
খেলেই সব ঠিক, আর না খেলেই বে-ঠিক। বাড়ি থেকে বের হয়েই প্রথম লক্ষ্য নেশার জোগান দেয়া। নেশার জোগান দিতে টাকার পেছনে ছোটা, আর টাকার পেছনে ছুটতে গিয়ে যেকোনো কাজ বে-মালুম করে ফেলা। স্বার্থে কিঞ্চিৎ আঘাত লাগলেই বিকৃত আচরণ প্রদর্শিত করা। তবে পরিবারের আর্থিক ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা এবং নিয়ন্ত্রনের উপর নির্ভর করে স্থান-কাল-পাত্রভেদে এই নেশাগ্রস্তদের আচরণের তারতম্য হলেও নেশাগ্রস্থ সকলের মধ্যেই নেশার পাশর্^ প্রতিক্রিয়া হিসেবে ধীরে ধীরে মস্তিস্কের বিকৃতি লক্ষ করা যাচ্ছে। এ নেশায় আসক্ত হলে একজন মানুষ তার পরিবারের ব্যাধ্যতামূলক চাহিদাগুলোর চেয়েও তার নেশার চাহিদাকে বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকে।
মদ, গাঁজা, ফেন্সিডিল, ইয়াবার পরে নেশার জগতে এখন নতুন নাম সংযোজন হয়েছে- “ব্যাথানাশক ট্যাবলেট। তুলনামূলক দামে কম, তবে-নেশা চরম। যদিও নির্ধারিত দামের চেয়ে প্রায় ৪গুন টাকায় বাজারে বিক্রি হচ্ছে এই ট্যাবলেট। তবুও ইয়াবা ও ফেন্সডিল ব্যাবহারকারীরা খুঁজে পেয়েছে সাধ্যের মধ্যে সর্বোচ্চ নেশা। এই একই ট্যাবলেট ইয়াবা সেবীরা ইয়াবার নিয়মে আর ফেন্সিডিল সেবীরা ট্যাবলেট গুঁড়া করে কাশির সিরাপের সাথে মিশিয়ে সেবন করছে। শতকার ৭০-৮০ ভাগ মাদক সেবীরাই বর্তমানে বিভিন্ন কোম্পানির টাপেন্টাডল গ্রুপের ব্যাথানাশক ট্যাবলেটের উপর নির্ভরশীল।
দীর্ঘদিনের অনুসন্ধানে জানা গেছে, বর্তমান শেরপুরে ভয়ঙ্কর এই ট্যাবলেটের ব্যাবসা নিয়ন্ত্রনে রেখেছে মুখোশধারী কিছু মাদক ব্যাবসায়ী, আর শেরপুর শহর ও উপজেলার আনাচে-কানাচে গড়েওঠা কিছু অবৈধ ফার্মেসী যারা শুধু এই ব্যাথানাশক ট্যাবলেট (টাপেন্টাডল গ্রুপ) বিক্রির উপর নির্ভরশীল। বর্তমানে ১০০ মিলিগ্রামের প্রতিটি ট্যাবলেট বিক্রি হচ্ছে ১৫০ থেকে ২০০ টাকায় যার সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য (এমআরপি) দেয়া আছে কোম্পানি ভেদে ২৫ থেকে ৩০ টাকা। নামি দামি বেশ কিছু ঔষধ কোম্পানির ব্যাথানাশক ট্যাবলেট (টাপেন্টাডল গ্রুপ) মাদক সেবীদের জীবনকে সহজ করে দিয়েছে। কোনো প্যারা নাই কল করলেই পাওয়া যাচ্ছে। তবে চিহ্নিত কিছু ফার্মেসী ব্যতীত কোনো ফার্মেসীতেই এই ঔষধ বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে না। চিহ্নিত ফার্মেসী গুলোতেও এই ঔষধ রাখা হয় না, রাখা হয় বাড়িতে বা গোপন কোনো স্থানে। এমনকি মাদকসেবীরা আর ফর্মেসীতেও যায় না। মোবাইলে কল করলে নির্ধারিত স্থানে পৌঁছে দেয়া হয়। আর মুখোশধারী মাদক ব্যাবসায়ীরা ইয়াবার মতো করে খুব সহজেই আদান-প্রদান করছে এই ট্যাবলেট। লোপেন্টা (এসিআই), টাপেন্টা (এসকেইফ), সিনটা (হেত্থকেয়ার), টেপিক্সিয়া (গ্লোব), পেন্টাডল (স্কয়ার), সেন্ট্রাডল (ইনসেপ্টা), টোপিটা (বেক্সিমকো) এই নামগুলো মাদক সেবীদের কাছে প্রতিদিন দুই-তিন বারের আবশ্যকীয় পথ্য’র নাম। তবে এর মধ্যে লোপেন্টা ১০০ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট শেরপুরের বর্তমান বাজারে নিয়মিত জোগান দিয়ে যাচ্ছে।
ফার্মেসীর এক বিক্রেতা জানান, প্রথমের দিকে বিক্রি করতাম, এখন আর করিনা। বর্তমানে কিশোর, যুবক ও প্রাপ্তবয়স্ক সব মাদকসেবীরাই এই ট্যাবলেট নিতে আসলেও কিশোর ও যুবকের সংখ্যাই বেশি।
প্রাপ্তবয়স্ক এক মাদকসেবী জানান, প্রথমের দিকে ফার্মেসীতে গেলেই দিয়ে দিত, কিন্তু এখন একটু দেখেশুনে দেয় অপরিচিতদের দেয়না আর যদিওবা দেয় তাহলে আরেক মাদকসেবীর মাধ্যমে। যাওয়ার আগে ফোন করে যেতে হয়।
বগুড়া ঔষধ প্রসাশন অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো: শরিফুল ইসলাম মোল্লা বলছেন, ট্যাপেন্টোডল গ্রুপের কোনো ঔষধই বর্তমানে আর ঔষধ নয়, এটা বর্তমানে মাদক এবং সরকারিভাবে উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ নিষিদ্ধ। এটা যদি মাদক ব্যাবসায়ীদের নিয়ন্ত্রনে থাকে তাহলে সেইটা মাদক নিয়ন্ত্রন অধিদপ্তর দেখবে। তবে যে ফার্মেসীগুলো এখনও এই মাদক বিক্রি করছেন, আমরা নজরদারিতে রাখছি, তাদের বিরুদ্ধে আমাদের পক্ষ থেকে দ্রুত কঠর ব্যাবস্থা গ্রহন করা হবে।
তবে এ বিষয়ে চাঁদনী বাজারকে সম্প্রতি আলোচনা সম্বলিত নতুন তথ্য জানান বগুড়া মাদক নিয়ন্ত্রন অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো: মেহেদি হাসান। তিনি জানান, সম্প্রতি এ বিষয়ে আমাদের আলোচনা হয়েছে। বর্তমানে দশটি কোম্পানি এই ব্যাথানাশক ট্যাবলেট উৎপাদনের অনুমোদন পেয়েছে যা কোনো ফার্মেসীতে বিক্রি যোগ্য নয়। একমাত্র মাদক নিয়ন্ত্রন অধিদপ্তর থেকে লাইসেন্স প্রাপ্ত হসপিটাল ও প্রাইভেট ক্লিনিকগুলো বিক্রি করতে পারবে যেখানে অপারেশনের কাজে এই ঔষধ ব্যবহৃত হবে। তবে আমরা বর্তমানে জেলা-উপজেলার বিভিন্ন স্থানে অবৈধ ভাবে এই ঔষধ বিক্রির তথ্য পাচ্ছি এবং মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে দমনের চেষ্টা করছি বলে জানান এই কর্মকর্তা। তাহলে কি হসপিটাল বা বেসরকারি ক্লিনিকে আদান-প্রদানকারীদের মাধ্যমেই সর্বত্র ছড়াচ্ছে ভয়াবহ এই নেশাদ্রব্য? এমনটাই প্রশ্ন বিশ্লেষকদের!
একাধিক সুত্রে জানা গেছে, শেরপুর উপজেলায় পৌর শহরের ব্যাসস্ট্যান্ড এলাকার মার্কেট পট্টিতে অবাধে এই মাদক ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছে। এছাড়াও শহরের তালতলা এলাকার একটি ফার্মেসীতে, সকালবাজার নবমী সিনেমাহল এলাকায়, বাসস্ট্যান্ডের এক ফার্মেসীতে, রেজিস্ট্রি অফিস এলাকার কিছু ফার্মেসীতে ও শহরের আনাচে-কানাচে মাদক ব্যবসায়ীরা এই ট্যাবলেট আদান-প্রদান করছে বলে জানা গেছে।
এ ব্যাপারে শেরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো: শহিদুল ইসলাম বলেন, টাপেন্টাডল বিক্রির ব্যাপারে আমাদের গোয়েন্দা নজরদারি আছে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি ফার্মেসীকে র্যাব-১২ এর মাধ্যমে মামলা দেয়া হয়েছে ও এই মাদক সংক্রান্তে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে এবং থাকবে।
এ বিষয়ে বগুড়া র্যাব-১২ এর স্কোয়াড্রন লিডার মো: সোহরাব হোসেন বলেন, পরিকল্পনার মাধ্যমে এই ভয়াবহ মাদক নিধনে আমাদের কার্যক্রম চলছে এবং দ্রুত এই সরবরাহকারীরা আইনের আওতায় আসবে।
শেরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও প. প. কর্মকর্তা ডা: সাজিদ হাসান সিদ্দিকী বলেন, সর্বপ্রথম কোম্পানিগুলোকে এই ট্যাবলেট উৎপাদন বন্ধ করতে হবে, পাশাপাশি প্রশাসনিক শক্ত পদক্ষেপ গ্রহনের আবেদন জানান তিনি।
এ বিষয়ে শেরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) মো: মইনুল ইসলাম বলেন, মাদক নিয়ন্ত্রন অধিদপ্তর ও ঔষধ প্রশাসনের সাথে কথা বলে এই মাদক নিধনের ব্যাপারে অতিসত্বর ব্যাবস্থা গ্রহন করব।
দৈনিক চাঁদনী বাজার / সাজ্জাদ হোসাইন