প্রাথমিক শিক্ষায় ঝরে পড়া রোধে করণীয় | Daily Chandni Bazar প্রাথমিক শিক্ষায় ঝরে পড়া রোধে করণীয় | Daily Chandni Bazar
logo
প্রকাশিত : ২৪ নভেম্বর, ২০১৯ ১৮:৪৪
প্রাথমিক শিক্ষায় ঝরে পড়া রোধে করণীয়

প্রাথমিক শিক্ষায় ঝরে পড়া রোধে করণীয়

মোঃ লিয়াকত আলী সেখ
উপজেলা নির্বাহী অফিসার, শেরপুর, বগুড়া

শিক্ষাকে জাতির মেরুদন্ড হিসেবে গণ্য করা হয়। আর প্রাথমিক শিক্ষা হচ্ছে শিক্ষাস্তরের মূলভিত্তি।  মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা  জাতির প্রথম চাওয়া। উন্নত বিশ্বে উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থা ও যুগোপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে। অপর পক্ষে বাংলাদেশে আমরা বিভিন্ন ধরণের চ্যালেঞ্জ বা প্রতিবন্ধকতার শিকার হচ্ছি। প্রকৃতপক্ষে, মানসম্মত শিক্ষা  নিশ্চিতকরণের পথে অনেকগুলি প্রতিবন্ধকতার মধ্যে ঝরে পড়া একটি উল্লেখযোগ্য প্রতিবন্ধকতা।

শিক্ষার যে কোন স্তর থেকে শিক্ষাব্যবস্থার সাথে সম্পর্কহীন হয়ে পড়াই হল শিক্ষা হতে ঝরে পড়া। শিক্ষার বুনিয়াদি স্তর প্রাথমিক শিক্ষা হতে ঝরে পড়ার অর্থই হল একটি অদক্ষ, মানহীন ব্যক্তিতে পরিণত হওয়া। শিক্ষা, সংস্কৃতি, সামাজিকতা, কর্তব্যপরায়ণয়তা মূলোবোধ থেকে দূরে সরে যাওয়া। এটি পরবর্তীতে বিভিন্ন ধরণের সামাজিক সমস্যার জন্য দায়ী। যে কোনো পর্যায়ের শিক্ষা থেকে ছেলে বা মেয়ে কারোরই ঝরে পড়া কাম্য নয়, কিন্তু নারীদের শিক্ষার হার বাড়ানোর ক্ষেত্রে সরকার যেখানে নির্দিষ্ট কিছু পদক্ষেপ দীর্ঘদিন ধরেই পরিচালনা করে আসছে- সেখানে মেয়ে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া বেশ উদ্বেগজনক। 

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, শিশুরা কেন ঝরে পড়ে? এর কারণ রয়েছে অনেকগুলি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির পর প্রতিবছরই শিক্ষার্থীরা একটু একটু করে ঝরে পড়তে থাকে। এমনও দেখা গেছে, পঞ্চম শ্রেণিতে উঠার পরও বিভিন্ন কারণে সমাপনী পরীক্ষা দিতে না পারায় অনেকে ঝরে পড়ছে। প্রাথমিক স্তরে বরং শিক্ষা নিয়ে পিতামাতার অসচেতনতা, বিদ্যালয়ের পড়ালেখার পরিবেশের অভাব, শিক্ষার্থীদের বাড়ি থেকে বিদ্যালয়ের দূরত্ব কিংবা বিদ্যালয়ে যাতায়াতে অসুবিধা ইত্যাদি কারণই প্রধান।  দারিদ্রতা একটি উল্লেখযোগ্য কারণ।

বাবা-মার আর্থিক অবস্থা সচ্ছল না হলে তারা বাচ্চাদের স্কুলে পাঠান বন্ধ করে দিয়ে শিশুটিকে কোন কাজ করিয়ে অর্থ উপার্জন করায়। আমাদের দেশে মেয়ে শিশুদের নিয়ে নেতিবাচক ধারণা রয়েছে। তাদের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়না, তারা উত্যক্তের শিকার হয়,  একটু বড় হলেই মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। ফলে মেয়েটির স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। আবার, শিশুদের কাছে বিদ্যালয়কে যতোটুকু আকর্ষণীয় করার কথা ছিল আমাদের বিদ্যালয়গুলো ততোটা আকর্ষণীয় হয় নি। ফলে শিশুরা যেমন বিদ্যালয়ের প্রতি অনীহা পোষণ করে, তেমনি এর সাথে যুক্ত হয় অন্যান্য নানা অনুষঙ্গ- যার সামষ্টিক প্রতিফলন হচ্ছে বিদ্যালয় থেকে শিশুদের ঝরে পড়া। স্কুলের ভৌত অবকাঠামো, শিক্ষকের আচরণ বা দৃষ্টিভঙ্গি, শিক্ষকের পাঠদান পদ্ধতি, অন্যান্য শিশুর আচরণ, শিশুর স্তর অনুযায়ী পাঠ্যবই না হওয়া ইত্যাদি কারণগুলি ঝরে পড়ার কারণ বলে ধরে নেওয়া হয়।  

ঝরে পড়া সমস্যা সমাধানের জন্য জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ এ বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। গরীব শিশুদের জন্য উপবৃত্তির ব্যবস্থা করা; স্কুলের পরিবেশ আকর্ষণীয় ও আনন্দময় করে গড়ে তোলা; শিক্ষার্থীদের জন্য খেলাধুলার সুব্যবস্থা; সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড শিশুদের প্রতি শিক্ষকদের  আগ্রহ, মমত্ববোধ ও সহানুভূতিশীল ও বন্ধুভাবাপন্ন আচরণ এবং পরিচ্ছন্ন ভৌত পরিবেশসহ উল্লেখযোগ্য উপকরণের উন্নয়ন ঘটানো। ছেলে-মেয়েদের জন্য মানসম্মত আলাদা টয়লেটের ব্যবস্থা করা; শারীরিক শাস্তি সম্পুর্নরূপে বিলোপ করা এবং দূপুরের খাবারের ব্যবস্থা করা খুবই জরুরী ।

পাহাড়ী- হাওর, চর বা প্রাকৃতিক বিপর্যয় কবলিত দূর্গম এলাকার শিক্ষার্থীদের জন্য বিদ্যালয়ে হোস্টেলের ব্যবস্থা করার দিকে নজর দেয়া হবে। সময়সূচি নির্ধারণ এবং ছুটির দিনসমূহের পরিবর্তন করার সুযোগ থাকবে। প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য প্রতিবন্ধীবান্ধব সুযোগ-সুবিধা, যেমন টয়লেট ব্যবহারসহ চলাফেরা করা ও অন্যান্য সুযোগ নিশ্চিত করা হবে। পথশিশু ও অন্যান্য সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আনার এবং ধরে রাখার জন্য বিনা খরচে ভর্তির সুযোগ, বিনামূল্যে শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ, দুপুরের খাবার এবং বৃত্তিসহ বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

এছাড়া আরও কতিপয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরী, যেমনঃ বাল্যবিবাহ ও ইভটিজিং প্রতিরোধে আইনের কঠোর বাস্তবায়ন, শিশুশ্রম সম্পুর্ণরূপে অকার্যকর করা, পুরস্কারের ব্যবস্থা করা, স্থানীয় জনসাধারণ, অভিভাবক সমাবেশের মাধ্যমে  উদ্বুদ্ধ করা, শিক্ষকদের প্রশিক্ষিত করে গড়ে তোলা ইত্যাদি।প্রাথমিক শিক্ষা সকল শিক্ষার ভিত্তি, তাই উপরিক্ত সুপারিশমালা বাস্তবায়নের মাধ্যমে আধুনিক  শিশুবান্ধব শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা আবশ্যক যাতে কোন শিশুই ঝরে না পড়ে। এভাবে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা যেতে পারে।