আইনমন্ত্রী বলেছেন, কোটা সংস্কারের বিষয়ে সরকার নীতিগতভাবে একমত। এ বিষয়ে আপিল বিভাগের শুনানি এগিয়ে আনার ব্যবস্থা হচ্ছে।
আন্দোলনকারীদের আলোচনার বার্তাকে প্রধানমন্ত্রী যে স্বাগত জানিয়েছেন, সে কথা তুলে ধরে আইনমন্ত্রী বলেছেন, “তাদের এই প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাদের সাথে আলোচনা করার জন্য আমাকে, মানে আইন মন্ত্রীকে এবং শিক্ষামন্ত্রী মুহিবুল হাসান চৌধুরীকে দায়িত্ব দিয়েছেন। আমরা তাদের সাথে বসব।
“আমরা এটাও বলতে চাই, তারা যখনই বসতে রাজি হবে, এটা যদি আজকে হয় আজকেই আমরা বসতে রাজি আছি। কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচিতে বিভিন্ন স্থানে অবরোধ-সংঘর্ষের মধ্যে বৃহস্পতিবার দুপুরে জাতীয় সংসদের টানেলে প্রেস ব্রিফিংয়ে আসেন আইন মন্ত্রী।
তিনি বলেন, কোটা সংস্কারের বিষয়ে সরকার নীতিগতভাবে একমত। কোটা নিয়ে পরিপত্র বাতিলের হাই কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সরকার যে আপিল করেছে, তার শুনানি এগিয়ে আনার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
পাশাপাশি, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী, গত কয়েক দিনের সংঘাত ও প্রাণহানির সার্বিক ঘটনা তদন্তের জন্য বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি করতেও প্রধান বিচারপতিকে অনুরোধ করা হবে।
কেন আলোচনা-
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরির সব কোটা বাতিল করে ২০১৮ সালে পরিপত্র জারি করেছিল সরকার। এক রিট আবেদনে সেই পরিপত্র বাতিল করে হাই কোর্ট সম্প্রতি কোটা ফিরিয়ে আনার রায় দেয়।
এর প্রতিবাদে জুলাইয়ের প্রথম দিন থেকে ফের আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থী ও চাকরি প্রত্যাশীরা। শুরুতে তারা সমাবেশ-মানববন্ধনের মত কর্মসূচিতে থাকলেও পরে সড়ক অবরোধের ‘বাংলা ব্লকেড’ শুরু করলে জনভোগান্তির সূচনা হয়।
এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর এক বক্তব্য ঘিরে আন্দোলন নতুন মাত্রা পায়। গত সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ কর্মীরা আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা করলে এ আন্দোলন সহিংস রূপ পায়।
মঙ্গলবার ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে সড়ক অবরোধ করে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মধ্যে তাদের সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগের সংঘর্ষ বাধে। তাতে প্রাণ যায় ছয়জনের।
বুধবারও বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থীরা পুলিশের সঙ্গে সংঘাতে জড়ায়। এসব ঘটনায় আহত হয় কয়েক ডজন মানুষ। সরকার সব বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে শিক্ষার্থীদের হলত্যাগের নির্দেশ দেয়।
সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, “আমি বিশ্বাস করি কোটা সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের সাথে সন্ত্রাসীদের কোনো সম্পর্ক নেই। বরং সন্ত্রাসীরা এদের মধ্যে ঢুকে সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে।”
তিনি দেশজুড়ে সংঘাতের বিচারবিভাগীয় তদন্তের ঘোষণা দিয়েছেন এবং সর্বোচ্চ আদালতের রায় আসা পর্যন্ত ধৈয্য ধরার আহ্বান জানিয়ে আন্দোলনকারীদের বলেছেন, সেখানে ছাত্রসমাজ ন্যায়বিচার পাবে বলেই তার বিশ্বাস।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর এ আহ্বানে সাড়া না দিয়ে বৃহস্পতিবার সারা দেশে ‘শাটডাউনের’ ঘোষণা দেয় আন্দোলনকারীরা। তাদের এ কর্মসূচিতে প্রায় অচল হয়ে পড়েছে ঢাকা। বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষে প্রাণহানিরও খবর আসছে।
এর মধ্যেই বুধবার রাত পৌনে ৩টার দিকে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সরকারের উদ্দেশ্যে আলোচনার বার্তা দেয় আন্দোলনকারীরা।
আন্দোলনকারীদের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ ওই বিবৃতিতে বলেন, “সরকারের কাছ থেকে দৃশ্যমান পদক্ষেপ সমাধানের পথ তৈরি করতে পারে। আমাদের আন্দোলনের পাশাপাশি আলোচনার পথও খোলা থাকবে।"
বিজ্ঞপ্তিতে সারাদেশে ‘হত্যা ও হামলার’ সঙ্গে জড়িত ছাত্রলীগ কর্মী ও দায়িত্বরত পুলিশদের বিচারের আওতায় আনা এবং জাতীয় সংসদে আইন পাসের মাধ্যমে কোটা সংস্কারের দাবি জানানো হয়।
সরকার কী বলছে?
সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে আইনমন্ত্রী বলেন, “আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে কিছু ঘোষণা দিতে চাই। প্রথমত আমরা জানতে পেরেছি যারা কোটাবিরোধী আন্দোলন করছে সেই শিক্ষার্থীরা বলেছেন, আন্দোলনের পাশাপাশি তারা আলাপ আলোচনাও করতে আগ্রহী। আমরা তাদের এই আলাপ আলোচনার প্রস্তাবকে স্বাগত জানাই।”
প্রধানমন্ত্রী আইনমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীকে আলোচনার দায়িত্ব দিয়েছেন জানিয়ে আনিসুল হক বলেন, আন্দোলনকারীরা যখনই বলবে, তখনই তারা বসতে রাজি।
“দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে ঘোষণা দিতে বলেছেন যে, আগামী ৭ আগস্ট ২০২৪ সালে যে মামলা শুনানির (কোটা নিয়ে হাই কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল শুনানি) কথা বলেছিলাম, সেই শুনানি এগিয়ে আনার জন্য ব্যবস্থা নিতে। আমি সেই মর্মে অ্যাটর্নি জেনারেলকে নির্দেশ দিয়েছি, রোববার তিনি আপিল বিভাগে আবেদন করবেন যাতে মামলার শুনানির তারিখ তারা এগিয়ে আনেন।
“তৃতীয়ত, আপনারা জানেন প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটির ঘোষণা দিয়েছিলেন। সেই প্রেক্ষিতে হাই কোর্ট বিভাগের বিজ্ঞ বিচারপতি খন্দকার দিলুরুজ্জামানকে বিচারবিভাগীয় কমিটির দায়িত্ব দেওয়ার জন্য… তৈরি করা হয়েছে। এই প্রস্তাব মাননীয় প্রধান বিচারপতির কাছে যাবে। সরকারের যেহেতু এটা দায়িত্ব, আমার বিশ্বাস, মাননীয় প্রধান বিচারপতি ব্যবস্থা নেবেন।”
আইনমন্ত্রী বলেন, “আমরা দেখেছি এবং বিষদভাবে সব পরীক্ষা নিরীক্ষা ও পর্যালোচনা করেছি। দেখা যায় যে, কোমলমতি শিক্ষার্থীরা যে কোটাবিরোধী আন্দোলন করছে, তাদের কিন্তু এটাই দাবি ছিলো। এবং যেহেতু সরকার তাদের দিক বিবেচনা করে এই দাবিগুলিতে রাজি হয়েছে। আমার মনে হয় আজকে থেকে আন্দোলন করার আর কোনো প্রয়োজন নেই।”
আলোচনার প্রস্তাব দিতে সরকার দেরি করল কেন, এমন প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, “আজকেই তারা প্রস্তাব দিয়েছে, তারা আলোচনা করতে রাজি আছে। আজকেই আমরা রাজি হয়েছি। এটা দেরি কোথায় হল আপনি বলে দেন।”
সরকার আদর্শিকভাবে কোটা সংস্কারের পক্ষে যাচ্ছে কি না– এমন প্রশ্নের জবাবে আনিসুল হক বলেন, “পরিষ্কারভাবে একটা কথা বলতে চাই। এর আগেও বলেছি, এখনও বলছি। মামলাটা আদালতে আছ। সেটাও সর্বোচ্চ আদালতে। অবশ্যই এই আদালতে মামলার শুনানি শুরু হবে। সরকারপক্ষ একটা প্রস্তাব এই কোটার ব্যাপারে দেবে।
“এবং আমার মনে হয়, আমরা যেহেতু সংস্কারের পক্ষে। কোটা সংস্কার করার জন্য প্রস্তাব দেব। সেজন্য আপনারা বলতে পারেন আমরা কোটা সংস্কারের পক্ষে।”
এমন পরিস্থিতি সৃষ্টির আগে নির্বাহী বিভাগ কেন পদক্ষেপ নিল না– সেই প্রশ্ন রাখা হয় আইনমন্ত্রীর সামনে। উত্তরে তিনি বলেন, “এই প্রশ্নের সাথে দ্বিমত পোষণ করে বলতে চাই, ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে কিন্তু কোটা বাতিল করা হয়েছিল। বাতিলের ওই পরিপত্রের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানেরা হাই কোর্ট বিভাগে গিয়েছিল। কিন্তু কোটা আন্দোলকারীরা পক্ষভুক্ত হয়নি। তারপরে রায়ের পরে তাদের আন্দোলন শুরু হল। তখনও কিন্তু তারা আদালতে যায়নি।
“পরে তারা আদালতে গেছে। এজন্য আগেও সাধুবাদ জানিয়েছি। এখনও সাধুবাদ জানাচ্ছি। আদালত যখন এই রায় দিয়েছে- তখন এই প্রশ্ন ও এই আন্দোলনের শুরু হয়েছে। আমি এইটুকু বলব, তাদের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে তাদের বক্তব্য বলেছে। আন্দোলন বন্ধের জন্য আমরা অনুরোধ করেছি। আদালতে যেতে অনুরোধ করেছি। আদালতে তারা গেছেন। আদালত সিদ্ধান্ত নিলেই আমরা সেটা করতে পারি। বাংলাদেশে আইনের শাসন আছে। আদালতে যখণ কোনো প্রশ্ন ওঠে, আদালত যতক্ষণ পর্যন্ত শেষ না করে, ততক্ষণ পর্যন্ত নির্বাহী বিভাগ ইয়ে নেয় না।”
কোটা সংস্কারের যেসব দাবি রয়েছে, তার সাথে সরকার একমত কি না, সেই প্রশ্নে মন্ত্রী বলেন, “আমরা যেহেতু কোটা সংস্কারের প্রস্তাব দেব, সেহেতু বলতে পারেন, আমরা নীতিগতভাবে কোটা সংস্কারের পক্ষে।”