ফসলি জমির মাটিদূষণের ভয়ানক চিত্র উঠে এসেছে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) এবং যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক যৌথ গবেষণায়। এতে ঢাকার সাভারে ইপিজেড এলাকার আশপাশে কৃষিজমিতে সহনীয় মাত্রার চেয়ে সর্বনিম্ন সাড়ে আট গুণ ও সর্বোচ্চ ৩৮ গুণ বেশি মাত্রার কোবাল্টের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। একই সঙ্গে ক্রোমিয়ামের সর্বোচ্চ মাত্রা পাওয়া যায় সহনীয় মাত্রার তুলনায় ১১২ গুণ বেশি। একইভাবে পাওয়া যায় উচ্চমাত্রার টিটেনিয়াম, ভেনাডিয়ামসহ ১১টি ভারী ধাতু। এসবের মধ্যে আছে কোবাল্টসহ একাধিক তেজস্ক্রিয় রাসায়নিক উপাদানও। গবেষণা প্রতিবেদনটি এরই মধ্যে বিজ্ঞানবিষয়ক আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশ পেয়েছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ এমাদুল হুদা কালের কণ্ঠকে বলেন, ২০১৫-১৬ সালে এই গবেষণা করা হয়েছিল, যা ২০১৭ সালে এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড ইকোলজি রিসার্চে প্রকাশিত হয়। এটি একটি বিশ্বমানের গবেষণা বলেই স্বীকৃত হয়েছে। তিনি আরো বলেন, মাটিতে বিপজ্জনক মাত্রায় কোবাল্ট, টিটেনিয়াম, ক্রোমিয়াম খাদ্যচক্রের মাধ্যমে মানুষের জন্য বড় ধরনের হুমকি বহন করে। শিল্পবর্জ্য উপযুক্ত মাত্রায় পরিশোধন না করা, ব্যবস্থাপনা না করার ফলেই সেগুলো বাইরে চলে এসে মাটি, পানি ও বাতাস—সব কিছু দূষিত করে ফেলছে।
একই গবেষকদলের আরেক সদস্য পরমাণু শক্তি কেন্দ্র ঢাকার গবেষক রাজেদা খাতুন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা দেখতে চেয়েছিলাম মাটিতে শিল্পবর্জ্যের প্রভাব কেমন। সেটা খুঁজতে গিয়েই আমাদের গবেষণায় উঠে এসেছে ভয়ানক কিছু চিত্র। এসব মাটিতে হেভিমেটাল দূষণের প্রভাবে তা ফসল হয়ে খাদ্যচক্রে ঢুকে মানুষের বিপদ ডেকে আনছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমরা সাভারের যে এলাকায় কাজ করেছি তার আশপাশে অনেক ধরনের কলকারখানা হয়েছে। এসব থেকেই মাটি দূষিত হয়েছে, যা থেকে বোঝা যায় ওই সব কলকারখানার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা মাটি, পানি, পরিবেশ বা জনস্বাস্থ্য কোনো কিছুর জন্যই নিরাপদ নয়।’
গবেষকরা বলছেন, দেশে খাদ্যচক্রে রাসায়নিক দূষণের ঝুঁকি দিন দিন বাড়ছে। বিশেষ করে সরকারের নানামুখী পদক্ষেপের পরও শিল্প-কারখানায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এখনো নিরাপদ পর্যায়ে না আসায় এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে ফসলি জমি হয়ে ফসলজাত খাদ্যে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার সহায়তাপুষ্ট ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরির উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. শাহ মনির হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ফসল যেহেতু মাটিতে হয়, তাই সেই মাটি হেভিমেটালে দূষিত হলে তা স্বাভাবিকভাবেই খাদ্যশস্যে ঢুকবে। ফসলজাত খাদ্য উপাদানে তা থাকলে সেটা আগুনের তাপেও পুরোপুরি নষ্ট হয় না, বরং তা মানুষের শরীরে ঢুকে স্বাস্থ্যের নানা রকম বিপর্যয় বয়ে আনে। বিশেষ করে কিডনি, লিভার, মস্তিষ্কের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক ভারী ধাতু। ক্যান্সারের ঝুঁকি তো আছেই।’
ইন্টারনাল হরাইজন রিসার্চ পাবলিশিং করপোরেশনের এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড ইকোলজি রিসার্চে প্রকাশিত গবেষণাপত্রে ঢাকার সাভারে নলাম এলাকায় কৃষিজমিতে ভারী ধাতু দূষণের বিষয়টি উঠে আসে। এতে বলা হয়েছে, ৯টি স্থানের মাটির উপরিভাগ ও গভীর থেকে ১৮টি নমুনা সংগ্রহ করে ল্যাবে পরীক্ষা করা হয়। ওই পরীক্ষায় মাটির উপরি অংশে সবচেয়ে বেশি মাত্রায় ভারী ধাতু পাওয়া যায়। মাটির গভীরে এর মাত্রা কিছুটা কম। গবেষণাকালে মাটিতে ধাতুর সহনীয় মাত্রা ধরা হয় ক্রোমিয়াম ১-১০০ পিপিএম, কোবাল্ট ১-৪০ পিপিএম, কপার ২০-৩০ পিপিএম, ম্যাঙ্গানিজ ৮০-৭০০০ পিপিএম, নিকেল ৫-৫০০ পিপিএম, জিংক ১০-৩০০ পিপিএম। পরীক্ষায় ওই এলাকার মাটির উপরিভাগে ক্রোমিয়ামের উপস্থিতি পাওয়া যায় সর্বোচ্চ ১১ হাজার ২১২ পিপিএম এবং গভীর অংশে সর্বনিম্ন ৬৮.৮২ পিপিএম। দুই স্তর মিলে গড়ে উপরিভাগে ২৭৫৩-৪৫৯৮ পিপিএম আর নিচের স্তরে ১০৩৯-১৭৬৩ পিপিএম। কোবাল্ট পাওয়া যায় মাটির উপরিস্তরে সর্বোচ্চ ১৫৮৬ পিপিএম এবং গভীর স্তরে সর্বনিম্ন ৩৪২ পিপিএম। গড়ে উপরিভাগে ১০২২ পিপিএম এবং নিচের স্তরে ৭০৪ পিপিএম।
পরীক্ষায় কপারের দূষণ মাটির উপরিভাগে পাওয়া না গেলেও নিচের স্তরে এর মাত্রা সর্বোচ্চ ১৩৫৪ পিপিএম পাওয়া যায়। জিংক মাটির নিচের স্তরে পাওয়া যায় সর্বোচ্চ ৬১০৫ পিপিএম আর উপরিভাগে সর্বনিম্ন ৩৮ পিপিএম। নিকেল মাটির উপরিভাগে পাওয়া যায় সর্বোচ্চ ২৫৬৬ পিপিএম আর নিচের স্তরে সর্বনিম্ন ১০৮ পিপিএম। ভেনাডিয়াম পাওয়া যায় উপরিস্তরে ২৬৫ পিপিএম এবং নিচের স্তরে ১৯৮ পিপিএম। শুধু ভেনাডিয়াম ও ম্যাঙ্গানিজের উপস্থিতি সহনীয় মাত্রার মধ্যে পাওয়া যায়। এ ছাড়া টিটেনিয়াম পাওয়া যায় মাটির উপরিস্তরে ২৯৫৮-৮৩৩৫ পিপিএম আর নিচের স্তরে ৪৬৮২ পিপিএম। এর সহনীয় মাত্রা ধরা হয় সাধারণত ০.১-১০ পিপিএম।
ওই গবেষকদলের এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রায় দুই বছর হয়ে গেছে আমাদের গবেষণাটি হরাইজন রিসার্চ পাবলিশিং করপোরেশনের এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড ইকোলজি রিসার্চে প্রকাশিত হয়েছে। এর পরও এখন পর্যন্ত আর পরীক্ষা-নিরীক্ষার উদ্যোগ নিচ্ছে না কেউ। বরং কৃষি বিভাগ ও মৃত্তিকা বিভাগের লোকজন আমাদের ওপর এক ধরনের ক্ষুব্ধ হয়েছে। কিন্তু এই কাজ তো তাদের করার কথা ছিল। তারা তা করেনি। আমরা তো তাদের পথ দেখিয়ে দিয়েছি মাত্র।’
অধ্যাপক মোহাম্মদ এমাদুল হুদা বলেন, ‘আমাদের গবেষণাটি বাংলাদেশের মাটি, ফসল, পরিবেশ তথা জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় একটি সতর্কতার ইঙ্গিত দিয়েছে। সরকারের উচিত এদিকে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া।’
মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. বিধান কুমার ভাণ্ডার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ফসলি জমিতে হেভিমেটালের মাত্রা কি আছে না আছে, তা নিয়ে এর আগে আমাদের তেমন কোনো গবেষণা হয়নি। তবে এ বছরই একটি কার্যক্রম শুরু হয়েছে ছোট আকারে। ওই কাজ শেষ হলে আমরা ফলাফল বুঝতে পারব।’ তিনি আরো বলেন, শিল্প-কারখানার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ঠিকমতো না হলে তা থেকে মাটিদূষণ ঘটবেই। মাটির স্বাস্থ্য সুরক্ষায় এসব বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। কারণ মাটি সুস্থ না থাকলে কৃষিজাত খাদ্যচক্র নিরাপদ থাকবে না, যার ক্ষতিকর প্রভাব জনস্বাস্থ্যে পড়তেই পারে।