ভারতের আদানি গ্রুপ থেকে বিদ্যুৎ আমদানির সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ও বাংলাদেশ পরিবেশ নেটওয়ার্ক (বেন)। শুক্রবার (৩ মার্চ) বাপা সভাপতি সুলতানা কামাল ও বেন-এর বৈশ্বিক সমন্বয়কারী ড. মো. খালেকুজ্জামানের পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে এ দাবি জানানো হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, যেখানে বাংলাদেশের নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার প্রায় অর্ধেক অলস থেকে যাচ্ছে সেখানে বিদেশ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে বিদ্যুৎ আমদানি মোটেও যৌক্তিক নয়। তদুপরি আদানি কোম্পানির কাছ থেকে যেসব শর্তে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ কিনতে যাচ্ছে তা বাংলাদেশের জন্য খুবই প্রতিকূল।
এতে আরও বলা হয়, এসব শর্তের অধীনে আদানি কোম্পানিকে যেসব আর্থিক সুবিধা দেওয়া হচ্ছে তা বাংলাদেশের অন্য কোনো কোম্পানিকে দেওয়া হয়নি। সংবাদ মাধ্যমে এই চুক্তির যেসব বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী দিকের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে তার কয়েকটি নিম্নরূপ।
প্রথমত যেখানে বাংলাদেশের বিভিন্ন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ইউনিট-প্রতি কয়লা ব্যবহারের পরিমাণ এগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা ব্যবহারের সকল মাত্রার জন্য একই ধরা হয়েছে, সেখানে আদানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য উৎপাদন ক্ষমতা কম ব্যবহৃত হলে ইউনিট-প্রতি কয়লা ব্যবহারের পরিমাণ বাড়িয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে। শুধু এ কারণেই বাংলাদেশকে বছরে অতিরিক্ত ছয় হাজার ৫০০ কোটি টাকার বেশি ব্যয় করতে হতে পারে।
দ্বিতীয়ত বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (পিডিবি) চার মাস পরপর আদানি কোম্পানির কাছে বিদ্যুতের চাহিদাপত্র পাঠাতে হবে এবং পরিবর্তিত পরিস্থতির কারণে যদি পিডিবির চেয়ে কম বিদ্যুৎ কেনে তবুও চাহিদাপত্রে উল্লিখিত পরিমাণের পুরো দাম বাংলাদেশকে পরিশোধ করতে হবে। তৃতীয়ত বাংলাদেশকে আদানি বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদিত ক্ষমতার এক-তৃতীয়াংশ পরিমাণের বিদ্যুৎ কিনতেই হবে; নাহলে জরিমানা দিতে হবে। চতুর্থত যদি পিডিবির চাহিদা-স্বল্পতার কারণে আদানি বিদ্যুৎকেন্দ্রের বাণিজ্যিক উৎপাদনে যাওয়া বিলম্বিত হয় তবে বাংলাদেশকে পুরো ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হবে। পঞ্চমত আদানি বিদ্যুৎকেন্দ্রে কয়লা ব্যবহারে সিস্টেম লসের দায়ভার বাংলাদেশকে বহন করতে হবে।
ষষ্ঠত আদানি বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহারের জন্য বিদেশ থেকে যে কয়লা আমদানি করা হবে তার দাম নির্ভর করবে আদানির নিজের ওপর, কারণ এই কোম্পানি বিদেশে কয়লা খনিতে উত্তোলন থেকে শুরু করে পরিবহন, সবকিছুর নিয়ন্ত্রক। সপ্তমত আদানির সাথে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ ক্রয়চুক্তি সই করেছে ২০১৭ সালের নভেম্বরে। কিন্তু ভারত সরকার কর্তৃক ২০১৯ সালে ঝাড়খণ্ডকে “বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল বলে ঘোষণা করার ফলে আদানি কোম্পানি বহু ধরণের কর সুবিধা পাচ্ছে। অথচ আদানি কোম্পানি এ বিষয়ে কোনো তথ্য পিডিবিকে জানায়নি এবং বাংলাদেশকে এসব কর সুবিধার অংশীদার করায় প্রয়াসী নয়। অষ্টমত এই প্রকল্পের সকল ঝুঁকি বাংলাদেশের উপর চাপানো হয়েছে এবং বহু বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছে।
আদানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ ক্রয়চুক্তির উপর্যুক্ত বৈশিষ্ট্যের কারণে বাংলাদেশের ভোক্তা সমিতি ‘এই চুক্তির জালিয়াতি সবকিছুকে ছাড়িয়ে গেছে’ বলে অভিমত প্রকাশ করেছে। বাপা ও বেন এই চুক্তি বাতিলের দাবি সমর্থন করছে।
বাপা ও বেন আরও জানায়, বাংলাদেশ সরকার প্রথমে টোকিও ইলেকট্রিক কোম্পানি এবং পরে ইনস্টিটিউট অব এনার্জি ইকনোমিকস, জাপান প্রণীত এমন একটি বিদ্যুৎ পরিকল্পনা অনুসরণ করছে যা শুধু কয়লানির্ভর নয়, বিদেশনির্ভরও বটে! এই পরিকল্পনা অনুযায়ী বাংলাদেশের মোট বিদ্যুৎ সরবরাহে আমদানিকৃত বিদ্যুতের অংশ ২০২১ সালের ৫ শতাংশ থেকে ২০৫০ সালে ১৫ শতাংশে বৃদ্ধি পাবে।
এতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশের বিদ্যুৎ আমদানির বর্তমান হার আফগানিস্তান ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য সব দেশের চেয়ে বেশি। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে ঢাকায় অনুষ্ঠিত বাপা ও বেন আয়োজিত ‘জ্বালানি, জলবায়ু পরিবর্তন ও স্থায়িত্বশীল উন্নয়ন’ বিষয়ক সম্মেলনে এ পরিকল্পনার সমালোচনা করা হয় এবং কয়লার ওপর নির্ভরতা কমিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ভূমিকা বাড়িয়ে এবং আমদানিকৃত বিদ্যুৎ পরিহার করে নতুন বিদ্যুৎ পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং অনুসরণের দাবি জানানো হয়। এই দাবির প্রতি মনোযোগী হতে সরকারকে আহ্বান জানাায় সংগঠন দুটি।
দৈনিক চাঁদনী বাজার / সাজ্জাদ হোসাইন