ভাষাসৈনিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক ও বরিশাল প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মহম্মদ ইউসুফ হোসেন কালু আর নেই (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন)।
সোমবার (২৯ মার্চ) বিকেল ৫টা ৪০ মিনিটে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়েছে। তিনি দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগে ভুগছিলেন। তার বয়স হয়েছিল ৯১ বছর। তিনি স্ত্রী ও ১ ছেলেসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।
ইউসুফ হোসেন কালু বরিশাল নগরীর বগুড়া রোড এলাকার বাসিন্দা ছিলেন। তার আদি বাড়ি ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার কানুদাসকাঠি গ্রামে।
বরিশাল প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক কাজী মিরাজ মাহমুদ জানান, ইউসুফ হোসেন কালু দীর্ঘদিন বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগে ভুগছিলেন। কিছু দিন আগে তাকে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে আজ বিকেল ৫টা ৪০ মিনিটে তার মৃত্যু হয়।
তিনি আরও জানান, মঙ্গলবার (৩০ মার্চ) সকাল ১০টায় নগরীর এসসিজিএম (শ্রী চৈতন্য গোবিন্দ মোহন) বিদ্যালয় মাঠে জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। জানাজা শেষে ইউসুফ কালুর প্রতি সর্বস্তরের মানুষ শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য মরদেহ সেখানে কিছুক্ষণ রাখা হবে। এরপর তার আদি বাড়ি ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার কানুদাসকাঠি গ্রামে মরদেহ দাফনের কথা রয়েছে।
কাজী মিরাজ মাহমুদ বলেন, মহম্মদ ইউসুফ হোসেন কালু ১৯৩১ সালের ১৭ জানুয়ারি ঝালকাঠীর রাজাপুরের কানুদাসকাঠী মিয়াবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা ওবায়দুল করিম রাজা মিয়া ও মা ফাতেমা খাতুন। ৩ ভাই ও ২ বোনের মধ্যে সবার ছোট ছিলেন তিনি। বাবা রাজা মিয়া ১৯২০ সালের দিকে কলকাতা পোর্ট কমিশনে চাকরি করতেন। পরবর্তীতে চাকরি ছেড়ে দেন এবং রাজা রায় বিহারীর জমিদারির নায়েব নিযুক্ত হন।
আমুয়া, ভান্ডারিয়া, কানুদাসকাঠী অঞ্চলের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। মহম্মদ ইউসুফ হোসেন কালু গ্রামে পাঠশালা শেষ করে ১৯৪৮ সালে বরিশাল বিএম স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে অধ্যয়নত অবস্থায় বাংলাকে ভাষা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন কালু। প্রগ্রেসিভ ছাত্রফ্রন্টের নেতা এমায়দুলের নেতৃত্বে মিছিলে যোগ দিয়ে প্রথম দিনই পুলিশের লাঠির আঘাতে আহত হন। এরপর মেট্রিকুলেশন পাস করে ১৯৫১ সালে বিএম কলেজে এইচএসসিতে (কমার্সে) ভর্তি হন। তখন থেকে ভাষা সংগ্রামে তার সম্পৃক্ততা আরও বেড়ে যায়।
তৎকালীন ছাত্রলীগের সভাপতি ও বিএম কলেজ ছাত্র সংসদের ভাইস প্রেসিডেন্ট সৈয়দ গোলাম কিবরিয়াকে আহ্বায়ক করে বিএম কলেজে গঠন করা হয় ২৫ সদস্যের ‘ভাষা সংগ্রাম পরিষদ’। তবে কিছুদিন পরে আন্দোলনে দেশ উত্তাল হয়ে উঠলে ৮১ সদস্য বিশিষ্ট বৃহত্তর বরিশাল ভাষা সংগ্রাম পরিষদে যুক্ত করা হয় তাকে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের আগে বরিশালে প্রচারণায় আসেন পাকিস্তান মুসলিম লীগ সভাপতি ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী খান আব্দুল কাইউম। তখন ইউসুফ হোসেন কালু ও ভাষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্যরা স্বৈরাচারী সরকার নিপাত যাওয়ার দাবিতে কালো পতাকা নিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। ওই সময় পুলিশের সঙ্গে তুমুল সংঘর্ষ হলে শহরের কাউনিয়ার নিবাসী মালেক নামে একজন মারা য়ান। এ ঘটনায় ইউসুফ হোসেন কালুসহ ৩৫ জন গ্রেফতার হন। ২২ দিন পর জামিনে মুক্ত হন তিনি।
১৯৭১ সালের ১৪ মে কোলকাতা লালবাজার চলে যান। সেখানে বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির সহযোগিতায় হাসনাবাদ, হিংগলগড়, টাকি হেড কোয়ার্টার থেকে প্রশিক্ষণ নেন। পরবর্তীতে ৯ নম্বর সেক্টরের অধীনে কালীগঞ্জ, সাতক্ষীরার সীমান্ত এলাকায় পাকবাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেন। শিক্ষা জীবনের প্রথমে ছাত্র ইউনিয়ন করেছেন কালু। ৫২ সালে যোগ দেন ছাত্রলীগে। পরে জড়িয়ে পড়েন আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে। তিনি স্বৈরাচার বিরোধী ও প্রতিটি প্রগতিশীল আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন।
ইউসুফ হোসেন কালু ১৯৬২ সালে সাংবাদিকতা শুরু করেন। প্রথমে আজাদ ও পরে দৈনিক পয়গামের বরিশাল সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন নুরুল আলম ফরিদ সম্পাদিত রণাঙ্গনের মুখপত্র ‘বিপ্লবী বাংলাদেশ’ পত্রিকার অন্যতম পরিচালক ছিলেন। বরিশাল প্রেসক্লাবের (বর্তমানে শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাত বরিশাল প্রেসক্লাব) সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন ১৯৬২ সাল থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত। বর্ণাঢ্য জীবনে তিনি অন্যায়ের সঙ্গে আপস করেননি। প্রতিবাদী ও সত্যবাদী কণ্ঠস্বর হিসেবে বরিশালে ইউসুফ হোসেন কালু পরিচিত এক ব্যক্তি। তিনি একাধারে সাংবাদিক, রাজনীতিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সমাজসেবক ও সংগঠক ছিলেন।
এদিকে ইউসুফ হোসেন কালুর মৃত্যুতে পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী ও বরিশাল সদর আসনের সংসদ সদস্য কর্নেল (অব.) জাহিদ ফারুক শামীম, বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ, বরিশালের জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দিন হায়দার, শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাত বরিশাল প্রেসক্লাব সহ সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। তারা মরহুমের রুহের মাগফেরাত কামনা এবং তার শোক-সন্তপ্ত পরিবার-পরিজন ও শুভানুধ্যায়ীদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
দৈনিক চাঁদনী বাজার / সাজ্জাদ হোসাইন