![logo](https://dailychandnibazar.com.bd/assets/importent_images/logo.png)
দুই বছরের বেশি সময় ধরে করোনা মহামারির কবলে পড়া বিশ্ব অর্থনীতি কেবল চাঙা হওয়া শুরু করেছিল। কিন্তু ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে তাতে ভাটা পড়েছে। দেশ দুটির যুদ্ধ গড়িয়েছে দ্বিতীয় মাসে। অথচ এখনো তারা কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেনি। বার বার দু’দেশের প্রতিনিধিরা বৈঠকে বসলেও কোনো সমাধান দিতে পারেননি তারা। বরং দিন দিন আরও অভিযোগের পাহাড় জমছে একে অপরের বিরুদ্ধে। ইউক্রেনে আগ্রাসন চালানোর পর একের পর এক নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ে রাশিয়া। ফলে এই যুদ্ধের প্রভাব পড়তে শুরু করে বিশ্বের অন্যান্য দেশেও।
বিশ্বের অনেক দেশেই হু হু করে বাড়ছে খাদ্যপণ্য, গ্যাস ও জ্বালানি তেলের দাম। কোনো কোনো দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়ার প্রতিবাদে চলছে আন্দোলন, বিক্ষোভ। আন্দোলন ঠেকাতে কোথাও আবার জারি হয়েছে জরুরি অবস্থা।
যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে খোদ রাশিয়াতেই। দেশটিতে বেড়ে গেছে সব ভোগ্যপণ্যের দাম। বড় বড় সুপারসপগুলোতে জরুরি পণ্য নিয়ে ক্রেতাদের মধ্যে কাড়াকাড়ির ভিডিও ছড়িয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। জানা গেছে, ২০১৫ সালের পর সর্বোচ্চ মুদ্রাস্ফিতির কারণে চিনির দাম এখন আকাশছোঁয়া রাশিয়ায়। বাড়তি চিনি মজুত করছেন কেউ কেউ। এতে সংকট আরও তীব্র হচ্ছে। যদিও রাশিয়ার সরকারের দাবি, চিনির কোনো সংকট নেই। ক্রেতারা আতঙ্কিত হওয়ায় এমন পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে। শুধু চিনি নয় অন্যান্য পণ্যেরও দাম বেড়েছে দেশটিতে। অনেক টেক জায়ান্ট রাশিয়া থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ার কারণে দাম বেড়েছে প্রাইভেট কারসহ গৃহস্থালীর সরঞ্জামাদির। এমনকি দাম বেড়েছে টেলিভিশনেরও।
বিশ্বের প্রাকৃতিক গ্যাসের ১৭ শতাংশ উৎপাদন করে রাশিয়া। আর এই গ্যাসের জন্য রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল ইউরোপীয় দেশগুলো। ইউরোপীয় ইউনিয়নের তথ্য বলছে, ১৯৭০ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে ইউরোপ প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি শুরু করে। সম্প্রতি কয়েক বছর ধরে সেই নির্ভরতা আরও বেড়েছে। তবে ইউক্রেন আগ্রাসনের পর ইউরোপীয় দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কে ভাটা পড়েছে রাশিয়ার। এরই জেরে জার্মানিতে বেড়ে গেছে সব পণ্যের দাম। বিভিন্ন বড় বড় সুপারসপ ঘুরেও ভোজ্যতেল খুঁজে পাচ্ছেন না ক্রেতারা। শুধু তাই নয় দাম বেড়েছে অন্যান্য পণ্যেরও। ১৯৮১ সালের পর চলতি বছর মার্চে এত বেশি পরিমাণে মূল্যবৃদ্ধির ঘটনা ঘটলো জার্মানিতে।
শ্রীলঙ্কার অভ্যন্তরীণ জটিলতার কারণে দেশটির অর্থনীতি এখন বেসামাল। তবে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে শ্রীলঙ্কা পর্যটন খাতেও। দেশটির পর্যটনের সম্ভাব্য বাজার হলো বাংলাদেশ, ভারত, চীন, যুক্তরাজ্য ও জার্মানি। কিন্তু পর্যটন পুনরায় চালু হওয়ার পর থেকে বহু দর্শনার্থী পূর্বাঞ্চল থেকেও যায় দেশটিতে। রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত পর্যটক সংখ্যা ছিল ২৫ শতাংশ। রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা যেমন সুইফট থেকে লেনদেনে বাদ পড়ার প্রভাবও ফেলেছে দেশটির পর্যটনে। যারা ওই অঞ্চল থেকে শ্রীলঙ্কায় গেছেন অনেকেই তাদের কার্ড ডলারে ব্যবহার করতে পারছেন না।
ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব পড়েছে সুদূর কেনিয়াতেও। নাইরোবিতে জ্বালানি তেলের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। বেড়েছে খাদ্যপণ্যের দামও। কেনিয়ায় জাতিসংঘের দূত মার্টিন কিমানি সম্প্রতি নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
বিশ্বের বৃহত্তম গম উৎপাদনকারী দেশ রাশিয়া। রাশিয়া থেকে আমদানি নিষিদ্ধ করায় অনেক দেশে দাম বেড়ে গেছে এই খাদ্যপণ্যটির। তুরস্কে দেখা দিয়েছে সরবরাহ ঘাটতি। ইউক্রেন সারা বিশ্বে প্রথম পাঁচটি গম উৎপাদনকারী দেশের তালিকায় থাকলেও যুদ্ধ পরিস্থিতিতে কৃষ্ণসাগর সংলগ্ন বন্দর দিয়ে শস্য আমদানি-রপ্তানি প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
ইউক্রেনে রুশ হামলার পর ইরাকের বাজারে গমের দাম এখন আকাশছোঁয়া। শুধু গম নয় যুদ্ধের প্রভাবে জ্বালানি এবং বিদ্যুতের দামেও প্রভাব পড়ছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে।
খাদ্যপণ্য ও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার প্রতিবাদে বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে পেরুতে। বিক্ষোভ দমনে এক মাসের জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে প্রেসিডেন্ট পেদ্রো কাস্টিলোর সরকার। রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসনের পর থেকে দেশটিতে বেড়ে গেছে সব পণ্য ও জ্বালানি তেলের দাম। এরই প্রতিবাদে সম্প্রতি শত শত ট্রাক শ্রমিক ও খামার শ্রমিকরা সারাদেশে রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। বিক্ষোভ দমে চড়াও হয় দেশটির পুলিশ। ঘটে সংঘর্ষের ঘটনাও। পরে সরকারের তরফে ডিক্রি জারি করে বলা হয় আন্দোলন কর্মসূচি স্থগিত রাখার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে মোতায়েন থাকবে দেশটির সেনা সদস্যরা।
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ফলে খাদ্যপণ্য ও তেলের দাম বেড়েছে স্কটল্যান্ডেও। ব্রিটেনেও শ্রমিক সংগঠনগুলো দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে ক্ষুব্ধ। ব্রেক্সিটের ফলে এমনিতেই ব্রিটেনে থাকা-খাওয়ার খরচ অনেকটা বেড়ে গিয়েছিল। এবার ইউক্রেনে রুশ হামলার ফলে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে।
যুক্তরাজ্যের মানুষ তাদের খাদ্যপণ্যের তালিকা নিয়ে চিন্তিত। দেশটির পরিসংখ্যান বলছে, বছরে প্রায় ৩৮ কোটি ‘ফিস অ্যান্ড চিপস’ খায় ব্রিটিশরা। কিন্তু রাশিয়া ও ইউক্রেনের এই টালমাটাল পরিস্থিতির ফলে সংকট তৈরি হয়েছে। কঠোর নিষেধাজ্ঞার ফলে রাশিয়া থেকে মাছ, ভোজ্য তেল, জ্বালানিসহ অন্যান্য দ্রব্য আসছে না। ফলে সবকিছুর দাম বাড়ছে সেখানে।
ভারতে এক সপ্তাহের ব্যবধানে কয়েক দফায় বেড়েছে জ্বালানি তেলের দাম। বিভিন্ন রাজ্যে গ্যাসের সংকটও তীব্র। ফলে দেশটির সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের অস্বস্তি কাজ করছে।
সূত্র: ডয়েচে ভেলে, এনডিটিভি, আল-জাজিরা
দৈনিক চাঁদনী বাজার / সাজ্জাদ হোসাইন