ভুল চিকিৎসায় গালফ এয়ারের পাইলটের মৃত্যু, দাবি বোনের | Daily Chandni Bazar ভুল চিকিৎসায় গালফ এয়ারের পাইলটের মৃত্যু, দাবি বোনের | Daily Chandni Bazar
logo
প্রকাশিত : ৩০ জানুয়ারী, ২০২৩ ১৭:০২
ভুল চিকিৎসায় গালফ এয়ারের পাইলটের মৃত্যু, দাবি বোনের
অনলাইন ডেস্ক

ভুল চিকিৎসায় গালফ এয়ারের পাইলটের মৃত্যু, দাবি বোনের

গালফ এয়ারের পাইলট ক্যাপ্টেন মোহান্নাদ ইউসুফ আল হিন্দি ঢাকার একটি হাসপাতালে অবহেলা ও ভুল চিকিৎসায় মারা গেছেন বলে দাবি করেছেন তার বোন। সোমবার (৩০ জানুয়ারি) দুপুরে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে মোহান্নাদ ইউসুফ আল হিন্দির বোন তালা এলহেনডি এমনটি দাবি করেন।

জানা গেছে, তারা ভাই-বোন দুজনই যুক্তরাষ্ট্র ও জর্ডানের দ্বৈত নাগরিক। ইউসুফ আল হিন্দি গলফ এয়ারের পাইলট ছিলেন। আর তালা এলহেনডি ব্রিটিশ সরকারের হয়ে কাজ করেন। ভাইয়ের অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর পর তিনি বাংলাদেশে ছুটে আসেন। খোঁজ-খবর নিয়ে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতাল ও গালফ এয়ার কর্তৃপক্ষের অবহেলার নানা প্রমাণ পেয়েছেন বলে দাবি করেছেন। এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে বিস্তারিত তুলে ধরেন তালা এলহেনডি।

সংবাদ সম্মেলনে তালা এলহেন্ডি বলেন, গত ১৪ ডিসেম্বর রাতে ইউসুফ হাসান আল হিন্দি ঢাকার মেরিডিয়ান হোটেলে ছিলেন। দিবাগত রাত পৌনে ৩টার দিকে তিনি ফ্লাইটের জন্য প্রস্তুত হয়ে বের হয়ে যান। ভোর ৪টার দিকে বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়া সম্পন্নের সময় অসুস্থ হলে তাকে ইউনাইটেড হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেওয়া হয়। সেখানে তিনি পরপর চারবার কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের শিকার হন। এরপর ১৫ ডিসেম্বর দুপুর ১২টার দিকে মারা যান ইউসুফ হাসান।

তিনি জানান, ভাইয়ের অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর পর তিনি বাংলাদেশে ছুটে আসেন। ইউনাইটেড হাসপাতালের কাছে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র চাইলে তাকে অসহযোগিতা করা হয় এবং দেরি করে কাগজপত্র দিলেও সেখানে জালিয়াতি করা হয়েছে বলে তিনি দাবি করেন।

তিনি দাবি করেন, মূলত তাকে হত্যা করা হয়েছে। এজন্য তিনি ইউনাইটেড হাসপাতালের বিরুদ্ধে যথাযথ ফৌজদারি ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে ন্যায়বিচার চান এবং ইউনাইটেড হাসপাতালের লাইসেন্স বাতিলের দাবি করেন। নিজের কর্মস্থল গালফ এয়ারও সময়মতো তার চিকিৎসা নিশ্চিত করতে পারেনি বলেও দাবি করেন তিনি।

তালা এলহেনডি আরও বলেন, চিকিৎসা প্রক্রিয়ার সময় তাকে ওষুধ প্রয়োগ করে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছিল। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলেছেন, আমার ভাইয়ের চিকিৎসা করেছেন ডা. কায়সার নাসির। কিন্তু আমার ভাইয়ের পরিবারের কাছে চিকিৎসার যে কাগজপত্র জমা দেওয়া হয়েছে, তাতে তার নাম পাওয়া যায়নি। রিপোর্টে বলা হয়েছে, আমার ভাইয়ের অ্যাজমা ছিল। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তারা বলেছে যে ভুল করে এটা বাদ পড়ে গেছে। ফোনে কার্ডিওলজিস্টের পরামর্শ নেওয়া হয়েছে। তিনি সশরীরে রোগীর কাছে উপস্থিত ছিলেন না।

তিনি বলেন, ভোর পৌনে ৬টায় আমার ভাইকে সিসিএমে স্থানান্তর করা হয়। এটির নাম কার্ডিয়াক কেয়ার ইউনিট। ঝুঁকিপূর্ণ রোগীর চিকিৎসাসেবা দিতে সেখানে অন্তত একজন কার্ডিওলজিস্ট ও তাৎক্ষণিক বিশেষ সেবা দেওয়ার দরকার ছিল। কিন্তু অদক্ষ চিকিৎসকরা অবহেলা করেছেন। কার্ডিওলজি কেয়ারের জন্য একটি ইউনিট করা হলেও সেখানে কোনো কার্ডিওলজিস্ট ছিলেন না।

‘সকাল পৌনে ৭টায় দ্বিতীয় কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয় আমার ভাইয়ের। ২০ মিনিট পর তৃতীয় কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট করেন তিনি। দুই ঘণ্টার ব্যবধানে আমার ভাইয়ের তিনবার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়। কোনো কার্ডিওলজিস্টের সঙ্গে যোগাযোগ করতে ঢাকা শহরের সবচেয়ে জনপ্রিয় এই হাসপাতালের কার্ডিয়াক বিশেষজ্ঞ ইউনিট আবার ব্যর্থ হয়েছে, যা সিসিএম কর্মীদের নিছক ও চরম অবহেলা ছাড়া কিছু না। তারা একমাত্র যে পদক্ষেপটি নিয়েছে, তা হলো আরিএসসি-এর সঙ্গে ১৫ মিনিট সিপিআর করেছে। আমার ভাই তৃতীয়বার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট করলে সোয়া দুই ঘণ্টা পর্যন্ত তাকে কোনো চিকিৎসাসেবা ছাড়াই ফেলে রাখা হয়েছে। অর্থাৎ তিনি সঠিক চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত ছিলেন।’ বলেন তালা এলহেনডি।

তিনি বলেন, কনজারভেটিভ ম্যানেজমেন্ট ট্রিটমেন্টের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর চিকিৎসক আমার ভাইকে হেপারিন সোডিয়াম ৫০০০ আইইউ ইনজেকশন দিয়েছেন। রক্তজমাট বাঁধা বন্ধ করতে এটি দেওয়া হয়। এতে আরও পরিষ্কার হয়ে উঠেছে যে, রোগীর চিকিৎসায় সেখানে কোনো কার্ডিওলজিস্ট ছিলেন না। কাজেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বাদে সাধারণ কর্মীদের পরামর্শ ছিল চরম অবহেলা।

তিনি বলেন, বেলা সোয়া ১১টায় চিকিৎসা চলার মধ্যেই আমার ভাইয়ের চতুর্থ ও শেষবারের কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়েছে। তাকে ৪৫ মিনিট সিপিআর দেওয়া হয়। টিপিএম বসানোর পরেই তিনি মারা যান। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবি, ডা. কায়সার নাসির এসব প্রক্রিয়া করেছেন। কিন্তু তিনি কোনো কার্ডিওলজিস্ট কিনা তাও পরিষ্কার না। কারণ চিকিৎসার কাগজপত্রে তার নাম উল্লেখ নেই। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দাবি করেন, এটা ভুল হয়েছে। একজন জ্যেষ্ঠ কনসালটেন্ট (ডা. কায়সার উল্লাহ ও অন্য কনসালটেন্টরা) এনজিওগ্রাম করেছেন বলে তারা জানান। কিন্তু রিপোর্টে তাদের নাম নেই। আর কেন কোনো সারসংক্ষেপ রিপোর্ট নেই জানতে চাইলে তারা বলেন, এগুলো অভ্যন্তরীণ কাগজপত্র। একজন কার্ডিওলজিস্ট আমার ভাইয়ের চিকিৎসায় পরামর্শ দিলেও তিনি হাসপাতালে সশরীরে ছিলেন না।

‘আমি পুরো বিষয়টি তদন্ত করে দেখতে পেয়েছি যে, সিসিটিভি ফুটেজ ও হাসপাতালের কাগজপত্রে কারসাজি করা হয়েছে। এছাড়া আমি যখন অনুসন্ধান করছিলাম, তখন হাসপাতালের কর্মীরাও আমাকে ভয় দেখিয়েছেন। গত ২৬ জানুয়ারি, ইউনাইটেড হাসপাতালের কাছে আমি চিকিৎসার কাগজপত্র ও সিসিটিভির ফুটেজ দেখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু প্রমাণাদি কারসাজি করতে তারা এসব দিতে তিনদিন সময় নিয়েছিল।’

তালা এলহেনডি বলেন, তাদের কাছে যখন জানতে চাচ্ছিলাম, তখন তারা আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করেন ও রূঢ় ব্যবহার করেন। এরপর আইনগত পদক্ষেপ নেওয়ার হুমকি ও দূতাবাসকেও এ বিষয়ে জানানো হবে বললে তারা আমাকে বিস্তারিত কাগজপত্র দিয়েছেন। কিন্তু এজন্য তারা তিনদিন সময় নিয়েছেন। এসময়ে সব কাগজপত্র কারসাজি করা হয়েছে। তারা কোনো কোনো তথ্য গোপন করেন, আবার কোনোটি যুক্ত করেন। এসব কাগজপত্রকে তারা হাসপাতালের সম্পত্তি বলে দাবি করলেও তা অন্য চিকিৎসকের কাছে রয়েছে জানিয়ে আমাকে দিতে বিলম্ব করে। তারা বলেছিল, ওই চিকিৎসকের ফুরসত মিললেই আমাকে কাগজপত্র জমা দেওয়া হবে। এভাবে তারা আমাকে তিনদিন অপেক্ষায় রেখেছেন। এমনকি দীর্ঘ বিলম্বের পরও রোগীর হৃদকম্পন পরীক্ষার ২০টি পাতা দিয়েছেন তারা আমাকে। কিন্তু তাতে সঠিক কার্ডিওলজি রিপোর্ট কিংবা চিকিৎসার বিস্তারিত তথ্য ছিল না।

তিনি বলেন, যখন আমি হাসপাতালে যাই ও অনুসন্ধান চালাই, আমি দেখলাম যে কার্ডিয়াক কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) কোনো কার্ডিওলজিস্ট নেই। অথচ সেখানেই আমার ভাইকে ভর্তি করার পর দীর্ঘসময় রাখা হয়েছিল। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ পরামর্শ নিতে আমি যুক্তরাষ্ট্রের চিকিৎসকদের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তারা বলেছেন, নিয়মানুসারে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আমার ভাইকে জরুরি চিকিৎসা প্রক্রিয়ার মধ্যে নিয়ে যাওয়া উচিত ছিল, সেখানে ইউনাইটেড হাসপাতালে ছয় ঘণ্টা লেগেছে। অনুসন্ধানে আমি দেখেছি, সিএজি করা হয়েছে বলে প্রমাণ দিতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পরে কাগজপত্র জালিয়াতি করেছে। যে কারণে কাগজপত্র দিতে তারা অযাচিত বিলম্ব করেছেন ও অজুহাত দেখিয়েছেন।

তিনি বলেন, কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হওয়ার পর আমার ভাই অচেতন হয়ে পড়েন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি সেই অবস্থায়ই ছিলেন। তিনি গালফ এয়ারের একটি ফ্লাইটে ওঠার সময় এটা হয়েছে। তিনি এই ফ্লাইটের একজন পাইলট ছিলেন। নিজের দায়িত্ব পালনের সময় তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। কাজেই গালফ এয়ার কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব ছিল তিনি যাতে সঠিক চিকিৎসা পান তা নিশ্চিত করা। এছাড়া গালফ এয়ারের কাছে থাকা আমার ভাইয়ের অতীতের চিকিৎসার ইতিহাস ইউনাইটেড হাসপাতালে জমা দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তারা তা করেনি। পরিবারের অনুপস্থিতিতে অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করতে কোনো কর্মকর্তাকে হাসপাতালে পাঠায়নি গালফ এয়ার।

‘অথচ ১০ মিনিট পরেই ৫০০ যাত্রী নিয়ে পাইলট হিসেবে আমার ভাইয়ের নেতৃত্বের গালফ এয়ারের একটি ফ্লাইটের উড়াল দেওয়ার কথা ছিল। বিমান চালনার সময় তিনি অসুস্থ হলে ৫০০ যাত্রীর জীবনও হুমকিতে পড়ে যেতে পারতো। কিন্তু আমার ভাইয়ের সঠিক চিকিৎসা নিশ্চিত করতে কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি গালফ এয়ারকে।’

তিনি বলেন, আমার ভাইয়ের হাসপাতালে ভর্তি ও চিকিৎসার পূর্ণাঙ্গ নির্ভেজাল রিপোর্ট ও সিসিটিভির ফুটেজ চাই। রোগী/ভুক্তভোগীর বোন হিসেবে আমার ভাইয়ের চিকিৎসার আদ্যোপান্ত জানতে চাই। কার মাধ্যমে এসব হয়েছে, তাও জানার অধিকার আমার আছে। হাসপাতাল বলছে, আমার ভাইয়ের চিকিৎসার কাগজপত্র গোপনীয় নথি। তারা চিকিৎসার কাগজপত্রে কারসাজি করেছে। আমার ভাইয়ের নির্ভেজাল কাগজপত্র হাতে পাওয়া অবৈধ কিংবা অনৈতিক কিছু না। এরকম অপরাধের পুনরাবৃত্তি রোধে দৃষ্টান্তমূলক জরিমানা কিংবা ক্ষতিপূরণ চাই।

তিনি বলেন, তারা মূলত আমার ভাইকে হত্যা করেছে। তাই ইউনাইটেড হাসপাতালের বিরুদ্ধে যথাযথ ফৌজদারি ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে আমি ন্যায়বিচার চাই এবং সবশেষে ইউনাইটেড হাসপাতালের লাইসেন্স বাতিল করার দাবি জানাচ্ছি।

 দৈনিক চাঁদনী বাজার / সাজ্জাদ হোসাইন