ধুনটে সরকারি অনুমোদন ছাড়াই গড়ে উঠেছে ইটভাটা: বিপর্যয়ের শঙ্কায় কৃষি জমি | Daily Chandni Bazar ধুনটে সরকারি অনুমোদন ছাড়াই গড়ে উঠেছে ইটভাটা: বিপর্যয়ের শঙ্কায় কৃষি জমি | Daily Chandni Bazar
logo
প্রকাশিত : ৩ নভেম্বর, ২০১৯ ২০:১২
ধুনটে সরকারি অনুমোদন ছাড়াই গড়ে উঠেছে ইটভাটা: বিপর্যয়ের শঙ্কায় কৃষি জমি
অধিকাংশ ইটভাটার পরিবেশ ছাড়পত্র ও লাইসেন্স নেই
ইমরান হোসেন ইমন, ধুনট (বগুড়া) থেকে:

ধুনটে সরকারি অনুমোদন ছাড়াই গড়ে উঠেছে ইটভাটা: বিপর্যয়ের শঙ্কায় কৃষি জমি

বগুড়ার ধুনট উপজেলায় সরকারি অনুমোদন ছাড়া ও কোন নিয়ম নীতি না মেনেই যত্রতত্রভাবে গড়ে উঠেছে ইটভাটা। কৃষিজমি, বসতবাড়ি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বনাঞ্চল ও পাকা সড়ক ঘেঁষেই গড়ে তোলা হয়েছে এসব ইটভাটা। ইটভাটায় ব্যবহারের জন্য কেটে নেয়া হচ্ছে কৃষিজমির টপসয়েল। ইটভাটা নির্মান করতে পরিবেশ অধিদফতরের কোন নিয়ম নীতিও মানা হচ্ছে না। অধিকাংশ ইটভাটার পরিবেশ ছাড়পত্র ও লাইসেন্স নেই। ফলে ইটভাটা এলাকায় কৃষিজমি এখন চরম বিপর্যয়ের শঙ্কায় রয়েছে।

বগুড়া জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ি বগুড়া জেলায় ২১৯টি ইটভাটা রয়েছে। এর মধ্যে ৭৪টি ইটভাটার লাইসেন্স আছে। অবশিষ্ট ১৪৫টি ইটভাটা লাইসেন্স বিহীন। তবে বেসরকারি হিসেবে জেলায় ইটভাটার সংখ্যা এর চেয়েও অনেক বেশি। আর ধুনট উপজেলার ১০টি ইউনিয়নে ইটভাটা রয়েছে প্রায় ৪০টি। এদের অধিকাংশেরই কোন পরিবেশ ছাড়পত্র ও লাইসেন্স নেই। তন্মধ্যে মথুরাপুর ইউনিয়নেই অনুমোদনবিহীন ইটভাটা রয়েছে প্রায় ১৫টি। যার ৮টি ইটভাটাই নির্মান করা হয়েছে ওই ইউনিয়নের কুঁড়িগাঁতি গ্রামে। সরকারি অনুমোদন ছাড়াই গত ২/৩ বছর যাবত কুড়িগাঁতি গ্রামের প্রগতি ব্রিকস, বস ব্রিকস, দিগন্ত ব্রিকস, বন্ধু ব্রিকস, ফাইভ স্টার ব্রিকস, আদর্শ ব্রিকস, একতা ব্রিকস, গ্রামীণ ব্রিকস, প্রগতি ব্রিকস ইটভাটা অবৈধভাবে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।

কোন নিয়ম নীতি না মেনেই কৃষি জমিতেই গড়ে তোলা হয়েছে এসব ইটভাটা। লোকালয়ের আশে-পাশে গড়ে ওঠা পরিবেশ বান্ধব চুল্লিবিহীন এসব ইটভাটা থেকে নির্গত কালো ধোয়ায় চরম ভাবে দূষিত হচ্ছে এলাকার পরিবেশ। ইটভাটায় কয়লার পরিবর্তে পোড়ানো হচ্ছে টায়ার ও জ্বালানী কাঠ। এছাড়া ইটের ভাটায় কাঁচামাল হিসেবে কৃষি জমির টপসয়েল ব্যবহারের কারণে উর্বরতা হারাচ্ছে হাজার হাজার হেক্টর কৃষি জমি। এসব ইট ভাটায় মাটি বহনকারী যন্ত্রদানব ট্রাক্টরের কারণে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে সরকারের কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত পাকা সড়ক। এছাড়া ট্রাক্টরের কারণে সৃষ্ট ধুলিঝড়ে চরম বিব্রতকর ও স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছেন পথচারী ও এলাকাবাসী। তাছাড়া যানবাহান ও চালকের লাইসেন্স না থাকায় সড়কে দূর্ঘটনাও বাড়ছে।

সরকারি নীতিমালা অনুযায়ি ইটভাটা স্থাপনের আগে পরিবেশ অধিদফতরে আবেদন করবেন সংশ্লিষ্ট মালিক। এরপর সরেজমিনে তদন্ত করে পরিবেশ অধিদফতর প্রতিবেদন দিলে জেলা প্রশাসক ইট পুড়ানো লাইসেন্স দেবেন। কিন্তু পরিবেশ অধিদফতরে আবেদন করেই কার্যক্রম শুরু করেছেন অধিকাংশ ইটভাটা মালিক। এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদফতর ও প্রশাসনের কোনো তদারকি নেই। যে কারণে দিন দিন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে ইটভাটার কার্যক্রম। সরকারি রাজস্বও ফাঁকি দেয়া হচ্ছে অনেক ক্ষেত্রে। ভূমি ব্যবহার প্রসঙ্গে মন্ত্রণালয়ের চুক্তিপত্র, কৃষি অধিদফতরের নীতিমালার কোনো তোয়াক্কাই করা হচ্ছে না ধুনট উপজেলার এসব ইটভাটায়। এতে চরম হুমকির মুখে পড়েছে পরিবেশ, কৃষি জমি, রাস্তা-ঘাট ও বনাঞ্চল।

ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) ২০১৩ এ বলা হয়েছে- লাইসেন্স ছাড়া ইটভাটা নির্মান করা যাবে না। কোন ব্যক্তি ইট প্রস্তুতে কৃষিজমি কিংবা পাহাড় কেটে মাটি ব্যবহার করতে পারবে না। অনুমতি ছাড়া খাল, পুকুর, নদীরপাড় কিংবা চরাঞ্চল কেটে মাটি সংগ্রহ করতে পারবে না। এলজিইডি কর্তৃক নির্মিত কোন সড়ক ইট ও মাটি পরিবহনের কাজে ব্যবহার করা যাবে না। কোন ধরনের কাঠ পোড়ানো যাবে না। এমনকি মান সম্পন্ন কয়লা পোড়াতে হবে।স্থানীয় এলাকাবাসী জানান, কৃষি জমি ও ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় এবং হাট-বাজার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশেই গড়ে তোলা হয়েছে ইটভাটা। এসব ইটভাটার কালো ধোঁয়াতে কৃষি জমিতে ফসলের উৎপাদন কমে যাচ্ছে। এছাড়া কৃষি জমির মাটি কেটে নিয়ে যাওয়ায় কৃষি জমির উর্বরতা শক্তি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হবে।


মথুরাপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হারুনর অর রশিদ সেলিম বলেন, কৃষিজমি নষ্ট করে ইটভাটা নির্মান করা হচ্ছে। মথুরাপুর ইউনিয়নে অনেক বেশি ইটভাটা নির্মান হওয়ায় কৃষি জমির ফলন কমে যাচ্ছে। এতে কৃষক সহ সাধারন মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।কুড়িগাঁতি গ্রামের প্রগতী ব্রিকস ইটভাটার মালিক মিজানুর রহমান ও বস ব্রিকস ভাটার মালিক কামরুল সহ কয়েক ইটভাটার মালিক জানান, পবিবেশ অধিদফতরে আবেদন করা হয়েছে। কিন্তু কেউই ছাড়পত্র ও লাইসেন্স পায়নি। তবে অবৈধভাবে এসব ইটভাটা কিভাবে চলছে জানতে চাইলে তারা বলেন, প্রতিটি ইটভাটা মালিক প্রতি বছর ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা উপজেলা ইটভাটা মালিক সমিতির মাধ্যমে সব কিছু ম্যানেজ করেন।

তবে ধুনট উপজেলা ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি ব্যবসায়ী হায়দার আলী হিন্দোল জানান, খাতা-কলমে এই উপজেলায় ২৪/২৫টি ইটভাটা রয়েছে। অনেকেই নতুন হওয়ায় হয়তো পরিবেশ ছাড়পত্র ও লাইসেন্স পায়নি। তবে ইটভাটা মালিকদের থেকে বার্ষিক টাকা আদায়ের বিষয়ে তিনি বলেন, প্রতি বছর ১৬ই ডিসেম্বর, ২১ শে ফেব্রুয়ারী, ২৬শে মার্চ সহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্য ভাটা মালিকরা কিছু টাকা প্রশাসনকে দিয়ে থাকেন।  ধুনট উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, এই উপজেলায় অধিকাংশ ইটভাটা নিয়ম নীতি মেনে নির্মান করা হয়নি। একারনে তাদেরকে পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্রের জন্য কৃষি অধিদফতর থেকে কোন প্রত্যায়নপত্র দেওয়া হয়নি। ইটভাটার কারনে কৃষি জমির অনেক ক্ষতি হচ্ছে।

ধুনট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাজিয়া সুলতানা বলেন, ইটভাটা স্থাপনের জন্য পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র সাপেক্ষে জেলা প্রশাসন লাইসেন্স দিয়ে থাকেন। জেলা প্রশাসক মহোদয় যদি তদন্ত করে রিপোর্ট চান যে সেখানে ইটভাটা হতে পারে কিনা সে ক্ষেত্রে তদন্ত করে রিপোর্ট প্রদান করি। কিন্তু বিগত কয়েক বছরে ইটভাটা স্থাপনের জন্য কেউ অনুমতি নিতে আসেনি। তবে প্রশাসনের নামে ভাটা মালিকদের থেকে টাকা আদায়ের বিষয়ে তিনি বলেন, প্রশাসনের নামে কেউ যাদি টাকা আদায় করে থাকে তাহলে তদন্ত করে অবশ্যই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে এবং অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে দ্রুত অভিযান পরিচালনা করা হবে বলে জানান তিনি।