পোশাকের বৈচিত্র্যের জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে হাজারও শব্দ, বাক্য। অপমানসূচক উক্তি ও ক্ষমা চেয়ে নেওয়ার ইতিহাসটাও বেশ মজার। মায়াবতীকে হাতির সঙ্গে তুলনা বা চুলছাঁটা মহিলা বসুন্ধরা রাজের বিশ্রাম প্রয়োজন বলেও মন্তব্য করা হয়েছিল। রূপা গঙ্গোপাধ্যায়ের মুখে লম্বা সিগারেট গোঁজা ছবি ভাইরাল হওয়া এবং তাঁকে দ্রৌপদী বলে ব্যাঙ্গাত্মক সম্বোধন আসলে সেই শূন্যগর্ভ ক্লান্তিকর ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি। সেখানে ঘোষণা করে দাঁড়ি টানেননি কোনও দলীয় নেতা। উপযুক্ত শাস্তি হয়নি মন্তব্যবাজ নেতাদের।
‘গুড মর্নিং’ পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে সোফিয়া লোরেন বলেন, লোকায়িত অনুভূতি এই যে, শরীর রক্ষার জন্য কাপড়, একটি মহিলার দেহের বাঁক ঢাকার আবরণ নয়।’ আসলে মাথার চুল থেকে মেক-আপ, কপালের টিপ থেকে নোজ-পিনের আয়তন, জুতোর হিল থেকে পোশাকের হাত বা পিঠের দৈর্ঘ্য, লিপস্টিকের রং থেকে দেহের মাপ অনুযায়ী পোশাক কিংবা ওড়নার নির্বাচন সবটাতেই মিশে আছে এক সামাজিক অসুখ।
এই রোগের কোনও নিরাময় নেই। তার মূল কারণ সামাজিক ভণ্ডামি, সাংস্কৃতিক দ্বিচারিতা। যে সমাজ একাধারে শেখায় মেয়ে, তোমার চেহারা মূল্যবান। সেই চেহারা নিয়ে মেয়েরা যত্নশীল হয়ে পড়ে। স্বাধীন ভাবে আকর্ষণীয় করে তুলতে চায় নিজেকে। তখনই একটা মস্ত দাঁড়ি টেনে দেওয়া হয়। বলে দেওয়া হয়, ‘‘এত দূর যাওয়ার অনুমতি নেই। গেলে আর তুমি আদর্শ মহিলা হতে পারবে না।’’
এলেনর রুজভেল্টের স্মৃতিচারণা, ‘‘প্রলোভন আপনাদের মাথায়। বাস্তব জগতে নয়।’’ তাই মিমি, নুসরত ততক্ষণ সুন্দর যতক্ষণ জনগণের নজর কাড়ে। ঠিক ততটাই খোলামেলা যতটা এই সমাজ দেখতে চায়। ফলে তাঁদের দক্ষতা প্রমাণের অপেক্ষায়। নির্বাচনে যোগ দেওয়াটাই মেয়েদের একরকমের জয়। কারণ, সেই সুযোগ পাওয়াটাই মেয়েদের অর্ধেক লড়াই। নির্বাচনে জিতে কাজ করতে পারা মানে নিজের ভাবনা সাকার করা।
নির্বাচনে নারীদের এই জয় সমাজের পিছিয়ে থাকা নারীদের স্বপ্ন দেখাতে শেখায়। ক্ষমতায়নের স্বপ্নও মানুষকে দক্ষ করে তোলে। রাজনৈতিক নেতাদের দক্ষতার অভাব কিংবা অযোগ্যতার ইতিহাস সকলের জানা। বড় বড় নামী নেতাদের হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়ে মানুষ প্রতারিত হয়েছে। ইতিহাস প্রমাণ দিয়েছে, মেয়েদের কাজ করতে দেওয়ার সুযোগ কখনও বিফলে যায়নি।
মুনমুন বা শতাব্দী রাজনীতির জগতে একমাত্র দৃষ্টান্ত নন। সেই বলয়ে আছেন ইন্দিরা গাঁধী, শেখ হাসিনা, জেসিন্ডা আর্ডেন, লুবনা আল কাশেম, আর্না সোলবার্গ, ইভাঙ্কা ট্রাম্প, কোলিন্ডা গ্রাবার, শীলা দীক্ষিত, বৃন্দা করাত, সুষমা স্বরাজ এবং আরও অনেকে। রাজনীতির আঙিনায় এই নেত্রীরা মানবসম্পদের অপচয় রোখার ইতিহাস গড়েছেন। আনন্দবাজার