কাগজ সংকট থেকে উদ্ভূত পরিস্থিতি ক্রমে আরও জটিল হচ্ছে। ডলার সংকটে বিদেশ থেকে ভার্জিন পাল্প আমদানি বন্ধ। রিসাইকেল পাল্পে তৈরি কাগজের মাধ্যমে বই মুদ্রণ ও স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখার খাতার প্রয়োজন মেটানোর কথা। কিন্তু পুরোনো কাগজের দামও বাড়িয়ে দিয়েছে একটি চক্র। এতে থমকে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে শিক্ষা কার্যক্রম। ঘোর অনিশ্চয়তায় পড়েছে প্রকাশনা শিল্প। সৃজনশীল বই প্রকাশের অন্যতম উপলক্ষ একুশে বইমেলাও জৌলুস হারানোর আশঙ্কায়।
কয়েকটি মিল, পাইকারি কাগজ ব্যবসায়ী এবং নোট গাইড প্রকাশকরা হাজার হাজার টন কাগজ কিনে মজুত করে ফেলেছেন বলে অভিযোগ। ফলে বাজারে দেখা দিয়েছে কাগজ সংকট। এ অবস্থায় কেবল পাঠ্যবই নয়, ফেব্রুয়ারিতে একুশে বইমেলায় সৃজনশীল বই, ছোট ছোট প্রকাশনীর গাইড বই ও লেখার খাতা তৈরি পড়েছে অনিশ্চয়তার মধ্যে। এ অবস্থায় সরকারি হস্তক্ষেপ ছাড়া কাউকে সংকট থেকে উত্তরণের উপায় নেই বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এসব বিষয়ে জানতে চাইতে বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশনা ও বিক্রেতা সমিতির সহ-সভাপতি শ্যামল পাল বলেন, আমাদের সংকট তৈরি হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে অনেক আগে থেকে সর্তক করা হলেও সরকারিভাবে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। বর্তমানে কাগজ সংকটের কারণে শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যের পাঠ্যপুস্তক ছাপানো কঠিন হয়ে পড়েছে। আবার ফেব্রুয়ারি মাসে একুশে বইমেলায় সৃজনশীল বই প্রকাশ নিয়েও বিপাকে প্রকাশকরা। এই বইমেলা আমাদের সংস্কৃতির বিকাশের একটি মাধ্যম। বইয়ের দাম দ্বিগুণ হলে পাঠক বই কেনা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন। সৃজনশীল প্রকাশনা ব্যবসায় বড় ধরনের ধস নামবে।
‘একুশে বইমেলায় প্রতিটি প্রকাশনী থেকে ২০ থেকে ১৫০টি পর্যন্ত বই প্রকাশ করা হয়। এক্ষেত্রে নামি-দামি লেখকের চেয়ে নতুন লেখকদের বই প্রকাশ হয় সংখ্যায় বেশি। নতুন লেখকরা বইমেলার মাধ্যমেই বই প্রকাশের সুযোগ পান।
এই প্রকাশক বলেন, গত বছর জানুয়ারিতে ৮০-১০০ গ্রাম অপসেট কাজ ১৪৫০-১৫০০ টাকায় বিক্রি হলেও বর্তমানে তা ৩৩০০ থেকে ৩৫০০ টাকা। ১০০ গ্রাম অপসেট কাগজ ১৭০০-১৭৫০ টাকার জায়গায় এবার ৪২০০-৪৩০০ টাকা নেওয়া হচ্ছে। প্রকাশকদের এমনিতে পুঁজির স্বল্পতা, তার উপর কাগজের দাম বেড়ে যাওয়ায় মেলায় বইয়ের দাম দেড়গুণ হয়ে যাবে। বইয়ের দাম বাড়লে পাঠকের ক্রয়ক্ষমতা কমবে। পরিচিত লেখক ছাড়া নতুন লেখকদের বই প্রকাশনা পড়বে ঝুঁকিতে।
জানা যায়, নিউজ প্রিন্ট কাগজের দাম ৪৫-৫০ টাকা থেকে বেড়ে ১০৮ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। এ কারণে বছরের শুরুতে সহায়ক বই ছাপানো থেকেও পিছিয়ে যাচ্ছেন অনেক প্রকাশক। বড় প্রকাশনীগুলো কিছু সহায়ক ছাপালেও তা দ্বিগুণ মূল্যে শিক্ষার্থীদের কিনতে হবে। বাড়তি দামে প্রকাশকরা বই ছাপবেন। মূল্য কতটা বাড়ানো হবে সেটি নিয়ে পুস্তুক প্রকাশনা ও বিক্রেতা সমিতির বৈঠক হয়েছে। সেখানে ফর্মাপ্রতি ২৫ শতাংশ মূল্য বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যে বইয়ের দাম ৬৫০ টাকা ছিল তা এখন ৮০০-৮৫০ টাকায় বিক্রি হবে।
এখন টাকা থাকলেও প্রয়োজনীয় কাগজ পাওয়া যাচ্ছে না উল্লেখ করে সমিতির সহ-সভাপতি বলেন, একাডেমিক ও সৃজনশীল বই ছাপানোয় প্রকাশকদের উপর বড় ধরনের ধাক্কা এসেছে। অনেক প্রকাশক নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। কিছু কাগজ ব্যবসায়ী কারসাজি করে মজুত করে রেখেছেন। তারা ইচ্ছামতো দাম হাঁকছেন। বিশ্ববাজারে যে পরিমাণে পাল্পের দাম তার দ্বিগুণ দামে কাগজ বিক্রি করছে মিলগুলো। সিন্ডিকেট করে সবাই সুযোগ নিচ্ছে। প্রকাশকদের পক্ষে বলার কেউ নেই।
সংকট মোকাবিলায় এই মুহূর্তে শুল্কমুক্ত কাগজ আমদানির অনুমোদন প্রয়োজন। একই সঙ্গে এই খাতকে নিত্যপ্রয়োজনীয় ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংককে পদক্ষেপ নিতে সরকারের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করার আহ্বান জানাতে হবে বলে মনে করেন তিনি।
একটি সূত্র বলছে, পাঞ্জেরী, লেকচার, অনুপম ও সরকার গ্রুপসহ কয়েকটি প্রকাশনী ঢাকার মাতুয়াইল, কেরানীগঞ্জ ও গাজীপুরে কাগজ কিনে গুদামজাত করে রেখেছে। অন্যদিকে বিসমিল্লাহ ও ইউসুফ এন্টারপ্রাইজসহ নয়াবাজারকেন্দ্রিক কিছু কাগজ সরবরাহকারী বিভিন্ন মিল থেকে কাগজ কিনে বাজারে তৈরি করেছেন কৃত্রিম সংকট। আর এই সংকট পুঁজি করে দ্বিগুণ দামে বিক্রি করছে কাগজ। কয়েকটি মিল, কাগজ ব্যবসায়ী, রিসাইকেলড পাল্প তৈরির জন্য ব্যবহৃত (পুরোনো) কাগজ সরবরাহকারী এবং আর্ট পেপার ব্যবসায়ী- এ চার পর্যায়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে দাম বাড়িয়েছে। এতে বিপাকে পড়েছেন মুদ্রাকররা। অগ্রিম টাকা দিয়েও অনেকে চাহিদামতো কাগজ পাচ্ছেন না।
কাগজ মজুত রাখার বিষয়ে জানতে চাইলে লেকচার প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী মেহেদী হাসান বলেন, বিষয়টি আসলে সত্য নয়। আমাদের যতটুকু প্রয়োজন সেই পরিমাণে কাগজ হয়তো কিনে রাখা হয়েছে। বিষয়টি আমি দেখভাল করি না, আমার প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক করেন।
এদিকে দুই পেপার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী মো. ইসমাইলের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, যার কাছ থেকে যে দরে আগাম টাকা নেওয়া হয়েছে সেই দরেই কাগজ দিচ্ছি। সব মিল ‘বুক’ করে রাখার প্রশ্নই ওঠে না। দেশে ১৫-২০টি মিল কাগজ উৎপাদন করে। এর মধ্যে আমি মাত্র তিনটি মিল নিয়ে কাজ করি।
তিনি আরও বলেন, এটা ঠিক যে রিসাইকেলড পাল্পে ৮০ শতাংশ উজ্জ্বলতার কাগজ উৎপাদন করতে পারে শুধু তাদের মিলগুলো। তারা কাগজ গুদামজাত করেননি।
দৈনিক চাঁদনী বাজার / সাজ্জাদ হোসাইন