ডেঙ্গুর টিকা আবিষ্কার নিয়ে কাজ করছে ভারতের অন্যতম টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ভারত বায়োটেক। জটিল ধরনের ভাইরাস ও ভ্যারিয়েন্টের দ্রুত পরিবর্তনের কারণে ডেঙ্গুর টিকা তৈরি বেশি চ্যালেঞ্জের হলেও এ নিয়ে গবেষণায় অনেকদূর এগিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। তবে মশাবাহিত রোগ চিকুনগুনিয়া এবং গরুর চর্মরোগ লাম্পি ভাইরাসের টিকা গবেষণায় সফলতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে ভারত বায়োটেক। নতুন এই টিকা তৃতীয় ট্রায়াল শেষে অনুমোদন পর্যায়ে রয়েছে বলে জানিয়েছেন ভারত বায়োটেক কর্তৃপক্ষ। শুধু তাই নয় অনুন্নত ও উন্নয়নশীল বিভিন্ন দেশে তুলনামূলক কম মূল্যে টিকা দিচ্ছেন তারা যে ধারাবাহিকতা সর্বদা বজায় রাখার প্রত্যাশা প্রতিষ্ঠানটির।
সম্প্রতি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আমন্ত্রণে ভারত সফররত বাংলাদেশি সাংবাদিক প্রতিনিধি দলের সদস্যদের সাথে হায়দ্রাবাদে প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ইতিবাচক এই সংবাদ জানান ভারত বায়োটেক কর্তৃপক্ষ।
কর্তৃপক্ষ জানান, ভারত বায়োটেক অসংক্রামক রোগ ক্যানসার এবং ডায়াবেটিসের টিকা আবিষ্কারেও অনেক দূর এগিয়েছে তবে কবে নাগাদ তা আনুষ্ঠানিকভাবে বাজারে ছাড়তে পারবে তা এখনো নিশ্চিত নয় কারণ তারা শতভাগ সফল ট্রায়াল কিংবা গবেষণা না করে জনগণের জন্যে উন্মুক্ত করবেনা। তারা বলেন, প্রতিষ্ঠানটিতে বর্তমানে টিবি ভ্যাকসিনেরও ট্রায়াল চলছে, জিকা ভাইরাস নিয়ে গবেষণাও রয়েছে শেষ পর্যায়ে। এছাড়াও উর্ধ্বগতির এই বাজারে নি¤œবিত্ত ও স্বল্প আয়ের মানুষের কথা চিন্তা করে সাশ্রয়ী টিকা আবিষ্কারের চেষ্টাও চালাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।
শিশুদের ডায়রিয়া রোধে রোটা ভাইরাসের টিকার ডোজ কমিয়ে আনাতেও ভূমিকা রেখেছে ভারত বায়োটেক। তারা রোটাভ্যাকের ডোজ আড়াই মিলি থেকে হাফ মিলিতে (.৫০) নামিয়ে আনতে সক্ষম হন। এতে পরিবহন খরচ ও উৎপাদন খরচ যেমন কমে যায়, তেমনি শিশুদের ওপর ওষুধের কার্যকারিতা বেড়ে যায়। আলোচনাকালে তাদের গবেষণায় আইসিডিডিআরবিতে কর্মরত বাংলাদেশি বিজ্ঞানী ডা. ফেরদৌসী কাদরির মেধার প্রশংসাও করেন ভারতীয় উপমহাদেশের সেরা এই প্রতিষ্ঠানটি। ইচ্ছা পোষণ করে অদূর ভবিষ্যতে সহযোগী হয়ে বাংলাদেশেও কাজ করার। গৌরবের বিষয় হচ্ছে ভারত বায়োটেকের উদ্ভাবন করা ১৯টি ভ্যাকসিন বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যবহার হচ্ছে যার মাঝে অনেক দেশ আগে আমেরিকাসহ অন্যান্য দেশের টিকা অধিক মূল্যে কিনে ব্যবহার করতো। এসব ভ্যাকসিনের মধ্যে চারটি ইতোমধ্যে অনুমোদন করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)।
কর্তৃপক্ষ বলেন, বিগত কয়েক বছর ধরে ভারত বাংলাদেশসহ এই অঞ্চলে ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ে পশুর চর্মরোগ লাম্পি ভাইরাস। কৃষকের ভয়াবহ ক্ষতি ঠেকাতে লাম্পি ভাইরাসের টিকার অনুমোদন এখন শেষ পর্যায়ে রয়েছে বলে জানান ভারত বায়োটেক কর্তৃপক্ষ যা ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে এই রোগ প্রতিরোধে। আলোচনা কালে জানা যায়, করোনা মহামারী মোকাবিলায় মানুষের ইনজেকশন-ভীতি দূর করার উদ্যোগ নিয়েছিল ভারত বায়োটেক। নাকে ব্যবহারের একমাত্র করোনা টিকা আবিষ্কার করে প্রতিষ্ঠানটি। কর্তৃপক্ষ দাবি করেন, বিশ্বে এ পর্যন্ত যেসব কোভিড ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হয়েছে এর মধ্যে কোভ্যাক্সিন সবচেয়ে নিরাপদ। এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া মাত্র ১৫ শতাংশ, যেখানে অক্সফোর্ড, মডার্নার টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ৭০ শতাংশ। এসময় করোনাকালীন সময়ে বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্বের স্বাক্ষী হিসেবে ভারত বায়োটেকের ভূমিকা নিয়েও ইতিবাচক আলোচনা হয়।
বর্তমানে ভারত বায়োটেক মানুষের পাশাপাশি পশু-পাখি ও গাছের বিভিন্ন রোগের টিকা নিয়েও কাজ করছে বলে জানান তারা। আলু, পেঁয়াজসহ এমন যেকোনো খাদ্যপণ্যে যদি কোনো রোগ বিপর্যয় নিয়ে আসে তাহলে সেটা রোধে আগাম প্রস্তুতি নিয়ে ভারত বায়োটেক কাজ করছে বলেও জানানো হয়।
প্রতিষ্ঠানটি পরিদর্শনে জানা যায় কিভাবে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে ভারত বায়োটেকের কো-ফাউন্ডার ও এক্সিকিউটিভ চেয়ারম্যান কৃষ্ণা এলা ভ্যাকসিন গবেষণায় বর্তমানে বিপ্লব সাধন করে চলেছে। বিশেষ করে করোনার কঠিন সময়ে অক্সফোর্ড, অ্যাস্ট্রাজেনেকা, মডার্নার মতো ভ্যাকসিনের পাশাপাশি দ্রুততম সময়ে কোভ্যাক্সিন আবিষ্কার করে তাক লাগিয়ে দেয় ভারত বায়োটেক।
উল্লেখ্য, ১৯৯৬ সালে ভারতের তেলেঙ্গানা রাজ্যের জেনম ভ্যালিতে প্রতিষ্ঠিত হয় ভারত বায়োটেক। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ড. কৃষ্ণা এম এলা জন্মগতভাবে ভারতের নাগরিক হলেও একটি সময় লেখাপড়া ও গবেষণা কাজের সূত্রে নেন মার্কিন নাগরিকত্ব। পরে দেশের জন্যে কিছু করার তাগিদে স্ত্রী সুচিত্রা এলার অনুপ্রেরণায় স্ব-স্ত্রীক ফিরে এসে ভারতের নাগরিকত্ব ফেরত নেন এবং হায়দ্রাবাদ শহর থেকে কিছুটা অদূরে জেনম ভ্যালীতে দিনে দিনে গড়ে তোলেন বর্তমানের ভারত বায়োটেক আর ড. কৃষ্ণা এম এলা নিজের মেধা ও যোগ্যতায় বর্তমানে শুধু ভারতের নয় হয়ে উঠেছেন পুরো বিশ্বের সম্পদ। ভারত বায়োটেকের বিনিয়োগ বতর্মানে ৩৫ লাখ ডলারের বেশি। শুধু ভ্যাকসিন উৎপাদন নয় বেশকিছু সিস্টার কনসার্ন আছে বায়োটেকের। নিরাপত্তার চাদরে মোড়া প্রতিষ্ঠানটিতে বর্তমানে কয়েক হাজার মানুষ কাজ করছেন যাদের অধিকাংশই ভারতসহ বিভিন্ন দেশের মেধাবী শিক্ষার্থী যাদের অধিকাংশই তরুণ প্রজন্মের যারা একদিকে যেমন গবেষণা চালাচ্ছেন অন্যদিকে ভূমিকা রেখে চলেছে ভ্যাকসিন বিপ্লবে। ভারত বায়োটেক এর মতো প্রতিষ্ঠান একদিন গড়ে উঠবে এই সোনার বাংলাদেশে যেখানে আমাদের মেধাবী শিক্ষার্থীরাও গবেষণার মাধ্যমে উৎপাদন করবে জটিল ও কঠিন রোগের ভ্যাকসিন এমন দিনের অপেক্ষাতেই এখন বর্তমান প্রজন্ম।
দৈনিক চাঁদনী বাজার / সাজ্জাদ হোসাইন