
শুন্য থেকে শুরু করে নিজেকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে কাজ করে যাচ্ছেন বগুড়ার তরুণী সুহাদা জামান। রান্না খাবারের সমাহার নিয়ে পরিবারের দ্বিমতের বিরুদ্ধে উদ্যোক্তা হওয়ার লড়াইয়ে নামেন। চাকুরী না পেলেও উদ্যোক্তা জীবনের যুদ্ধে নেমে হয়েছেন সফল।
শুরুতে পরিবার থেকেই বাঁধা প্রাপ্ত হলেও এখন আর সেদিন নেই। পরিবারের সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে গেছেন অনেক পথ। রান্না খাবারের সঙ্গে যোগ করেছেন হ্যান্ডিক্রাফট, ব্লক বাটিক, প্রিন্ট, হ্যান্ড পেইন্ট, আধুনিক পোশাক ডিজাইন। উদ্যোক্তা সেজে কাজের মানের কারণে তিনি বেশ সুনাম কুঁড়িয়েছেন। ইন্টারনেট মাধ্যমে এসে তার পরিসর বেড়েছে আগের থেকে কয়েকগুণ। চাকুরীর বাজারে না ঘুরে তিনি এখন পুরো বাণিজ্যিকভাবে এগিয়ে নিজের আয়ের পথ গড়ে তুলতে সচেষ্ট হয়ে আছেন। সুহাদার সফলতার পর অনেক নারীরই এখন তার কাছে কাজের বিষয়গুলো শিখতে আসছেন। দিনে দিনে নিজেকে গড়ে নিজেই নিজের খরচ বহন করে হয়েছেন সফল উদ্যোক্তা।
জানা যা, বগুড়া শহরের কালিতলা এলাকার আলোর মেলা স্কুল লেনে সুহাদা জামান (২৯) এর বাড়ি। তার বাবা আইনজীবী গহর জ্জামান মাহবুব আর মা হলেন গৃহিনী শাহনাজ বেগম। একমাত্র ভাই জুনাইদ জামান মাহী কলেজে পড়ছেন। সুহাদা বগুড়া সৈয়দ আহম্মেদ কলেজ থেকে বাংলায় অর্নাস শেষ করেন ২০১৭ সালে। অনার্স এর রেজাল্ট হওয়ার পরপরই তার পরিবার ধীরে ধীরে নানা সমস্যায় জড়িয়ে পড়েন। আইনজীবী পিতা হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে গেলেন। তার বাবার অসুখগুলো সেরে ওঠে না। পরিবার পরিচালনা করা, বাবার চিকিৎসা খরচ, ছোট ভাইয়ের লেখাপড়া, নিজের লেখপড়াসহ সব মিলিয়ে মাথায় যেন পাহাড়সম চাপ বসে পড়ে। বিভিন্ন স্থানে চাকুরীর জন্য হন্য হয়ে খুঁজেও কোন কাজ পাননি। শেষে নিজেকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে সপে দেন। অনলাইন একটা পেইজ খুলে প্রথমে রিসেলার (অন্যের পণ্য বিক্রি করা) হিসেবে কাজ শুরু করেন। করোনাকালে তাকে আরো ভাবিয়ে তোলে। করোনার সময় কাজ না থামিয়ে কিছু কিছু অর্ডার নিয়ে সেল করতে থাকেন। রিসেলার হিসেবে কাজ করতে বেশ অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। এরপরে তিনি নিজের পণ্য তৈরী ও বিপণন এর জন্য উঠে পড়ে লাগেন। অনলাইন দেখে বেশ কিছু প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। আর কিছু বিষয় তিনি নিজেই রপ্ত করেন। বিভিন্ন ধরনের মজাদার সব দেশি বিদেশী খাবার রান্না করে অনলাইনে হোম ডেলিভারি শুরু করেন। রান্না করা খাবারের স্বাদে ক্রেতারা আকৃষ্ট হয়ে উঠলো। বড় পরিসরে সাজাতে রান্না করা খাবারের পাশাপাশি শুরুতে ছোট ভাইয়ের রঙ নিয়ে ইচ্ছেমত পেইন্ট শুরু করে সেগুলো বিক্রির জন্য অনলাইনে দেন। তাতে ধীরে ধীরে সাড়া পেতে থাকেন। পরে তিনি কাপড়ে হ্যান্ড পেইন্টিং শুরু করেন। এর সঙ্গে ধীরে ধীরে অনলাইন, অফলাইনে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। প্রথমে খাবার হিসেবে শুধু চিকেন বান নিয়ে কাজ শুরু করেন। খুব কম সময়ে খাবারটি জনপ্রিয় হয়ে যায়। অনেকেই তাকে বান আপু বলে ডাকতো। পরে এই চিকেন বানটি শহরের বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে বিক্রী শুরু হতে থাকে। হোমমেড খাবার নিয়ে কাজ করতে গিয়ে বগুড়া শহরে তার নামডাক ছড়িয়ে গেলো। আর খাবার দেশি, বিদেশি, কেক, আচার, পিঠা নিয়ে কাজ শুরু করেন। এরমধ্যে খেজুরের লাড্ডু যা নাম দিয়েছেন ক্যান্ডিবাইট। ক্যান্ডিবাইট তার সিগনেচার পণ্য। খেজুর সাথে বিভিন্ন ধরনের পুষ্টিকর খাবার দিয়ে বিশেষ ব্যবস্থায় তৈরী হয় খেজুরের ক্যান্ডিবাইট। ক্যান্ডিবাইট খুব দ্রুত ভোক্তাদের নজরে পড়ে। সবার মন জয় করে নেয়। চিনি ছাড়া তৈরি এই ক্যান্ডিবাইট ছোট-বড়, সব বয়সী মানুষ খেতে পারে। এর গুণগতমান বজায় রেখে সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যকরণ ঘরয়ো ভাবে তৈরি করা হয় বলে সুহাদা জামান জানান।
হোমমেডের পাশাপাশি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে পেইন্টিং নিয়েও কাজ করছেন। এখন শাড়িতে, পাঞ্জাবিতে, সিরামিক মগ এ, কাঁচের গ্লাস এয়, আয়নাতে, ওয়ালপেপার, চাদর, জামা, মাঠির তৈজসপত্র সহ মাটি দিয়ে তৈরী গহনা, কাপড় দিয়ে গহনা তৈরিও করেন। হাতের তৈরি গহনা দেশ এর বাহিরের যাচ্ছে এখন।
উদ্যাক্তা সুহাদা জামান জানান, নিজে উদ্যাক্তা হবেন সেটা কখনো তিনি ভাবেন নি। যে দিন তিনি শুরু করেছিলেন। তখন তার কোন লগ্নি করার মত টাকাও ছিলো না। পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে ধার করা টাকায় শুরু হয় তার দেশি বিদেশি খাবার নিয়ে কাজ। নানা বাঁধা আর বিপত্তি পার হতে হয়েছে তাকে। তবে নিজে এমন কিছু করেতে চেয়েছিলেন যেন মেয়েদের সাহায্য করতে পারেন। একদিকে বাবা অসুস্থ। আবার উদ্যাক্তা নিয়ে বাবার নানাভাবে বাঁধা প্রদান। সব মিলিয়ে নানা চাপ। তারপরও নিজেকে এগিয়ে যেতে হয়েছে। প্রথম দিকে না পেলেও কিছুদিনর পর মা শাহনাজ বেগম, ফুপি মোরশেদা বেগম, ফুপা নাজিম উদ্দীন, ফুপাতো বোন নাজিয়া, ভাই নাফিস, নিজের ছোট ভাই মাহীর প্রচুর সহযোগিতা পেতে থাকেন। এই মানুষগুলোর নাম না বললে হয়তো উদ্যাক্তা হওয়া সম্ভব হতো না। কিছুটা সফল হলে পরে অবশ্য বাবাও সাপোর্ট শুরু করেন। এখন পরিবারের পাশাপাশি বিভিন্ন উদ্যাক্তারা সাপোর্ট করছেন। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হলো নিজের প্রতিষ্ঠান করা। মেয়েদেরকে ট্রেনিং করানো, পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতা করা। অনলাইন পেইজের নাম শখ-শৌখিন যেখানে সকল ধরনের পেইন্টিং এর জিনিস এবং মাটির তৈরি গহনা বিক্রি হয়। হোমমেড খাবার এখন অনেক ক্রেতা বা ভোক্তা নিয়মিত যোগাযোগ করছেন। সফল কি না জানিনা। তবে নিজের আয় নিয়ে তিনি বেশ সন্তুষ্টু।
এভাবেই এগিয়ে যাচ্ছেন একজন সুহাদা জামান। যিনি চাকুরীর পেছনে না ছুটে নিজেই চাকুরী শুরু করে দিয়েছেন। সুহাদারা এ সমাজের আলোকিত নারীদের একজন।
দৈনিক চাঁদনী বাজার / সাজ্জাদ হোসাইন