রাজধানীর হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সেবামূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত। তবে সুশাসনের বিবিধ চ্যালেঞ্জ প্রতিষ্ঠানটি দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যবান। চেয়ারম্যানের একচ্ছত্র ক্ষমতা এবং হাসপাতাল পরিচালনা কার্যক্রম তার অবারিত হস্তক্ষেপে প্রতিষ্ঠানটিতে জবাবদিহিতায় বাধা নিশ্চিত করেছে।
রোববার (২৫ জুন) সকালে টিআইবির আয়োজনে ‘হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক ভার্চুয়্যাল আলোচনা সভায় এ তথ্য জানানো হয়।
প্রতিষ্ঠানটির লাইসেন্স নিয়মিত নবায়ন না করা, ক্রয় আইন, তথ্য অধিকার আইন, মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল সংক্রান্ত আইন ও বিধান অমান্য করছে। জনবল কাঠামো না থাকায় অপরিকল্পিত নিয়োগ, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির কারণে হাসপাতালটির রোগী ও আয় হ্রাস পেয়েছে। অন্য হাসপাতালের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ব্যর্থ হয়ে ক্রমেই একটি দুর্বল প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়েছে।
গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন টিআইবি সদস্য তাসলিমা আক্তার ও মাহফুজুল হক। এপ্রিল ২০২২ থেকে ২০২৩ সালের মে মাস পর্যন্ত মুখ্য তথ্যদাতার সাক্ষাৎকার, অংশগ্রহণমূলক পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা থেকে গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।
গবেষণা প্রতিবেদনে জানানো হয়, প্রতিষ্ঠানটিতে পৃথক মানবসম্পদ কাঠামো নেই। ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন ও কমিটির সদস্য কারা হবে সেই সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা নেই। বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি (বিডিআরসিএস) এর চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান, ট্রেজারার ও ক্ষমতাশীন দল সংশ্লিষ্টরা কমিটিতে প্রাধান্য পান। নিয়োগ, অনুদানের অর্থের আয় ব্যয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণে চেয়ারম্যান একচ্ছত্র ক্ষমতা দেখান।
হাসপাতালটিতে আধুনিক যন্ত্রপাতির ঘাটতি রয়েছে। রোগীদের কাছ থেকে অভিযোগ আসার পরেও হাসপাতালটিতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয় না। কেবিনেন গুমোট গন্ধ, স্যাতস্যাতে দেয়াল, রোগীর শয্যায় ছারপোকা, রাস্তার বর্জ্য থেকে কেবিনে দুর্গন্ধ আসে।
রোগীদের পক্ষ থেকে বলা হলেও শয্যার চাদর প্রতিদিন পরিবর্তন করা হয় না। ভর্তির ৪-১৫ দিনে একবার বিছানার চাদর পরিবর্তন করার হয় বলে অভিযোগ আছে।
ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু ছাড়াও জরুরি প্রয়োজনে নার্স না পাওয়ার অভিযোগ আছে। নার্সদের বিরুদ্ধে রোগীর সঙ্গে খারাপ আচরণ ও প্রতিনিয়ত বখশিশ আদায়ের অভিযোগ আছে।
৫২৮ শয্যার হাসপাতালটিতে ৫৫২ জন কর্মী। যা মধ্যে ৩০০ এর বেশি প্রশাসনিক কর্মী। অথচ প্রতিষ্ঠানটিতে পরিচ্ছন্নতা কর্মী ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসকের ঘাটতি রয়েছে। রাজনৈতিক নিয়োগের ফলে প্রশাসনিক কাজে প্রয়োজনের চেয়ে প্রায় ৩ গুন বেশি জনবল রয়েছে। প্রশাসনিক কাজে সম্পৃক্ত ২০৮ জনের সুনির্দিষ্ট কোনো কাজ নেই বলে গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। প্রতিষ্ঠানটিতে প্রায় ১০ কোটি টাকা কর্মীদের বেতন বকেয়া রয়েছে। এছাড়া প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুয়িটিসহ মোট বকেয়ার পরিমাণ ৫৩ কোটি টাকা।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, জেএমআই নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে সুবিধা দিতে হাসপাতালের নিজস্ব ডায়ালেসিস মেশিন অকেজো রাখার অভিযোগ আছে। ২০টি মেশিনের পরিবর্তে ১২টি মেশিনে কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। যার মধ্যে ৮টি মেশিন জেএমআই সরবরাহ করেছে। বাকি ৪টি হাসপাতালের। ডায়ালসিস সেন্টার স্থাপনে জেএমআইয়ের সঙ্গে অসম চুক্তি করা হয়েছে। ফলে ডায়ালাসিস সেবায় রোগীর দেওয়া ২৬৫০ টাকার মধ্যে ১৫০০ টাকা বা ৫৬.৬ শতাংশ অর্থ হলি ফ্যামিলির হাতছাড়া হচ্ছে।
হাসপাতালটির সুনাম পুনরুদ্ধারে ১৪টি সুপারিশ দেওয়া হয়েছে প্রতিবেদনে। যার মধ্যে রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির জন্য বাস্তবসম্মত মানবসম্পদ কাঠামো প্রণয়ন। অবকাঠামোগত সংস্কার, কর্মীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, প্রশাসনিক কার্যক্রম ডিজিটালাইজ করা, অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের শাস্তির ব্যবস্থা করা ইত্যাদি।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, প্রতিষ্ঠানটির অভ্যন্তরে বড় ধরনের দুর্বলতা চিহ্নিত হয়েছে। যেটা উদ্বেগজনক। হাসপাতাল পরিচালনায় বেশ কিছু আইন ও নীতিমালার অনুপস্থিত বা ঘাটতি আছে।
তিনি বলেন, এক ব্যক্তির হাতে একচ্ছত্র ক্ষমতা থাকায়, পরিচালনা কার্যক্রমে তার (চেয়ারম্যানের) কর্তৃত্ব ও হস্তক্ষেপ অবারিত থাকায় জবাবদিহিতা নিশ্চিত হচ্ছে না। এর ফলে নিয়মনীতি মানা হচ্ছে না, সেবা প্রদানে ঘাটতে দেখা যাচ্ছে।
দৈনিক চাঁদনী বাজার / সাজ্জাদ হোসাইন