১৭ বছর ধরে মেডিকেলের প্রশ্নফাঁস করে আসছে চক্রটি | Daily Chandni Bazar ১৭ বছর ধরে মেডিকেলের প্রশ্নফাঁস করে আসছে চক্রটি | Daily Chandni Bazar
logo
প্রকাশিত : ১৩ আগস্ট, ২০২৩ ১৫:৪৯
১৭ বছর ধরে মেডিকেলের প্রশ্নফাঁস করে আসছে চক্রটি
অনলাইন ডেস্ক

১৭ বছর ধরে মেডিকেলের প্রশ্নফাঁস করে আসছে চক্রটি

পেশায় চিকিৎসক তারা। কিন্তু ২০০১ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে তারা জড়িত। এর মধ্যে ১০ বার প্রশ্ন ফাঁস করে চক্রটি। আর এতে হাতিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। গত ৩০ জুলাই থেকে ১০ দিন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে প্রশ্নফাঁসে জড়িত ৭ চিকিৎসকসহ ১২ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।

এসময় তাদের কাছ থেকে ৯টি মোবাইল ফোন, ৪টি ল্যাপটপ, নগদ ২ লাখ ১১ হাজার টাকা, ১৫ হাজার একশ বিদেশি মুদ্রা থাই বাথ, বিভিন্ন ব্যাংকের ১৫টি চেক বই, ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড, ভর্তির এডমিট কার্ড উদ্ধার করা হয়েছে।

রোববার (১৩ আগস্ট) দুপুর সাড়ে ১২টায় রাজধানীর মালিবাগে সিআইডির মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান সংস্থাটির প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া।

তিনি বলেন, পাবলিক পরীক্ষা সামনে আসলেই একশ্রেণির চক্র বেশ সক্রিয় হয়ে উঠে প্রশ্নফাঁস করার জন্য। এই চক্রটি নানা কায়দায় প্রশ্নফাঁস যেমন করে, তেমনি গুজব ছড়িয়ে পরিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের বিভ্রান্তও করে। শিক্ষাখাতের ক্যানসার হিসেবে বিবেচিত এসব প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রকে নির্মূল করতে কাজ করছে পুলিশ।

সিআইডির প্রধান বলেন, দেশের মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষাগুলোতে নিয়মিত প্রশ্নফাঁসকারী বিশাল এক সিন্ডিকেটের খোঁজ পায় সিআইডির সাইবার পুলিশ। ২০২০ সালে মিরপুর মডেল থানায় করা এক মামলায় সম্প্রতি চক্রের অন্তত ৮০ জন সক্রিয় সদস্য বিগত প্রায় ১৬ বছরে হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে অবৈধ উপায়ে মেডিকেল কলেজগুলোতে ভর্তি করিয়ে শত কোটি টাকা আয় করেছে। প্রশ্নফাঁস করে মেডিকেলে ভর্তি হয়েছেন এমন শতাধিক শিক্ষার্থীর নাম পেয়েছে সিআইডি। এর মধ্যে অনেকে পাশ করে ডাক্তারও হয়েছেন।

গ্রেফতারের বিষয়ে অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া বলেন, গত ৩০ জুলাই থেকে ১০ দিন ঢাকাসহ টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ, বরিশাল জেলায় অভিযান পরিচালনা করে এ চক্রটির ১২ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। এর মধ্যে ৭ জনই ডাক্তার। তাদের সবাই বিভিন্ন মেডিকেল ভর্তি কোচিং সেন্টার, নয়তো প্রাইভেট পড়ানোর আড়ালে প্রশ্নফাঁস করতেন।

২০০১ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ১৬ বছরে অন্তত ১০ বার এই চক্র মেডিকেলের প্রশ্নফাঁস করেছে। গ্রেফতার আসামিদের কাছ থেকে শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের দেওয়া বিপুল সংখ্যক ব্যাংকের চেক এবং এডমিট কার্ড উদ্ধার করা হয়েছে। এদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে কোটি কোটি টাকার লেনদেনের তথ্য পাওয়ার কথাও জানান তিনি।

প্রশ্নফাঁস চক্রের মাস্টারমাইন্ড জসীম উদ্দিন ভূইয়ার কাছ থেকে একটি গোপন ডায়েরি উদ্ধার করা হয়েছে। যেখানে সারাদেশে ছড়িয়ে থাকা তার চক্রের অন্যান্য সদস্যদের নাম রয়েছে। সেসব তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে বলেও জানান সিআইডি প্রধান।

গ্রেফতারদের বিষয়ে সিআইডি জানায়, মেডিকেল প্রশ্নফাঁস চক্রে রয়েছেন চিকিৎসক স্বামী-স্ত্রী। স্বামী চিকিৎসক ময়েজ উদ্দিন আহমেদ প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের অন্যতম হোতা ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করে ফেইম নামক কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে মেডিকেল প্রশ্নফাঁস চক্রের সঙ্গে জড়ান। এর মাধ্যমে প্রশ্নপত্র ফাঁস করে অবৈধভাবে শত-শত শিক্ষার্থীকে মেডিকেলে ভর্তি করিয়েছেন। প্রশ্নফাঁস ও মানি লন্ডারিং মামলার আসামি ময়েজ চিহ্নিত ছাত্র শিবির নেতা এবং পরবর্তীতে জামায়াতের ডাক্তার হিসেবে পরিচিত। তার স্ত্রী সোহেলী জামান (৪০) প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের অন্যতম সদস্য। তিনি জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের ডাক্তার। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করে ফেইম নামক কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে স্বামী ময়েজের মাধ্যমে মেডিকেল প্রশ্নফাঁস চক্রের সঙ্গে জড়ান তিনি।

২০০৫ সালে প্রশ্ন পেয়ে ঢাকা ডেন্টাল কলেজে ভর্তি হয়ে এই প্রশ্নফাঁস চক্রের সঙ্গে জড়ান গ্রেফতার চিকিৎসক মো.আবু রায়হান। প্রাইমেট কোচিং সেন্টার চালাতেন। কিশোরগঞ্জের হোসেনপুরে একটি বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে প্রাকটিস করেন। আরেক চিকিৎসক জেড এম সালেহীন শোভন (৪৮) স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করে থ্রি-ডক্টরস নামক কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে মেডিকেল প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে জড়িত হন। প্রশ্নফাঁসের মাধ্যমে শোভন বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। তিনি ২০১৫ সালে র‍্যাবের হাতে একবার গ্রেফতারও হয়েছিলেন। শোভন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের ছাত্রদলের পদধারী নেতা ছিলেন বলেও জানায় সিআইডি।

এছাড়া গ্রেফতার চিকিৎসক মো. জোবাইদুর রহমান জনি (৩৮) মেডিকো ভর্তি কোচিং সেন্টারের মালিক। ২০০৫ সাল থেকে এই চক্রে জড়িত। সিআইডির দাবি, তিনি নামকরা বিভিন্ন ডাক্তারের সন্তানদের প্রশ্নফাঁস করে মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ করে দিয়েছেন। তিনি মূলত মেডিকেল প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত চক্রের মূল হোতা ও বর্তমানে কারাগারে থাকা জসীমের গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী। এই ব্যবসা করে দামি গাড়ি, বাড়ি, ব্যাংকে নগদ অর্থসহ কোটি কোটি টাকা আয় করেছেন। প্রশ্নফাঁসের মাধ্যমে অবৈধভাবে শত শত শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন সরকারি-বেসকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি করান। জনি স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের ছাত্রদলের সভাপতি ছিলেন। পরে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য সম্পাদক ছিলেন। বর্তমানে যুবদলের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক।

সিআইডি প্রধান জানান, চিকিৎসক জিলুর হাসান রনি (৩৭) জাতীয় পঙ্গু হাসপাতাল (নিটোর) একজন ডাক্তার। ২০০৫ সাল থেকে এই চক্রের সঙ্গে জড়িত হন। ২০১৫ সালের মেডিকেল পরীক্ষার সময় র‍্যাবের হাতে প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে রংপুর থেকে গ্রেফতার হন। রংপুর মেডিকেলে অধ্যায়নকালে ছাত্রদল নেতা ছিলেন। বর্তমানে ড্যাব এর সঙ্গে জড়িত এবং আহত বিএনপি নেতাদের চিকিৎসায় গঠিত দলের একজন চিকিৎসক। গ্রেফতার চিকিৎসক ইমরুল কায়েস হিমেল (৩২) পিতা আব্দুল কুদ্দুস সরকারের মাধ্যমে এই চক্রের সঙ্গে জড়ান। বেসরকারি কমিউনিটি ব্যাজড মেডিকেল কলেজ, ময়মনসিংহ থেকে পাশ করেন। ২০১৫ সালে টাঙ্গাইলের আকুর-টাকুর পাড়ায় নিজ শ্বশুর বাড়িতে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন পড়িয়ে বিপুল সংখ্যাক শিক্ষার্থীকে অবৈধভাবে মেডিকেলে ভর্তি করান।

সিআইডির হাতে গ্রেফতার জহিরুল ইসলাম ভূঁইয়া মুক্তার (৬৮) মেডিকেল প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের হোতা জসীম এর বড় ভাই ও স্বাস্থ্য-শিক্ষা ব্যুরো প্রেসের মেশিনম্যান সালামের খালাতো ভাই। তিনি নিজে আলাদা একটি চক্র চালাতেন। প্রশ্নফাঁসের মাধ্যমে অবৈধভাবে শত শত শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি করিয়েছেন। রওশন আলী হিমু (৪৫) চক্রের হোতা জসীমের ঘনিষ্ট বন্ধু এবং পুরোনো সহযোগী। রওশন আলী হিমু জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। ২০০৬ সাল থেকে মেডিকেল প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে জড়িত হিমু আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

আক্তারুজ্জামান তুষার (৪৩) মেডিকেল প্রশ্নফাঁস চক্রের মাস্টারমাইন্ড জসীমের ঘনিষ্ট সহচর। ই-হক নামে কোচিং সেন্টার চালাতেন। ২০০৫ সাল থেকে এই চক্রের সঙ্গে জড়ান। ২০১৫ সালে রাবের হাতে একবার গ্রেফতারও হয়েছিল। জহির উদ্দিন আহমেদ বাপ্পী (৪৫) মেডিকেল প্রশ্নফাঁস চক্রের মাস্টারমাইন্ড জসিমের পুরোনো সহচর। ঢাকার ফার্মগেটে ইউনিভার্সেল নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি সহায়তা কেন্দ্র চালাতেন। ২০০৫ সাল থেকে এই চক্রের সঙ্গে জড়িত। প্রাইমেট, থ্রি ডক্টরসসহ বিভিন্ন মেডিকেল কোচিং সেন্টারে ফাঁসকৃত প্রশ্ন সরবরাহ করতেন।

গ্রেফতার আব্দুল কুদ্দুস সরকার (৬৩) টাঙ্গাইলের মিন্টু মেমোরিয়াল হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে অবসরে গেছেন। মেডিকেল প্রশ্নফাঁসের হোতা জসীমের ঘনিষ্ঠ সহচর। ২০০৬ সালে মেয়ে কামরুন নাহার কলিকে ভর্তির মাধ্যমে এই চক্রে জড়ান। এরপর ছেলে ইমরুল কায়েস হিমেলকে সঙ্গে নিয়ে টাঙ্গাইল এবং ময়মনসিংহে গড়ে তোলেন প্রশ্নফাঁসের এক সিন্ডিকেট। জসীমের বাসায় নিয়মিত যাতায়াত ছিল কুদ্দুসের। জসীমও ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে নিয়মিত টাঙ্গাইল যেতেন।

দৈনিক চাঁদনী বাজার / সাজ্জাদ হোসাইন