কুদ্দুছ খার তিন মেয়ের মধ্যে মোছা. পারুল আক্তার (১৫) দেখতে বেশ সুন্দর ও মেধাবী। তাই বাবা আঃ কুদ্দুছ খার স্বপ্ন ছিল মেয়েকে উচ্চশিক্ষিত করে ভালো জায়গায় বিয়ে দেবেন। কিন্তু পারুল দশম শ্রেণিতে পড়া অবস্থাই একই এলাকার মো. নাছির উদ্দিন ওরফে বাবুর (১৯) সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন।
বিয়ে দেওয়ার জন্য দুই পরিবারকে জানানো হলেও পারুলের বাবা রাজি হননি। একপর্যায় নাসির উদ্দিন ও পারুল পালিয়ে বিয়ে করেন। এতে আঃ কুদ্দুছ খার সম্মানহানি হয়, ক্ষুব্ধ হন মেয়ে ও তার জামাতার প্রতি। ক্ষোভের বশবতি হয়ে নাসির উদ্দিনকে ফাঁসাতে নিজের মেয়েকেই খুন করেন বাবা।
ঘটনার সাত বছরেও থানা পুলিশ, ডিবি, সিআইডি, পিবিআই (টাঙ্গাইল) তদন্ত করে কোনো রহস্য উদঘাটন করতে না পারলেও অবশেষে খুনের ঘটনা উন্মোচন করে বাঁকা জেলা পিবিআই।
রোববার (২২ জানুয়ারি) দুপুর ১২টায় রাজধানীর ধানমন্ডিতে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) সদর দপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান পিবিআই প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি বনজ কুমার মজুমদার।
সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ঘটনার শুরু ২০১২ সালে। ওই বছর টাঙ্গাইলের কালিহাতির গড়িয়া গ্রামের আঃ কুদ্দুছ খার মেয়ে মোছা. পারুল আক্তার পার্শ্ববর্তী এলাকার মো. নাছির উদ্দিন ওরফে বাবুকে (১৯) ভালোবেসে ঢাকায় পালিয়ে বিয়ে করেন। এই ঘটনায় কুদ্দুছ খা ২০১২ সালে কালিহাতি থানায় জিডি করেছিলেন। উভয়ের পরিবার বিয়ে মেনে না নেওয়ায় তারা ঢাকার আশুলিয়ার জামগড়ায় বসবাস শুরু করে।
নাসির উদ্দিন চাকরি নেন পোশাক কারখানায়। নানা কারণে তাদের পারিবারিক অশান্তি চলতে থাকে। পারুল তার বাবাকে ফোন করে অশান্তির কথা জানায়। বাবা মেয়ের ভবিষ্যত নিয়ে বেশ চিন্তিত ছিল। অপমান বোধ ও প্রচন্ড রাগও ছিল। একপর্যায় ভালো ছেলে দেখে অন্য জায়গায় বিয়ে দিয়ে উন্নত জীবন যাপনের লোভ দেখায় বাবা।
তিনি বলেন, ২০১৫ সালের ১৮ জুলাই পারুলের স্বামী নাসির তার নানিকে দেখতে যায়। সেই সুযোগে বাবার দেওয়া আশ্বাসে পারুল পরদিন তার বাবাকে ফোন করে টাঙ্গাইলে চলে যায়। একই দিন পারুল আক্তারের স্বামী মো. নাছির উদ্দিন আঃ কুদ্দুছ খার বিরুদ্ধে মেয়েকে বাবার বাড়ি পালিয়ে যেতে প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগে আশুলিয়া থানায় জিডি করেন।
কিন্তু ওই দিন বাবা তার মেয়েকে নিজ বাড়িতে না নিয়ে বন্ধু মোকাদ্দেছ ওরফে মোকা মন্ডলের বাড়ি ভূঞাপুরে নিয়ে যায়। সেখান থেকে মোকাদ্দেছ ওরফে মোকা মণ্ডল ভবিষ্যতে পারুলকে প্রতিষ্ঠিত করবে এবং কিছুদিন নাসির উদ্দিনের কাছ থেকে লুকিয়ে থাকতে হবে এই আশ্বাস দিয়ে জয়পুরহাটের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। কুদ্দুছ খা এর আগে দীর্ঘ ১২ বছর জয়পুরহাটের পাঁচবিবি এলাকায় থাকায় ওই এলাকার সবকিছু চিনতো। পরে মেয়েকে নিয়ে তুলসী গঙ্গা নদীর পাশে নির্জন জায়গায় নিয়ে যায়।
হত্যার ঘটনার বিষয়ে পিবিআই প্রধান জানান, তারা তিনজন রাতের অন্ধকারে নদীর পাড় দিয়ে হাঁটতে থাকেন। মেয়ের আগের কার্যকলাপের অপমান সইতে না পেরে রাগে বাবা মেয়েকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। তারপর মেয়ের ওড়না দুই টুকরা করে বাবা মেয়ের হাত এবং মোকাদ্দেছ ওরফে মোকা মন্ডল পা বাঁধে। বাবার নিজের গামছা দিয়ে মেয়ের গলায় পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। পারুলের মরদেহ নদীতে ফেলে দিয়ে তারা টাঙ্গাইলে চলে আসেন।
ঘটনার তদন্তের বিষয়ে তিনি বলেন, ২০১৫ সালের ৪ আগস্ট মো. নাছির উদ্দিনের পরিবারের বিরুদ্ধে টাঙ্গাইলের বিজ্ঞ আদালতে পেনাল কোডে মামলা করেন পারুলের বাবা কুদ্দুস খা। কালিহাতি থানা পুলিশ তদন্ত করে প্রেম করে বিয়ে করার সংশ্লিষ্টতা পায়। কিন্তু অভিযুক্তকে না পওয়ায় ঘটনাস্থল তাদের এখতিয়ার বহির্ভূত এলাকা (ঢাকায়) মর্মে প্রতিবেদন দাখিল করে।
ডিবি পুলিশ, পিবিআই (টাঙ্গাইল), সিআইডি (টাঙ্গাইল) তদন্ত করে একই প্রতিবেদন দাখিল করে। পরে আদালত জুডিশিয়াল তদন্ত করে প্রতিবেদন দেয়, বাদী ঢাকার আদালতে মামলা করলে প্রতিকার পেতে পারে। ২০২২ সালের ২৭ নভেম্বর আঃ কুদ্দুছ খা বিজ্ঞ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন আদালতে তদন্ত প্রতিবেদনসহ নারী নির্যাতন দমন আইন ২০০০ এ যৌতুকের জন্য মারপিট করে হত্যা মামলার আবেদন করে।
তিনি বলেন, গত ৩০ নভেম্বর আদালত আশুলিয়া থানাকে মামলা রুজু এবং পিবিআই ঢাকা জেলাকে তদন্তের নির্দেশ দিলে আশুলিয়া থানায় ১১ ডিসেম্বর মামলা দায়ের করা হলে পিবিআই ঢাকা ভোলা তদন্ত শুরু করে। পিবিআই মো. নাছির উদ্দিনকে গ্রেফতার করে আদালতে পাঠায়। বাদী আ. কুদ্দুছ খাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে অসামঞ্জস্য তথ্য দেন।
পরে তার ব্যবহৃত মোবাইল নম্বরের সূত্র ধরেই এক পর্যায়ে তিনি নিজেই তার মেয়েকে হত্যার কথা স্বীকার করেন। তার দেওয়া তথ্য যাচাই করার জন্য পিবিআই ঢাকা জেলা জয়পুরহাটের পাঁচবিবি থানা থেকে ২০১৫ সালের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে। পাঁচবিবি থানায় করা মামলার আলামত, সুরতহালের বর্ণনা এবং পোস্টমর্টেম প্রতিবেদনের সঙ্গে কুদ্দুস খার বর্ণনার মিল পাওয়া যায়। এই ঘটনায় আসামি মোকাদ্দেছ ওরফে মোকা মন্ডলকেও গ্রেফতার করা হয়েছে।
দৈনিক চাঁদনী বাজার / সাজ্জাদ হোসাইন