একটু আগেই একে একে ১৫ জনের নাম ঘোষণা করে মিনহাজুল আবেদীন বলেছেন, এটিই বাংলাদেশের বিশ্বকাপ ইতিহাসের সেরা দল। ‘একটু আগে’ বলতে গতকাল দুপুরে সেই দল ঘোষণার পর মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের সংবাদ সম্মেলনকক্ষ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময়ই হাবিবুল বাশারকে কেউ একজন বললেন, ‘সেরা দলের বেশির ভাগ ক্রিকেটারই তো ফর্মে নেই।’
অন্যতম এ নির্বাচক শুনলেন এবং শুনে হাসলেনও। বিনা বাক্যব্যয়ে মেনেও নিলেন। অবশ্য ফর্মে না থাকা এ ক্রিকেটাররাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের কঠিন মঞ্চে নিজেদের প্রমাণও করেছেন বহুবার। তাই ১৫ জনের দল গড়তে গিয়ে এঁদের ১৩ জনের নাম অনুমিতই ছিল। বাকি যে দুটি জায়গা, এর একটিতে অভিজ্ঞতা আর তারুণ্যের লড়াইয়ে বিজয়ী অভিজ্ঞ মোসাদ্দেক হোসেন। আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজের দলে থাকা ইয়াসির আলী চৌধুরীকে পেছনে ফেলে বিশ্বকাপ দলে ঠাঁই করে নিয়েছেন এই অফস্পিনিং অলরাউন্ডার। তবে দলের সব শেষ অন্তর্ভুক্তিও চমকে দেওয়ার মতো। অভিজ্ঞ শফিউল ইসলাম কিংবা মাত্রই চোট থেকে সেরে উঠে মাঠে ফেরা তাসকিন আহমেদরা আলোচনায় থাকলেও বিশ্বকাপ দলে সুযোগ পেয়েছেন এখনো কোনো ওয়ানডে না খেলা আবু জায়েদ চৌধুরী। নিউজিল্যান্ডে টেস্ট খেলা এই ডানহাতি পেসার বল ‘সুইং’ করানোর সামর্থ্যে অন্য দুজনকে পেছনে ফেলে যাচ্ছেন স্বপ্নের বিশ্বকাপে। ইয়াসিরের মতো যে স্বপ্নের ক্যারাভানে উঠতে না পারা তরুণ অফস্পিনার নাঈম হাসানকে নিয়ে আয়ারল্যান্ড সিরিজের বাংলাদেশ দলটি অবশ্য ১৭ জনের।
এই সিরিজ খেলতে ১ মে দেশ ছাড়বেন মাশরাফি বিন মর্তুজারা। এরপর বিশ্বকাপের প্রথম পর্বে বাংলাদেশের ৯ ম্যাচের সব শেষটি ৫ জুলাই। সেমিফাইনালে উঠতে না পারলেও সব মিলিয়ে দীর্ঘদিনের সফর। এ লম্বা সময়ে কেউ চোটেও পড়তে পারেন। সে ক্ষেত্রে বিকল্প খেলোয়াড়ও লাগতে পারে। তা ছাড়া ২৩ মে পর্যন্ত যেহেতু কোনো কারণ দর্শানো ছাড়াই দলে পরিবর্তন আনার সুযোগ আছে, তাই আয়ারল্যান্ড সিরিজে কারো সাফল্য-ব্যর্থতাও ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। তাই এটি যে চূড়ান্ত বিশ্বকাপ দল নয়, প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল বলে রাখলেন সে কথাও, ‘আয়ারল্যান্ড সিরিজের পারফরম্যান্স তো অবশ্যই গণ্য হবে। যেহেতু ২৩ মের আগে একটা সুযোগ আছে। সেই হিসাবে এখনই নিশ্চিত থাকা যাবে না। আমাদের পারফরম্যান্স বিশ্লেষণ করতে হবে।’
সেই বিশ্লেষণের ব্যাপারটি আরো পরের জন্য তোলা থাকছে। আপাতত ১৫ জনের বিশ্বকাপ দলকেই নিজেদের ইতিহাসসেরা বলে রায় দিলেন মিনহাজুল, ‘অবশ্যই সেরা দল। বিশ্বকাপের জন্য আমরা লম্বা সময় ধরে দল তৈরি করেছি। এখানে কিন্তু একজন বাদে বাকি সবারই আছে ওয়ানডে খেলার অভিজ্ঞতা।’ যাঁর ওয়ানডের অভিজ্ঞতা নেই, সেই আবু জায়েদকে নেওয়ার ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন, ‘নিউজিল্যান্ডে সে টেস্ট খেলার সুযোগ পেয়েছিল, ওয়ানডে খেলেনি। তবে সেই কন্ডিশনে আমরা যতটুকু দেখেছি, ওর বোলিংয়ে যথেষ্ট সুইং আছে। আর আমাদের পেসারদের মধ্যে সুইং বোলারের সংখ্যাও বেশ কম। আয়ারল্যান্ড সিরিজ, ইংলিশ কন্ডিশনে খেলা এবং মে-জুন মাসে সেখানকার ঠাণ্ডার কথা বিবেচনায় আমাদের মনে হয়েছে, একজন সুইং বোলার রাখতে পারলে সেটি আমাদের জন্য প্লাস পয়েন্ট হবে। সেই চিন্তা থেকেই রাহিকে (আবু জায়েদের ডাকনাম) রাখা হয়েছে।’
২০১৭ সালে কার্ডিফে নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে বাংলাদেশের চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সেমিফাইনাল নিশ্চিত করার ম্যাচে অফস্পিনে ৩ উইকেট নিয়ে মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া মোসাদ্দেক চলতি ঢাকা প্রিমিয়ার লিগেও (ডিপিএল) নিয়েছেন ৭ উইকেট। আবাহনী অধিনায়ক ১২ ম্যাচে ৪৭.৫৫ গড় এবং ৭২.৯১ স্ট্রাইক রেটে এক সেঞ্চুরি আর চার ফিফটিতে রানও করেছেন ৪২৮। এর চেয়ে ভালো স্ট্রাইক রেট (১০০.৯৫) ও গড়ে (১০৬.২৫) ৪২৫ রান করা ইয়াসির লড়াইয়ে থাকলেও পিছিয়ে পড়েছেন মোসাদ্দেকের বোলিং সামর্থ্যের কারণে, ‘ঘরোয়া ক্রিকেটে সৈকত (মোসাদ্দেকের ডাকনাম) ভালো খেলেছে। আর আমরা এমন একজন অলরাউন্ডার চাচ্ছিলাম, যে কিনা অফস্পিন করতে পারে। কারণ রিয়াদের (মাহমুদ উল্লাহ) কাঁধে চোট আছে। তাই সে বোলিং নাও করতে পারে। সেটি বিবেচনায় ব্যাকআপ হিসেবে একজন স্পিন বোলিং অলরাউন্ডার রাখার চিন্তা থেকেই সৈকতকে দলভুক্ত করা হয়েছে।’ আবু জায়েদকে নেওয়ার জন্য লড়াইটি ছিল ত্রিমুখী। যেখানে শফিউল অন্য সবার চেয়ে এগিয়ে ছিলেন বলেও জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচক। সেখান থেকে আবার পিছিয়ে পড়ার কারণও অজানা নয়। বাজে ফর্মের কারণে ডিপিএলে মোহামেডানের একাদশেও জায়গা হারিয়েছেন এ ডানহাতি পেসার। চোটের জন্য নিউজিল্যান্ড সফরে যেতে না পারা তাসকিন মাঠে ফিরলেও পুরো ফিট না হওয়াই তাঁর বিপক্ষে গেছে বলে জানিয়েছেন মিনহাজুল, ‘আমাদের কাছে যে রিপোর্ট আছে, তাতে ওর ফিটনেস শতভাগ নয়।’
নির্বাচকদের উদ্বেগ আছে অনেকের ফর্ম নিয়েও। তবে ইতিহাসের সেরা বিশ্বকাপ দলের ফর্মহীনরা অচিরেই সেটি ফিরে পাবেন বলেও আশা মিনহাজুলের। সেই সঙ্গে প্রত্যাশা এই দল নিয়ে বিশ্বকাপের এক থেকে চারের মধ্যে থাকারও, ‘শেষ চারে যাওয়ার প্রত্যাশা থাকবে সব সময়। ওয়ানডেতে আমাদের অভিজ্ঞ দলের পক্ষে সেটি সম্ভবও। ২০১৫ বিশ্বকাপের পর থেকে এখন পর্যন্ত এই ফরম্যাটে আমরা ৫১ শতাংশ ম্যাচ জিতেছি। এ সাফল্য আর অভিজ্ঞতার কারণেই আমাদের প্রত্যাশা বেশি। আমি মনে করি, এই দলের অবশ্যই এক থেকে চারের মধ্যে থাকার সামর্থ্য আছে।’
বাংলাদেশের বিশ্বকাপ দল
মাশরাফি বিন মর্তুজা (অধিনায়ক), তামিম ইকবাল, লিটন কুমার দাশ, সৌম্য সরকার, মুশফিকুর রহিম, মাহমুদ উল্লাহ, সাকিব আল হাসান (সহ-অধিনায়ক), মোহাম্মদ মিঠুন, সাব্বির রহমান, মোসাদ্দেক হোসেন, মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন, মেহেদী হাসান মিরাজ, রুবেল হোসেন, মুস্তাফিজুর রহমান এবং আবু জায়েদ চৌধুরী।