
উত্তরবঙ্গের অন্যতম বিদ্যাপীঠ বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজে এক যুগেরও বেশী সময় ধরে বন্ধ হয়ে আছে ছাত্রদের তিনটি আবাসিক হল। নতুন করে ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ছাত্রীদের আরেকটি হলেও এখনো উঠতে পারেনি শিক্ষার্থীরা। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির বাজারে শিক্ষার্থীদের থাকতে হচ্ছে ভাড়া বাসায় কিংবা মেসে অথচ অলস পরে আছে নিজেদের প্রতিষ্ঠানের হলগুলো। হলগুলো কবে খুলবে নিশ্চিত বলতেও পারছেন না কলেজ কর্তৃপক্ষ।
জানা যায়, বৃহত্তম এই বিদ্যাপীঠে অধ্যয়ন করছে ২৫ হাজারেরও বেশী শিক্ষার্থী। আর শিক্ষার্থীদের আবাসন সুবিধা নিশ্চিতে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে কলেজের নতুন ও পুরাতন ভবন মিলে রয়েছে ৬টি হোস্টেল। যার মাঝে ছাত্রদের জন্য পুরাতন ভবনে ফকরুদ্দিন হলের ১শ আসনের একটিও খালি নেই আর চালু থাকা ছাত্রীদের জন্যে দু’শ আসনের বেগম রোকেয়া হলে গাদাগাদি করে থাকছে প্রায় সাড়ে ৩’শ ছাত্রী। যেখানেও বেশ কয়েকটি কক্ষ বসবাস অনুপযোগী আর বাকি ৪টি হলই পরে আছে অলস অবস্থায় যার মাঝে শের-ই বাংলা হলের চিত্র যুদ্ধবিধ্বস্ত কোন স্থাপনার ধ্বংসাবশেষের মতো।
এদিকে ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে আরেকটি ছাত্রী হোস্টেলের নির্মাণ কাজ শেষ হলেও চালু হয়নি এখনো। একই সাথে নতুন ভবনে পাশাপাশি অবস্থিত মুন আকতার আলী ও তিতুমীর হল বন্ধ এক যুগেরও বেশী সময় ধরে। কোটি কোটি টাকায় নির্মিত হলগুলো চালু থাকলে প্রতি বছর শিক্ষার্থীদের খাবার ও আবাসন বাবদ বাড়তি খরচ বাঁচতো প্রায় ৭০ লাখ টাকার কাছাকাছি। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির বাজারে দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীরা যদি এই হলে থাকার সুযোগ পেতো তাহলে মাত্র সাড়ে ১৩’শ টাকায় চলে যেত তাদের থাকা ও খাবার খরচ। যেখানে এখন গুনতে হচ্ছে নুন্যতম তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা। আর হলগুলো চালু না থাকায় দুর-দুরান্ত থেকে আসা শিক্ষার্থীদের দূর্ভোগ-খরচ দুটোই বাড়ছে।
কলেজের পাশেই বেসরকারি একটি মেসে থাকা কলেজের শিক্ষার্থী সাজেদুল ইসলাম জানান, সিরাজগঞ্জ থেকে পরিবার পরিজন ছেড়ে সুশিক্ষার আশায় এই শহরে এসেছেন। কিন্তু দ্রব্যমূল্যের এই উর্ধ্বগতির বাজারে মেসের ভাড়া ও খাবার খরচ যোগাতেই এখন হিমশিম খেতে হচ্ছে। বাড়তি আয়ের জন্যে পার্টটাইম চাকরি নিয়েছেন তিনি যার দরুণ লেখাপড়ায় পরছে নেতিবাচক প্রভাব। সাজেদুল বলেন আজ যদি আবাসিক হলগুলো চালু থাকতো তাহলে তারা নিশ্চিতে তাদের লেখাপড়া করতে পারতো।
কলেজের অপর আরেকজন শিক্ষার্থী সঙ্গীত দাস বলেন, এটি তাদের দুভার্গ্য যে বিশ^বিদ্যালয় জীবনে আবাসিক হলে থাকার মাধ্যমে একে অপরের সাথে যে সৌহার্দ্য ও সম্পর্কের জন্ম হয় এবং সৃষ্টি হয় হাজারো সুন্দর স্মৃতির তার সবকিছু থেকেই তারা বঞ্চিত হয়েছেন। একদিকে যেমন অর্থনৈতিক ক্ষতি তেমনি হলের অবকাঠামো থাকার পরেও হলে থাকতে না পারার আক্ষেপ সবমিলিয়ে চরম হতাশা এটি শিক্ষার্থীদের জন্যে।
সরেজমিনে পরির্দশনে দেখা যায়, যে হলগুলোর মাঠে বিচরণ করার কথা ছিলো কলেজের শিক্ষার্থীদের কিন্তু সেখানে এখন চড়ানো হচ্ছে গরু। আর দীর্ঘদিনের অবহেলা এবং কলেজ কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার সুযোগ নিয়ে হলগুলোর ভবন বেয়ে গজিয়েছে নানা গুল্মজাতীয় গাছ।
কলেজের আরেকটি হল ছিলো শের-ই বাংলা যার বর্তমান চিত্র প্রথম দেখায় মনে হতে পারে যুদ্ধ -বিধ্বস্ত কোন ভবনের দৃশ্য। কিন্তু এটিও একসময় ছিলো ছাত্রদের ঠিকানা। কিন্তু এই হলের ইট কাঠ পাথর থেকে শুরু করে আসবাবপত্র কোনকিছুরই হদিস নেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির কাছে।
জানা যায়, ২০০৯ সালে ছাত্রদের দু’পক্ষের সংঘর্ষের পর বন্ধ হয় মুন আকতার আলী ও তিতুমীর হলের দরজা। এরপর হল থেকে উধাও হয়ে যায় তৈজস ও আসবাবপত্রসহ যাবতীয় মালামাল। সম্প্রতি হল দু’টি সংস্কার করা হলেও সম্পন্ন হয়নি অভ্যন্তরীন গোছানোর কাজ।
এ প্রসঙ্গে বগুড়া জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সজীব সাহা হলগুলোর এমন বেহাল চিত্রের জন্যে কলেজ প্রশাসনের উদাসীনতাকেই দুষছেন। তিনি বলেন, জেলা ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে বারংবার কলেজ কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করা হলেও দীর্ঘবছর ধরে কাজ সমাপ্ত হয়নি বলে বলে শুধু বিলম্ব করা হচ্ছে। হলগুলো খুলতে আর কত দেরি এমন প্রশ্ন ভাবাচ্ছে তাদেরও। এদিকে ছাত্ররা হারাচ্ছে তাদের ন্যায্য অধিকার। তিনি আরো বলেন, দীর্ঘ বছর ধরে বন্ধ থাকা এই আবাসিক হলগুলো চালুর বিষয়ে তারা আন্তরিকভাবে কলেজ প্রশাসনকে সহযোগিতা করবেন।
কবে খুলবে আবাসিক হলগুলো এমন প্রশ্নে বগুড়া সরকারী আজিজুল হক কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মো: শাহজাহান আলী বলেন, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর এখনো তাদের আনুষ্ঠানিকভাবে নব-নির্মিত মেয়েদের হলের শতভাগ কাজ বুঝিয়ে দেয়নি। ছেলেদের হল নিয়েও হয়নি কোন সিদ্ধান্ত। এছাড়াও হলগুলোতে এখনো নিশ্চিত হয়নি গ্যাস ও বিদ্যুৎ সুবিধাসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত চাহিদাগুলো। তবে শীঘ্রই হলগুলো চালুর বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। অধ্যক্ষ আরো বলেন, আসন্ন ঈদ-উল আযহার পরে বগুড়া বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষামন্ত্রীর আসার কথা রয়েছে। মন্ত্রীর আগমনে আবাসিক হলগুলো আবারো নতুন সম্ভবনার আলোয় আলোকিত হতে পারে।
তবে প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থী ও বগুড়ার গণমানুষের প্রত্যাশা একে অপরের গাফিলতি না খুঁজে যদি সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দ্রুততম সময়ে মেয়েদের জন্য নতুন হলটিসহ, মুন আকতার আলী, তিতুমীর ও শের-ই বাংলা হল চালু হয় তবে নিশ্চিত হবে ৪’শ শিক্ষার্থীর আবাসন পাশাপাশি নতুন করে প্রাণবন্ত হবে এই ক্যাম্পাস। এছাড়াও বছরে বাড়তি প্রায় ৭০ লাখ টাকা খরচ থেকে বেঁচে যাবে শিক্ষার্থীদের।
দৈনিক চাঁদনী বাজার / সাজ্জাদ হোসাইন