টেলিভিশনের কল্যাণে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ এখন পৃথিবীর সবচেয়ে আকর্ষণীয় ফুটবল লিগে পরিণত হয়েছে। বিশ্বের কোটি কোটি দর্শকের কাছে এটি জনপ্রিয়। পৃথিবীর বড় বড় ধনকুবেরদের অনেকেই চান প্রিমিয়ার লিগের একটি ক্লাবের মালিক হতে। তাই এই লিগের কোনো ক্লাবের যদি মালিকানায় হাতবদল হয় তাহলে তা স্বাভাবিকভাবেই একটি বড় খবর।
কয়েকদিন আগেই প্রিমিয়ার লিগ ক্লাব নিউক্যাসল কিনে নিয়েছে সৌদি আরবের একটি বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান পিআইএফ। এ খবরটি শুধু ফুটবল দুনিয়াতেই নয় তার বাইরেও চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। এর কারণ আর কিছুই নয়, নিউক্যাসল ক্লাবের ৮০ শতাংশ মালিকানা সৌদি আরবের যে পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড (পিআইএফ) কিনে নিয়েছে তার চেয়ারম্যান হচ্ছেন দেশটির ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান।
সৌদির বাদশাহ সালমানের ক্ষমতাধর পুত্র ৩৬ বছর বয়সী যুবরাজ সালমান বিশ্বে পরিচিত হয়েছেন এমবিএস হিসেবে। বলা হয়ে থাকে যে সৌদি আরব আসলে তিনিউ চালাচ্ছেন।
কিন্তু এই যুবরাজ এখন এক বিতর্কিত ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন। কারণ তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, ২০১৮ সালের অক্টোবরে তুরস্কের ইস্তাম্বুল শহরে তার নির্দেশেই সৌদি সরকারের সমালোচক জামাল খাশোগিকে হত্যা করা হয়।
২০১৯ সালে জাতিসংঘের একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, জামাল খাশোগির মৃত্যুর জন্য দায়ী সৌদি আরব। সৌদি সরকার যদিও বরাবরই তা অস্বীকার করে আসছে। সৌদি আরবে মানবাধিকার পরিস্থিতি, নারীদের অধিকার, সমকামিতার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড ইত্যাদি নানা কারণের কথাও বলেছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো।
এসব কারণ থাকলেও বিশেষ করে জামাল খাশোগির বর্বর হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপটেই নিউক্যাসল ক্লাবের সৌদি মালিকানা এক বিরাট বিতর্কের বিষয় হয়ে উঠেছে। পিআইএফ যখন নিউক্যাসল ক্লাবের ৮০ শতাংশ কেনার প্রক্রিয়া শুরু করে তখন থেকেই এটি নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়।
প্রিমিয়ার লিগের প্রধান নির্বাহী রিচার্ড মাস্টার্সকে এ বিষয়ে চিঠি দিয়েছেন নিহত জামাল খাশোগির প্রেমিকা হাতিস চেংগিসের আইনজীবীরা। তাদের চিঠিতে বলা হয়, নিউক্যাসল ক্লাবের সৌদি অধিগ্রহণ রোধ করাটাই হবে সঠিক পদক্ষেপ বিশেষ করে, খাশোগির নির্মম হত্যাকাণ্ডের কথা বিবেচনা করে।
এতে বলা হয়, ইংলিশ ফুটবলে এরকম জঘন্য কর্মকাণ্ডে জড়িত কোন ব্যক্তির স্থান হওয়া উচিত নয়। চিঠিতে আরো বলা হয়, যারা এমন মারাত্মক অপরাধ করে এবং তা হোয়াইটওয়াশ করার চেষ্টা করে এবং যারা তাদের অপকর্ম গোপন করতে বা ইমেজ বাড়াতে ইংলিশ ফুটবলকে ব্যবহার করতে চায় তাদের সাথে কোনো যোগাযোগ থাকলে প্রিমিয়ার লিগ ও ইংলিশ ফুটবলের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হবে।
বড় বড় ক্লাব বা গুরুত্বপূর্ণ ক্রীড়ানুষ্ঠানে বিনিয়োগ করে সৌদি আরব আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ক্রাউন প্রিন্সের ভাবমূর্তি উন্নত করার চেষ্টা করছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে রিয়াদ।
যুবরাজ মোহাম্মদ পৃথিবীকে এটাও দেখানোর চেষ্টা করছেন যে তিনি অতি-রক্ষণশীল সৌদি আরবে সমাজ ও আইনের সংস্কার করছেন। তার কারণেই মেয়েরা গাড়ি চালানোর অনুমতি পেয়েছেন, সিনেমা হল খুলছে এবং সঙ্গীতানুষ্ঠানের মতো বিষয়েও ধর্মীয় পুলিশের ক্ষমতা কমানো হয়েছে। এসব ঘটনা আগে ঘটেনি।
২০০৭ সাল থেকে নিউক্যাসল ক্লাবের মালিক ছিলেন মাইক এ্যাশলি। ২০১৭ সালে ক্লাবটি বিক্রি করে দেওয়ার উদ্যোগ নেন তিনি। ইংলিশ ফুটবলে নিউক্যাসল একটি ঐতিহ্যবাহী ক্লাব হিসেবে পরিচিত, তাদের ভক্তের সংখ্যাও বিশাল। কিন্তু গত এক দশক ধরেই ক্লাবটি অর্থনৈতিক সমস্যায় আক্রান্ত। ১৯৫৫ সালে এফএ কাপ জয়ের পর তারা কোন বড় শিরোপা জেতেনি। কয়েক বছর ধরেই তারা কোনমতে প্রিমিয়ার লিগে টিকে আছে।
এই ক্লাবে সম্ভাব্য ক্রেতাদের মধ্যে পিআইএফ যে এগিয়ে আছে তা অনেক দিন ধরেই জানা। তবে কিছু বিষয়ে মতপার্থক্যের কারণে চুক্তি আটকে ছিল। এর মধ্যে একটি হলো, সৌদি সরকারের বিরুদ্ধে ওঠা এই অভিযোগ যে তারা প্রিমিয়ার লিগের বাণিজ্যিক স্বত্ব চুরির ক্ষেত্রে ভুমিকা রেখেছে। জানা গেছে, নিউক্যাসল ক্লাব কেনার ঠিক আগে এই ব্যাপারে একটি সালিশ মীমাংসা হয়।
অনেকটা হঠাৎ করেই গত ৭ অক্টোবর খবর বের হয় যে, প্রিমিয়ার লিগ কর্তৃপক্ষ পিআইএফ কর্তৃক ৩০ কোটি ৫০ লাখ পাউন্ডে নিউক্যাসল ক্লাবের ৮০ ভাগ মালিকানা কিনে নেওয়ার অনুমোদন করেছে। এক বিবৃতিতে বলা হয়, কর্তৃপক্ষ আইনি নিশ্চয়তা পেয়েছে যে, সৌদি কোনভাবে এ ক্লাবকে নিয়ন্ত্রণ করবে না।
এ খবরে নিউক্যাসল শহরে ক্লাব ভক্তরা উল্লাস করতে শুরু করেন, কারণ তারা আশা করছেন এই নতুন মালিকরা নিউক্যাসলকে ম্যানচেস্টার সিটি, চেলসি বা প্যারিস সেইন্ট জার্মেইয়ের মতই বড় ধনী ক্লাবে পরিণত করবে, তারা আবার ট্রফি জিততে শুরু করবে।
অন্যদিকে এ খবরে হতাশা প্রকাশ করেছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো ও জামাল খাশোগির প্রেমিকা হাতিস চেংগিস। মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল সৌদি আরবের মানবাধিকার পরিস্থিতির কথা বলে এই চুক্তির সমালোচনা করেছে।
প্রিমিয়ার লিগের অন্য ক্লাবগুলোও এক চিঠি দিয়ে কিভাবে এই মালিকানা বদল হলো তা জানতে চেয়েছে, যদিও চুক্তি হয়ে যাবার পর তা উল্টে দেয়ার সুযোগ আর নেই। এখন সারা দুনিয়ার নজর আবার নতুন করে পড়তে শুরু করেছে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ও পিআইএফের দিকে।
যারা এমবিএস বা সৌদি আরবের মানবাধিকার রেকর্ড নিয়ে উদ্বিগ্ন তারা হয়তো অনেকেই জানেন না যে, তারা নিজেরাই এমন অনেক পণ্য বা সেবা ভোগ করছেন যেখানে পিআইএফের বিনিয়োগ রয়েছে।
ফেসবুক, ডিজনি, উবার, স্টারবাকস এগুলো হচ্ছে মাত্র কয়েকটি কোম্পানি যেখানে পিআইএফ শত শত মিলিয়ন পাউণ্ড বিনিয়োগ করেছে।
ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি ফাইজারেও বিনিয়োগ রয়েছে পিআইএফের। বলা বাহুল্য, এসব কোম্পানির নাম প্রায় সবাই জানেন। তাছাড়া ইংল্যাণ্ডের উত্তর পূর্বে বায়ুচালিত বিদ্যুৎ উৎপাদনেও বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগের পরিকল্পনা করছে পিআইএফ।
পিআইএফ হচ্ছে মূলত সৌদি সরকারের একটি রাষ্ট্রীয় সঞ্চয় অ্যাকাউন্ট। এর বিপুল অর্থের প্রধান উৎস হচ্ছে তেল- যা সৌদি আরব সারা দুনিয়ায় বিক্রি করে। কিন্তু যেহেতু তেল চিরকাল থাকবে না তাই এই ফার্মের লক্ষ্য হলো দীর্ঘমেয়াদে অর্থ আয়ের নতুন নতুন পথ নিশ্চিত করা।
ফুটবল অর্থনীতির বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ইমন চ্যাডউইক বলছেন, সৌদি আরব তাদের অর্থনীতিকে বহুমুখী করার চেষ্টা করছে এবং তারা তেলের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে আয়ের অব্যাহত উৎস তৈরি করতে চাচ্ছে।
নিউক্যাসল ক্লাব কিনে নেওয়া তাদের এই পরিকল্পনারই অংশ। যদিও পিআইএফের শত শত কোটি ডলারের অন্যসব বিনিয়োগের তুলনায় এটা অতি ক্ষুদ্র একটি ভগ্নাংশ মাত্র।
কিন্তু তাদের পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে সৌদি আরবের মানবাধিকার রেকর্ড এবং জামাল খাশোগির হত্যাকাণ্ড। সৌদি আরব এখন যা করছে - অনেক আগে থেকেই এতে যুক্ত হয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং কাতার।
সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং কাতারের শাসক পরিবার যথাক্রমে ম্যানচেস্টার সিটি এবং প্যারিস সেইন্ট জার্মেইয়ের মতো ক্লাব কিনে নিয়ে এগুলোকে বড় এবং ধনী ক্লাবে পরিণত করেছে।
দৈনিক চাঁদনী বাজার / সাজ্জাদ হোসাইন