২৬২ বছরের পুরোনো ‘হুমগুটি’ খেলায় অংশ নেয় ১৫ গ্রামের মানুষ | Daily Chandni Bazar ২৬২ বছরের পুরোনো ‘হুমগুটি’ খেলায় অংশ নেয় ১৫ গ্রামের মানুষ | Daily Chandni Bazar
logo
প্রকাশিত : ১৫ জানুয়ারী, ২০২১ ০৬:১৪
২৬২ বছরের পুরোনো ‘হুমগুটি’ খেলায় অংশ নেয় ১৫ গ্রামের মানুষ
অনলাইন ডেস্ক

২৬২ বছরের পুরোনো ‘হুমগুটি’ খেলায় অংশ নেয় ১৫ গ্রামের মানুষ

২৬২ বছর আগে থেকেই পৌষ মাসের শেষ দিনে ‘হুমগুটি’ খেলা দেখতে লাখো মানুষের ঢল নামে ময়মনসিংহের ফুলবাড়ীয়ায়।বৃহস্পতিবার (১৪ জানুয়ারি) ময়মনসিংহ-ফুলবাড়ীয়া সড়কের লক্ষ্মীপুর ও দশ মাইলের মাঝামাঝি পতিত জমিতে এ খেলা অনুষ্ঠিত হয়। খেলার উপকরণ হলো- পিতলের মোড়কে তৈরি ৪০ কেজি ওজনের একটি বল যা নিয়ে ১৪ থেকে ১৫ গ্রামের মানুষ কাড়াকাড়ি করবে।

পৌষ মাসের শেষ দিনকে ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলায় আঞ্চলিক ভাষায় বলা হয় ‌‘পুহুরা’। প্রতিবছর এই দিনে একই সময়ে একই জায়গায় ২৬২ বছর ধরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এই খেলা। পিতলের মোড়কে তৈরি ৪০ কেজি ওজনের একটি বল নিয়ে কাড়াকাড়ি। ময়মনসিংহ অঞ্চলের জনপ্রিয় এই খেলার নাম ‘হুমগুটি’।

প্রতিবছরই বিকেল ৪টার দিকে খেলা শুরু হয়। প্রচারবিহীন এই খেলায় সকাল থেকেই ফুলবাড়িয়া ছাড়াও পার্শ্ববর্তী ত্রিশাল ও মুক্তাগাছা উপজেলার বিভিন্ন বয়সের লাখো মানুষ জমায়েত হতে থাকে লক্ষ্মীপুরের বড়ই আটা বন্দে। কণ্ঠে কণ্ঠে উচ্চারিত হয় ‘জিতই আবা দিয়া গুটি ধররে...হেইও’।

ফুলবাড়িয়া উপজেলা সদর থেকে পাঁচ কিলোমিটার উত্তরে লক্ষ্মীপুরের বড়ই আটা বন্দ। খেলা শুরুর আগে ময়মনসিংহ-ফুলবাড়িয়া সড়কের অদূরে ভাটিপাড়া, বালাশ্বর, তেলিগ্রামের সংযোগস্থল নতুন সড়কে নামে মানুষের ঢল।

খেলা উপলক্ষে বাড়ি বাড়ি চলে পিঠাপুলির উৎসব। খেলার জায়গায় জমে ওঠে গ্রামীণ পহুরা মেলা। জবাই করা হয় গরু-ছাগল। উপজেলার লক্ষ্মীপুর, দেওখোলাসহ পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে দুই-তিন দিনব্যাপী চলে উৎসব আমেজ। কবে থেকে খেলার শুরু, নতুন প্রজন্মের কেউ এই খেলার সময় তারিখ বলতে পারে না, বুড়োদেরও অজানা।

জানা যায়, আড়াইশ বছর আগে মুক্তাগাছার জমিদার রাজা শশীকান্তের সঙ্গে ত্রিশাল উপজেলার বৈলরের হেমচন্দ্র রায় জমিদারের জমির পরিমাপ নিয়ে বিরোধ তৈরি হয়। জমিদার আমলের শুরু থেকেই তালুকের প্রতি কাঠা জমির পরিমাপ ছিল ১০ শতাংশ, পরগনার প্রতি কাঠা জমির পরিমাপ ছিল সাড়ে ৬ শতাংশ। একই জমিদারের ভূ-খণ্ডে দুই নীতির বিরুদ্ধে গড়ে ওঠে প্রতিবাদী আন্দোলন। জমির পরিমাপ নিয়ে সৃষ্ট বিরোধ মীমাংসা করতে লক্ষ্মীপুর গ্রামের বড়ই আটা নামক স্থানে তালুক-পরগনার সীমানায় এ গুটি খেলার আয়োজন করা হয়। গুটি খেলার শর্ত ছিল গুটি গুমকারী এলাকাকে তালুক এবং পরাজিত অংশের নাম হবে পরগনা।

জমিদার আমলের সেই গুটি খেলায় মুক্তাগাছা জমিদারের প্রজারা বিজয়ী হয়। এভাবেই তালুক পরগনার সীমান্তের জিরো পয়েন্টে ব্রিটিশ আমলে জমিদারি এই খেলার গোড়াপত্তন, যা আজও চলছে। ৪০ কেজি ওজনের পিতলের গুটি ঢাক ঢোলের তালে তালে নেচে গেয়ে তালুক পরগনার সীমানায় নিয়ে আসা হয়।

প্রতি বছর পৌষের শেষ বিকেলে এই খেলাকে ঘিরে প্রাচীনকাল থেকেই লক্ষ্মীপুর, বড়ই আটা, ভাটিপাড়া বালাশ্বর, শুভরিয়া, কালীবাজাইল, তেলিগ্রাম, সারুটিয়া, গড়বাজাইল, বাসনা, দেওখোলা, কুকরাইল, বরুকা, ফুলবাড়িয়া পৌর সদর, আন্ধারিয়াপাড়া, জোরবাড়ীয়া, চৌধার, দাসবাড়ী, কাতলাসেনসহ আশপাশের ১৪ থেকে ১৫টি গ্রামে শুরু হয় উৎসবের আমেজ। এ উপলক্ষে ঈদের উৎসবের মতো নতুন জামা-কাপড়ও কিনে।

এ খেলায় কোনো রেফারি থাকে না। বিকেল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলে খেলা। কখনো দুই-তিনদিন পর্যন্ত খেলা চলার রেকর্ড আছে। একেক এলাকার একেকটি নিশানা থাকে। ওই নিশানা দেখে বোঝা যায় কারা কোন পক্ষের লোক। গুটি কোন দিকে যাচ্ছে তা মূলত চিহ্নিত করা হয় নিশানা দেখেই। নিজেদের দখলে নিতে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করা হয় খেলায়। এভাবে গুটি গুম না হওয়া পর্যন্ত চলে খেলা।

দৈনিক চাঁদনী বাজার/সাজ্জাদ হোসাইন